মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর, এডভোকেট :
২০১৫ সাল শুরু হয়েছিল হরতাল, অনির্দিষ্টকালের জন্য অবরোধের নামে পেট্রোল বোমা হামলা,জ্বালাও পোড়াও,বেপরোয়া হত্যাসহ সন্ত্রাস দিয়ে। প্রথম তিন মাসের সহিংসতায় অগ্নিদগ্ধ হয়ে কমপক্ষে ৭৬ জনের মৃত্যু হয়, ২২৫ জন নানা মাত্রায় দগ্ধ হন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিট দগ্ধ মানুষের আর্তনাদে ভারী হয়ে ওঠে। বছরটা শেষ হয়েছে উৎসবমূখর পরিবেশে মোটামোটি শান্তিপূর্ণভাবে অংশগ্রহনমূলক পৌর নির্বাচনের মাধ্যমে। যদিও সরকারী দলের প্রার্থীদের বিরুদ্ধে প্রশাসনের সহায়তায় ভোটকেন্দ্র দখল করে জাল ভোট দিয়ে ফলাফল প্রভাবিত করার অভিযোগ করেছে বিরোধী দল। অনেক যুক্তিসঙ্গত ও গ্রহনযোগ্য অভিযোগ থাকার পরও বছরের শুরুর সন্ত্রাসের তুলনায় শান্তিপূর্ণভাবেই বছরটি শেষ হয়েছে। বর্ষবরণ ও বর্ষবিদায়ের অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে জঙ্গীবাদীদের ব্যাপক নাশকতার যে আশঙ্কা করা হয়েছিল তাও সরকারের আগাম সর্তক ব্যাবস্থা গ্রহনের ফলে হয় নাই। চাপা আতংক থাকলেও আনন্দ ও খুশী দিয়েই বছর শুরু হয়েছে। সরকার অতি সাফল্যের সাথে নতুন বছরের প্রথম দিনে ৪ কোটি ৪৪ লাখ ১৬ হাজার ৭২৮ জন প্রাক-প্রাথমিক,প্রাথমিক,ইবতেদায়ি,মাধ্যমিক,দাখিল ও কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের হাতে ৩৩ কোটি ৩৭ লাখ ৬২ হাজার ৭৭২টি পাঠ্যপুস্তক বিতরণ করার মাধ্যমে দেশব্যাপী ’পাঠ্যপুস্তক উৎসব’ পালন করেছে। এতে করে শিক্ষার্থীদের পিতা-মাতা,অভিভাবকসহ দেশের প্রায় অর্ধেক মানুষ শরীক হয়েছে,আনন্দিত হয়েছে। পাঠ্যপুস্তকগুলো দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যথাসময়ে নিরাপদে পৌছে দিতে সরকারকে ১৬ হাজার ট্রাক ব্যবহার করতে হয়েছে এবং বইগুলো প্রিন্ট,বাইন্ডিং ইত্যাদি কাজে প্রায় ৯৯ হাজার শ্রমিক শ্রম দিয়েছে বলে জানা যায়। সকল সম্মানিত পাঠকদের নববর্ষের শুভেচ্ছা।
দেশের পত্রিকাগুলো নববর্ষ সংখ্যা প্রকাশ করেছে। এতে বিগত বছরের প্রাপ্তি ও নববর্ষের প্রত্যাশা নিয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ লেখা প্রকাশিত হয়েছে। গত বছর আমাদের অগ্রযাত্রার খাতায় সংযোজিত সবচেয়ে বড় খবরটি ছিল মধ্যম আয়ের দেশের স্বীকৃতি। বিশ্বব্যাংক ১জুলাই নিম্ন আয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশের তালিকায় বাংলাদেশকে উন্নীত করেছে। স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ নিম্নআয়ের দেশের তালিকায় ছিল এতদিন। এগিয়ে যাওয়ার আরো একটি উদ্যোগের সুচনা হয়েছে পনেরোতে। শুরু হয়েছে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে বহুল আলোচিত ও বহু প্রত্যাশিত পদ্মাসেতুর কাজ। বিশ্বব্যাংকের কতিপয় কর্মকর্তাদের অপমানজনক দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অপবাদকে চ্যালেঞ্জ করে নিজেদের অর্থায়নে বাস্তাবায়াধীন দেশের সবচেয়ে বড় প্রকল্পে ব্যয় হবে ২৮হাজার কোটি টাকা। এর মধ্য দিয়ে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি জেলার মানুষের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন বাস্তবায়ন শুরু হল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরিবেশ বিষয়ে জাতিসংঘের সবচেয়ে সম্মানজনক পুরস্কার চ্যাম্পিয়ান অব দ্য আর্থ প্রাপ্তিও ছিল একটি উল্লেখযোগ্য অর্জন। দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে ৬৮ বছর পর গত ১ আগস্ট নাগরিকত্ব প্রাপ্তির নতুন জীবন লাভ করেছে বাংলাদেশ ও ভারতের ১৬২টি ছিটমহলের প্রায় ৫৯হাজার মানুষ। অবরুদ্ধতা থেকে মুক্তি পেয়েছে তারা। এরই মধ্য দিয়ে ৪১বছর ধরে ঝুলে থাকা ইন্দিরা-মুজিব চুক্তির সফল বাস্তাবায়ন হয়েছে। মানবতাবিরোধী অপরাধে দন্ডপ্রাপ্ত বিএনপি-জামাতের দুইজন গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির রায় অনেক কল্পনা-জল্পনাকে মিথ্যা প্রমাণিত করে কার্যকর করা হয়েছে। ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারপারসন ফজলে হাসান আবেদ খাদ্য ও কৃষিক্ষেত্রে অবদান রাখায় নোবেল প্রাইজ বলে খ্যাত বিশ্বখাদ্য পুরস্কার পেয়েছেন। বিদায়ী বছরে নিজেদের ইতিহাসে সেরা সাফল্য পেয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। একের পর এক পরাশক্তিতে নাকানি-চুবানি খাইয়ে বছরটি সোনার হরফে লিখেছেন মাশরাফি,তামিম,সাকিব,মাহমুদুল্লাহ ও মুস্তফিজরা। ইংল্যান্ড,পাকিস্তান,ভারত,দক্ষিণ আফ্রিকার মতো ক্রিকেট পরাশক্তিকে পরাজিত করে ইতিহাসের প্রথম বারের মত বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনালে খেলার গৌরবে ভেসেছে বাংলাদেশ। বছরে একটি সিরিজও হারে নি বাংলাদেশ। ফুটবলে ইতিহাস সৃষ্টি করেছে বাংলাদেশের মেয়েরা। এএফসি অনুর্ধ্ব ১৪ গার্লস রিজিওনাল চ্যাম্পিয়ানশিপের ফাইনালে স্বাগতিক নেপালকে হারিয়ে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ান হয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার ওশেনিয়া সর্বোচ্চ শৃঙ্গ কারন্তাবেজ পিরামিড জয়ের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের প্রথম পর্বতারোহী হিসেবে সাত মহাদেশের সাত সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ জয় করেছেন ওয়াসফিয়া নাজরীন। বাংলাদেশী বংশোদ্ভুত তিন সাহসী বাঙ্গালী কন্যা রুশনারা আলী,টিউলিপ ও রূপা আশা হক ব্রিটিশ পার্লামেন্ট নির্বাচনে জয়ী হয়ে এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। আরও একটি আশাজাগানিয়া ভাল খবর হল বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ২০১৩ সালের জরিপে ছিল ৭০ বছর ৩ মাস,তা বর্তমানে বেড়ে হয়েছে ৭০ বছর ৭ মাস। গত বছরকে রাজনীতির ধাক্কার বছর বলা হলেও অর্থনীতিতে স্বস্তির বছর বলে আখ্যায়িত করছেন বিশেষজ্ঞরা। অর্থনীতির প্রায় অধিকাংশ সূচকই ছিল উর্ধমূখী এবং উচ্চ আসনে ছিল বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ।
বছরের খুবই হতাশাজনক সংবাদ ছিল, মে মাসজুড়ে থাইল্যান্ডের দুর্গম পাহাড়ী এলাকা থেকে একের পর এক গণকবর আবিস্কারের ঘটনায় বাংলাদেশে ব্যাপক সাড়া পড়ে যায়। তথ্য আসতে থাকে এসব কবর থেকে উদ্ধার হওয়া মরদেহগুলোর মধ্যে রোহিঙ্গা শরণার্থীর সাথে অভিবাসন প্রত্যাশী বাংলাদেশী নাগরিকও ছিল। বছরজুড়ে উগ্র ধর্মীয় জঙ্গিবাদীদের হাতে একের পর এক ব্লগার,লেখক ও প্রকাশক নিহত হওয়ার সংবাদ। নিহত অনেকে হুমকী পাওয়ার পর সংশ্লিষ্ট থানায় জিডি করেও কোন নিরাপত্তা না পাওয়ার অভিযোগও ছিল। ২৩ অক্টোবর তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতিকালে এ দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মত বোমা হামলা করে মানুষ হত্যা ও আহত করার সংবাদে দেশবাসী উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। দুইজন বিদেশী নাগরিক হত্যার ব্যাপারটিও ছিল দেশে বিদেশে অমর্যাদাকর আলোচিত বিষয়।
প্রায় ত্রিশ লক্ষ মামলাজট ও বিচার কাজে কতিপয় সরকারী কৌশলীদের ভুমিকা ও তাদের যোগ্যতা নিয়ে খোদ দেশের প্রধান বিচারপতি অসন্তোষ্টি প্রকাশ করে তির্যক মন্তব্য করেছেন যা সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। সকল সরকারী কর্মকর্তাদের জবাবদিহিতার ব্যবস্থা আছে, চাকুরীতে বদলীর নিয়ম আছে,কিন্ত সরকারী কৌশলীদের কাজের জন্য জবাবদিহিতা কোথায় আছে? আইনতঃ তিন বছরের জন্য নিযুক্ত হয়ে ছয় বছরেও বদলী বা জবাবদিহিতার ব্যবস্থা না করায় তারা আরো বেপরোয়া হয়ে গেছেন বলে অভিযোগ ছিল সারা বছর। মহামান্য সুপ্রীম কোর্টের প্রধান বিচারপতির প্রকাশ্যে মন্তব্যের পরও সরকারের পক্ষে দায়ীদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা না নেওয়া ছিল হতাশাব্যঞ্জক ও আইনের শাসনের পরিপন্থী।
দেশের জমির দাম বর্তমানে অর্ধেকের বেশী কমে গেছে। দুদকের ভয়ে দুর্নীতির টাকা দিয়ে বা দুর্নীতির মাধ্যমে ব্যাংক থেকে অবৈধভাবে ঋণ নিয়ে জমি ক্রয় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় জমির ক্রয়বিক্রয় কমে গেছে এবং দামও বাড়ছে না বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। দেশে দুর্নীতি এবং দুর্নীতিমূলক কার্য প্রতিরোধের লক্ষ্যে দুর্নীতি ও অন্যান্য সুনির্দিষ্ট অপরাধের অনুসন্ধান এবং তদন্ত পরিচালনার জন্য একটি স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন প্রতিষ্টার এবং আনুষঙ্গিক বিষয়াদি সম্পর্কে বিধান করা সমীচীন ও প্রয়োজনীয় হওয়ায় বিএনপির আমলে ২৩ ফেব্রুয়ারী ২০০৪ সালে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন,২০০৪ পাস করা হয়। উক্ত আইনের ১৮ ধারায় উল্লেখ করা হয়েছিল যে, ৩৪ ধারার ক্ষমতাবলে কমিশন রাষ্ট্রপতির পূর্বানুমোদনক্রমে এবং সরকারী গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা প্রণীত বিধানাবলী অনুযায়ী কমিশন ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবেন। কিন্তু বিএনপি বা জোট সরকার ক্ষমতা ত্যাগ করা পর্যন্ত রাষ্ট্রপতির পূর্বানুমোদনক্রমে বিধানবলী প্রণয়ন করে সরকারী গেজেটে প্রজ্ঞাপন প্রকাশ না করায় দুদকের আইনটি অকার্যকরই থেকে যায়। ওয়ান/ইলেভেনের মাধ্যমে জোট সরকার বিদায়ের পর ২৯ মার্চ ২০০৭ সালে দুর্নীতি দমন কমিশন বিধিমালা,২০০৭ সরকারী গেজেটে প্রজ্ঞাপন আকারে প্রকাশ করা হলে তা কার্যকরী হয়। দুদক আইন,২০০৪ এর তপশীলে তখন দন্ডবিধির ১৩টি ধারা ছিল। ২০১৩ সালের ২০ নভেম্বর সংশোধনীমুলে তপশীলে অপ্রত্যাশিতভাবে দন্ডবিধির ৪২০, ৪৬২এ, ৪৬২বি, ৪৬৬, ৪৬৭, ৪৬৮, ৪৬৯ ও ৪৭১ ধারা সংযুক্ত করা হয়। এতে করে পুলিশকর্তৃক তদন্তযোগ্য ও ম্যাজিষ্ট্রেটকর্তৃক সরাসরি আমলে গ্রহনযোগ্য হাজার হাজার নতুন সংযুক্ত ধারার মামলার তদন্তভার ন্যস্থ হয় দুদকের ওপর। যদিও দুদকের জনবল বাড়ানো হয় নাই। পত্রপত্রিকায় ও সর্ব মহলে এই অপ্রত্যাশিত ও অপ্রয়োজনীয় সংশোধনী নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠে। আবার তা সংশোধন করার জন্য দুদককর্তৃক প্রেরিত প্রস্তাব মন্ত্রণালয় ও মন্ত্রীসভায় অনুমোদিত হলেও তা সংসদে পাশ হয়ে গেজেট আকারে এখনও বের হয় নাই। একি শুধু অবহেলা? নাকি অন্য কোন ষড়যন্ত্র? দুদককে প্রকৃতপক্ষে শক্তিশালী,স্বাধীন ও গতিশীল করতে হলে তা আইন দিয়েই করতে হবে। দুর্নীতি কমলে উন্নয়নের গতি আরো বৃদ্ধি পাবে, আইন আদালত থেকে সর্বস্তরে আইনের শাসন তথা সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। বিগত বছরের হতাশার বিষয়গুলির প্রতি এই বছর সরকার অধিক গুরুত্ব দিবে বলে আমজনতার নববর্ষের প্রত্যাশা।