ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ যেমন ছাত্রলীগকে ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব তৈরির উত্তম ক্ষেত্র মনে করে, তেমনি ক্ষমতাহারা বিএনপিও ভাবে ছাত্রদলই তাদের শেষ ভরসা। নতুন নেতৃত্ব পুরোনোদের ব্যর্থতা ঘুচিয়ে দেশকে নতুন পথ দেখাবে। সেই বিবেচনায় এই দুটি ছাত্রসংগঠনের সম্মেলন কিংবা কমিটি গঠনের প্রতি অনেকের আগ্রহ থাকা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু দুটি সংগঠনেই যেভাবে কমিটি গঠিত হয় এবং সেই কমিটিতে যাঁদের প্রাধান্য দেখা যাচ্ছে, তাতে ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব নিয়ে আশাবাদী হওয়া কঠিন।
গত অক্টোবরে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ ছাত্রদলের পাঁচজনের কমিটি ঘোষণা করেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হন যথাক্রমে রাজিব আহসান ও আকরামুল হাসান। এরপর আসে ১৫৪ জনের নাম। এবং ৬ ফেব্রুয়ারি ৭৩৬ জনকে নিয়ে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠিত হয়। ছাত্রদল ও বিএনপির পক্ষ থেকে ব্যাখ্যা দাঁড় করানোর চেষ্টা হচ্ছে, যাঁরা বিগত দিনের আন্দোলন-সংগ্রামে মাঠে ছিলেন, তাঁদের সবাইকে কমিটিতে রাখা হয়েছে। কিন্তু বিশাল কমিটি করার আসল কারণ হলো অভ্যন্তরীণ কোন্দল। যেহেতু নির্বাচনের মাধ্যমে নেতৃত্ব বাছাই হয় না, সেহেতু সবাই নিজেকে যোগ্যতর মনে করেন। ছাত্রদলের কমিটি নিয়ে চেয়ারপারসনের গুলশানের অফিসে দফায় দফায় দেনদরবার এবং নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় অফিসের সামনে বিক্ষোভ, মিছিল ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। অবাক কাণ্ড হলো প্রতিষ্ঠার পর থেকে ছাত্রদল একটি চূড়ান্ত গঠনতন্ত্র তৈরি করতে পারেনি। খসড়া গঠনতন্ত্রে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটি ১৫১ সদস্যের হওয়ার কথা আছে। এর আগে ছাত্রদলের কমিটি ২৫১ জনকে নিয়ে করা হয়েছিল। এবারে ৭৩৬ জন। বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটিতে আছেন ৩৮৬ জন। একেই বলে বাঁশের চেয়ে কঞ্চি বড়।
জিয়ার আদর্শধারী ছাত্রদলের কমিটিতে কারা এসেছেন? ৮ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোর প্রতিবেদনে বলা হয়: ‘ছাত্রত্ব নেই এমন বয়স্ক নেতাদের কমিটিতে স্থান দিতে গিয়েই ছাত্রদলের কমিটির আকার বাড়ানো হয়েছে। কমিটির প্রায় সবারই বয়স ২৯ বছরের বেশি। সভাপতির বয়স ৩৭ বছরের বেশি। পদ পাওয়াদের কেউই এখন আর নিয়মিত ছাত্র নন। কেউ কেউ আইন বা অন্য কোনো বিষয়ে স্নাতকোত্তরে ভর্তি হয়ে কিংবা এমফিল করার নামে “ছাত্রত্ব” টিকিয়ে রেখেছেন।’ অর্থাৎ নেতৃত্ব টিকিয়ে রাখার জন্যই ছাত্রত্ব টিকিয়ে রাখা। ছাত্রত্বের কারণে ছাত্রদলের নেতা নন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, কেন্দ্রীয় কমিটিতে স্থান পাওয়াদের মধ্যে তিন শতাধিক হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রনেতা। এঁরা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র, কেউই নিয়মিত ছাত্র নন। চট্টগ্রামের ১৯ জনকে কেন্দ্রীয় কমিটিতে রাখা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে নয়জন মহানগর কমিটির। এঁদের কারও এখন আর ছাত্রত্ব নেই। কমিটিতে স্থান পাওয়াদের বড় অংশের বিরুদ্ধেই কোনো না কোনো মামলা আছে। মামলার বিষয়টি না হয় বোঝা গেল। সরকার বিরোধী দলের আন্দোলন ঠেকাতে নেতা–কর্মীদের বিরুদ্ধে পাইকারি মামলা করছে। কিন্তু অছাত্রদের কমিটিতে আনতে সরকারের কোনো ভূমিকা থাকতে পারে না।
ছাত্রদলের আগের কমিটিগুলো খুব ভালো ছিল বলা যাবে না। ছাত্রদলের একসময়ের নেতা গোলাম ফারুক অভি নব্বইয়ের আন্দোলনের সঙ্গে বেইমানি করেছেন। পরে তিনি এরশাদের দলে যোগ দিয়ে সাংসদ হন।
১১ সেপ্টেম্বর ২০১৩ সালের প্রথম আলোয় শিরোনাম হয়েছিল: ‘ছাত্রদলের কমিটি যেন আসামিদের আশ্রয়স্থল’। ছাত্রদলের কমিটিতে অছাত্র আর বুড়োদের অগ্রাধিকারের ধারা অব্যাহত আছে। আছে গুম হওয়া মানুষের নামও। তবে আরও ভয়াবহ তথ্য হচ্ছে শিক্ষিকা ধর্ষণের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিও আছেন ছাত্রদলের নেতার তালিকায়। খোদ বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের সময়ই ওই নেতার বিরুদ্ধে ধর্ষণ মামলা হয়। তিনি হয়েছেন ঢাকা মহানগর উত্তর শাখা কমিটির সাধারণ সম্পাদক। এজাহারে দেখা যায়, ধর্ষণ মামলায় সাজ্জাদ হোসেন রুবেলের নাম আছে প্রথমেই। বুয়েটের মেধাবী শিক্ষার্থী সাবেকুন নাহার সনি হত্যা মামলার আসামিও ছাত্রদলের নেতৃত্ব পেয়েছিলেন।
পিছিয়ে নেই গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের দাবিদার ছাত্রলীগও। স্বাধীনতার পর এই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন শফিউল আলম প্রধান, যিনি মুহসীন হলের সাত খুনের মামলার একজন দণ্ডিত আসামি। এই ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন হেমায়েত হোসেন আওরঙ্গ; পরে আওয়ামী লীগ থেকে বিতাড়িত হয়ে যিনি বিএনপিতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ছাত্রলীগের এবারের কমিটি কেমন হলো?
২৬ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ‘ছাত্রলীগের ৩০১ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটির অধিকাংশই অছাত্র কিংবা নিয়মিত শিক্ষাজীবন শেষে নামমাত্র বিভিন্ন কোর্সে ভর্তি হয়ে আছেন। এঁদের অর্ধশত নেতা চাঁদাবাজি, শিক্ষক লাঞ্ছনা, প্রতিপক্ষকে মারধরসহ বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। ঘোষিত কমিটির সহসভাপতি ও সম্পাদক পর্যায়ের ১১৬ নেতার মধ্যে ৮৪ জনই অছাত্র। এর বাইরে অধিকাংশই নিয়মিত শিক্ষাজীবন শেষে বিভিন্ন শিক্ষা কোর্সে ভর্তি হয়ে আছেন। চাঁদা ও আধিপত্যের জেরে ২০১৩ সালের ৩০ নভেম্বর গভীর রাতে ঢাকা কলেজে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষ ও গোলাগুলিতে প্রাণিবিদ্যা বিভাগের ছাত্র আসাদুজ্জামান ফারুক মারা যান। এ ঘটনায় জড়িতসহ অন্য নানা অভিযোগে ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাকিব হাসানকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়। সেই বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার না করে তাঁকে নতুন কমিটির সহসভাপতি করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় কমিটিতে সহসম্পাদক পদ পাওয়া দিয়াজ ইরফান চৌধুরীর বিরুদ্ধে ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৪ ধারায় চট্টগ্রাম মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে ‘বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে এক তরুণীর সঙ্গে দৈহিক সম্পর্কে’র অভিযোগে সাধারণ ডায়েরি রয়েছে। ছাত্রদল ও ছাত্রলীগের কমিটিতে এমন ব্যক্তিও ঠাঁই পেয়েছেন, যাঁদের বিরুদ্ধে অনৈতিকতার অভিযোগ রয়েছে। এঁরা কীভাবে কর্মীদের নৈতিকতা শিক্ষা দেবেন? অছাত্ররা যাতে ছাত্রলীগের নেতৃত্বে আসতে না পারেন, সে জন্য আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ছাত্রলীগের নেতৃত্বে আসার বয়সসীমা ২৭ বছর বেঁধে দিয়েছিলেন। এবার কমিটি গঠনের সময় সেই বিধানও মানা হয়নি। ফলে ছাত্রলীগ ও ছাত্রদল দুই সংগঠনেই আদুভাইদের রাজত্ব কায়েম হবে। হয়তো দেখা যাবে, বাবা–ছাত্র ছেলে–ছাত্রকে সাংগঠনিক বিষয়ে তালিম দিচ্ছেন।
ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্রের ২৩-এর (ক) ধারায় পদপ্রাপ্তির ব্যাপারে অবিবাহিত থাকার বাধ্যবাধকতা রয়েছে, সেটিও লঙ্ঘন করা হয়েছে। কমিটিতে অন্তত পাঁচজন বিবাহিত ছাত্রনেতা বা নেত্রী রয়েছেন।
প্রথম আলোর প্রতিবেদন থেকে ছাত্রদল ও ছাত্রলীগের নতুন নেতৃত্বের যে পরিচয় পাওয়া গেল, তা সংগঠনের জন্য না হলেও ছাত্ররাজনীতির জন্য হতাশাজনক। নেতৃত্ব বাছাইয়ের সর্বজনীন যে রীতি, সংগঠনের কাউন্সিল হবে, কাউন্সিলরদের ভোটে নেতা নির্বাচিত হবেন। কিন্তু এই রীতি রাজনৈতিক দলগুলো যেমন মানে না, তেমনি ছাত্রসংগঠনগুলো অগ্রাহ্য করে চলেছে।
এখানে দল বা ছাত্রসংগঠনের কাউন্সিল হলো লোক দেখানো। সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ কমিটিতে কে কে থাকবেন, নতুন কে আসবেন, সেসব আগেই ঠিক করে রাখা হয়। নেতৃত্ব নির্বাচনে কাউন্সিলরদের কোনো ভূমিকা নেই। কাউন্সিলের আগে লবি তদবিরে যাঁরা এগিয়ে থাকেন, তারাই শীর্ষ পদ পান। কোনো কোনো সংগঠন কাউন্সিল করার কষ্টটুকু স্বীকার করতে চায় না। যেমন, ছাত্রদলের কাউন্সিল হয়নি। বিএনপিপ্রধান তাঁর অফিস থেকে তালিকা তৈরি করে দিয়েছেন। আবার কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নাম ঘোষণার পর কয়েক মাস এমনকি বছর পার হয়ে যায়, পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হয় না।
ছাত্ররাজনীতি হবে ছাত্রদের জন্য, ছাত্রদের দ্বারা এবং ছাত্রদের কল্যাণে নিবেদিত। কিন্তু আমাদের ছাত্ররাজনীতি হলো দলের জন্য, দলের প্রধানের দ্বারা এবং দলের কল্যাণে নিয়োজিত। দলীয় প্রধানকে খুশি রাখতে পারলে নেতৃত্বের সামনে আসা যাবে, না পারলে পেছনেই থাকতে হয়। ছাত্রসংগঠনকে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়ার কাজটি প্রথম করেছিলেন সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান। রাজনৈতিক দলবিধি অনুযায়ী প্রতিটি দলকে সহযোগী ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক প্রভৃতি সংগঠনের নামও দিতে হতো। দলবিধি না থাকলেও লেজুড়বৃত্তি ঠিকই আছে। এখন ছাত্রসংগঠনগুলো পরিণত হয়েছে রাজনৈতিক দলের ‘শিক্ষাঙ্গন শাখায়’। এভাবে কোনো দেশে ছাত্ররাজনীতি বিকশিত কিংবা ভবিষ্যৎ নেতৃত্বও গড়ে তুলতে পারে না।
আজকের ছাত্রসংগঠনগুলোর নেতৃত্ব যতটা নেতামুখী, ততটাই গণতন্ত্রবিমুখ। সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে পড়েছে। ছাত্রনেতারা দিনের বেশির ভাগ সময় নেতা-নেত্রীদের বাড়িতে কাটান এবং আখের গোছান। লেজুড়বৃত্তির এই ছাত্ররাজনীতি ছাত্রসমাজের কোনো উপকারে আসে না।
শিক্ষাঙ্গনে ছাত্র নেতৃত্ব গড়ার যেমন উদ্যোগ নেই, তেমনি ছাত্রসংগঠনগুলোর কমিটি গঠনেও সাধারণ কর্মীদের কোনো ভূমিকা নেই। আড়াই দশক ধরে দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয় না। অথচ সামরিক শাসনামলে ছাত্র সংসদগুলোর নির্বাচন হতো। নির্বাচিত নেতৃত্বের কাছে সাধারণ শিক্ষার্থীরা দাবিদাওয়া তুলে ধরতেন। এখন তাঁদের যাওয়ার জায়গা নেই বলেই হলের ‘গেস্টরুম’ নামের টর্চার সেলে আশ্রয় নিতে হয়।
কে বলে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে ঐক্য নেই? ছাত্রলীগ ও ছাত্রদলের মধ্যে কোনো মিল নেই। ঐক্য আছে ছাত্র সংসদ নির্বাচন না করার। মিল আছে অছাত্র, বয়স্ক ও বিতর্কিতদের কমিটিতে নেওয়ার। ক্ষমতায় থাকলে হল ও ছাত্রসংগঠন দুটোই অছাত্রদের দখলে চলে যায়। আর বিরোধী দলে থাকলে শুধু সংগঠনটি অছাত্রদের দ্বারা পূরণ করা হয়।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrabhassan55@gmail.com