শর্মীর খুব কান্না পাচ্ছে। চোখ দুটি পানিতে চিক চিক করছে। বাসায় থাকলে হয়তো চোখ দুটি চিক চিক করার সুযোগ পেত না কারণ তার আগেই পানি গড়িয়ে পড়তো। তবে রাস্তায় এমন করা অসম্ভব। তাই খুব করে এই দু’চোখের পানি চেপে রাখতে চাইছে শর্মী। গত সাতাশ মিনিট ধরে শর্মী বাসের জন্য দাঁড়িয়ে আছে। এর মধ্যে দুটি বাস অবশ্য এসে চলে গেছে তবে এগুলোতে এত বেশি ভিড় ছিল যাতে শর্মীর উঠা একেবারে অসম্ভব। শর্মীর নিজের উপর খুব রাগ হলো কেন সে ছেলে হলো না। ছেলে হলে হয়তো ঝুলেও যাওয়া যেত। শর্মী ঘড়ির দিকে তাকালো। দশটা পয়ত্রিশ। শর্মী ঘড়িটি চোখের সামনে এনে আবার ভালো করে দেখলো। কারণ ঘড়িটির গ্লাসটা ঝাপসা হয়ে গিয়েছে তাই ভালো করে দেখা যায় না বলে একটু কাছে নিয়ে দেখতে হয়। শর্মী যখন এসএসসি দিচ্ছিল তখন তার বড় মামা এই ঘড়িটি দিয়েছিলেন। বড়মামা ঘড়িটি দিয়ে বললেন, শোন, এই ঘড়িটি দেখবি মাঝে মাঝে তোর খুব প্রিয় একজন হয়ে গিয়েছে। এটা তোর সাথে কথা বলবে, হাসবে, কাঁদবে। কারণ প্রতিদিন এই জিনিসটিকে তুই যতবার ভালো করে দেখবি ততবার তুই আর কাউকে এমনটি লক্ষ্য করছিস না। তাই এটা তোর খুব প্রিয় হয়ে যাবে। ঘড়িটার খুব ভালো করে যত্ন নিবি সব সময়। সত্যি এই ঘড়িটা এখন শর্মীর খুব প্রিয়। বাইরে বেরুলে এই ঘড়িটা শর্মীর সাথে থাকবেই।
শর্মী আস্তে আস্তে উত্তেজিত হয়ে পড়ছে। কারণ ঠিক এগারোটার মধ্যে তাকে রায়হান সাহেবের অফিসে উপস্খিত হতে হবে। আজ তার ইন্টারভিউ। এদিকে বাসের যা অবস্খা তাতে আর বাস আসবে বলে মনে হচ্ছে না। শর্মী খুব ভয়ে আছে তার চোখ দুটিতে যে পানি নাড়াচাড়া করছে তা আবার গড়িয়ে না পড়ে। শর্মী মনে মনে তার ব্যাগে কত টাকা থাকতে পারে আন্দাজ করলো।
বুঝলো বড়জোর সাইত্রিশ টাকার উপরে থাকতে পারে না। এই সাইত্রিশ টাকার মধ্যে তাকে রায়হান সাহেবের অফিসে যাওয়া আসা মেটাতে হবে। সুতরাং এই টাকায় ট্যাক্সি নিয়ে যাওয়ার ভাবনা করা পাগলামী।
প্রায় দশ মিনিট পর শর্মী দেখলো একটা বাস এসে দাঁড়ালো। শর্মীর মনে হলো কোন বিমান যেন তার জন্য এসে দাঁড়ালো। বাসটি দাঁড়াতেই শর্মী দৌড়ে গিয়ে উঠে পড়লো। গাড়িতে উঠে শর্মী ভাবলো এই দৌড়ানোর পাগলামীটা না করলেও চলতো কারণ এখনো বাসের অনেকগুলো সিট খালি আছে। ব্যাগ থেকে রুমালটা বের করে চোখের কোণে জমে থাকা পানিগুলো মুছলো শর্মী। একক্ষণ ধরে জমে থাকা পানিতে চোখ দুটি খুব ভারী লাগছিলো।
রায়হান সাহেবের অফিসে পৌঁছাতে প্রায় এগারোটা বেজে গেল। তবু শর্মী খুশি হলো যে খুব বেশি দেরী সে করেনি। রিসেপশনে ছিমছাম করে সাজানো চেয়ারে শর্মী বসে আছে। রায়হান সাহেব এখনো অফিসে আসেননি। রিসেপশনের মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করতেই সুন্দর একটা হাসি দিয়ে বললো, না স্যার তো এখনো আসেননি। আপনি অপেক্ষা করুন স্যার একটু পরেই চলে আসবেন। অফিসটা শর্মীর খুব পছন্দ হলো। খুবই গোছানো একটা অফিস। তবে তার একটু ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগছে। এসির বাতাসটা খুবই ঠাণ্ডা মনে হচ্ছে। শর্মী ভাবে এই অফিসে তার চাকরি হলেতো প্রতিদিন তাকে সোয়েটার পরে আসতে হবে।
শর্মীর খুব টেনশন লাগছে। কিছুক্ষণ আগে রায়হান সাহেব এসেছেন। শর্মীর সামনে দিয়ে নিজের রুমে ঢুকে পড়লেন। শর্মী কি করবে বুঝতে পারছে না। লোকটি তাকে কি না চেনার ভান করছে নাকি চিনতেই পারেনি। শর্মী ভাবে মাত্র একদিনইতো দেখা। মনে নাও থাকতে পারে। এখন শর্মীর নিজেকে খুব অসহায় লাগছে। কি করবে বুঝতে পারছে না। রায়হান সাহেবই তো তাকে আসতে বলেছিলেন। শর্মী ভাবছে তার স্বপ্নটা হয়তো ভাঙতে শুরু করছে। তবুও অপেক্ষা করতে লাগলো শর্মী। তবে খুব দ্বিধায় পড়ে গেল। রিসেপশনের মেয়েটার কাছে গিয়ে বলবে নাকি যে, রায়হান সাহেবকে যেন সে এসেছে এটা জানানো হয়। আবার এও ভাবছে যদি রায়হান সাহেব তাকে চিনতে না পারেন তবে নিজেকে খুব ছোট মনে হবে।
রায়হান সাহেবের সাথে শর্মীর দেখা হয়েছে মাত্র একবার। গত মাসের শেষের দিকে পিজি হাসপাতালে। শর্মীর বাবার স্ট্রোক হয়েছিলো রাত আটটায়। পিজিতে নিয়ে যেতে যেতে প্রায় রাত নয়টা বেজে গেল। বাবাকে নিয়ে শর্মী একাই গিয়েছিলো। জরুরী বিভাগে গিয়ে যখন ডাক্তারদের কোন হদিস পাচ্ছিলো না তখন শর্মী বাবার পাশে দাঁড়িয়ে বাচ্চা মেয়ের মতো ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে লাগলো। হঠাৎ রায়হান সাহেব শর্মীর সামনে এসে বললেন, আপনি কাঁদছেন কেন? আপনার বাবা অবশ্যই ভালো হয়ে যাবেন। অপরিচিত ত্রিশ কি পয়ত্রিশ বছরের এমন একজন লোককে এভাবে বলতে শুনে শর্মী কি বলবে বুঝতে পারলো না। রায়হান সাহেব ইশারায় কাকে যেন ডাকলেন তারপর তাকে কি যেন বলতেই কিছুক্ষণের মধ্যে এক ডাক্তার এসে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ওয়ার্ডে পাঠিয়ে দিলেন। শর্মীর বাবাকে যখন ওয়ার্ডে নিয়ে যাচ্ছে তখন শর্মী রায়হান সাহেবকে একটা ধন্যবাদ জানাতে গেল। তখন শর্মীর চোখ দুটি ভেজা। অনেকক্ষণ কাঁদলে চোখের ভেজা ভেজা ভাবটা অনেকক্ষণ থেকে যায়। শর্মী রায়হান সাহেবকে ধন্যবাদ জানালেন তিনি খুব গম্ভীরভাবে জিজ্ঞেস করলে, কি নাম আপনার? শর্মী মাথা নিচু করে বললো, শর্মী।
রায়হান সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, আপনার সাথে আর কেউ আসেনি?
শর্মী বললো, আমরা দুই বোন। আমার ছোট বোনটার কাল ভর্তি পরীক্ষা তাই আমি তাকে আসতে বারন করেছি। আর মারও শরীর ভালো না বলে আসতে পারেনি।
আপনি কি করেন? জিজ্ঞেস করলেন, রায়হান সাহেব।
শর্মী বললো, কিছুদিন হলো পাস করে বেরিয়েছি এখন চাকরি খুঁজছি।
তারপর রায়হান সাহেবকে খুব তাড়াহুড়া করে চলে যেতে দেখলো। যাওয়ার আগে শর্মীর হাতে একটা কার্ড দিয়ে বললেন, এখানে আমার ফোন নাম্বার আছে। কন্টাক্ট করে একদিন আসুন আমার অফিসে দেখবো আপনার জন্য কিছু করা যায় কিনা।
রিসেপশনে বসে বসে শর্মী রায়হান সাহেবের সাথে প্রথম দেখা হওয়ার কথা ভাবছিলো। এমন সময় হঠাৎ রিসেপশনিষ্ট মেয়েটা এসে বললে, আপনি কি শর্মী?
শর্মী বললো, হ্যাঁ বলুন।
তখন মেয়েটা সুন্দর একটা হাসি দিয়ে বললো, স্যার আপনাকে তার রুমে যেতে বলেছেন।
শর্মী রায়হান সাহেবের রুমে ঢুকতেই রায়হান সাহেব বললেন, কি খবর শর্মী কেমন আছেন?
শর্মী খুব অবাক হয়ে গেল। কি বলবে বুঝতে পারলো না। কারণ রায়হান সাহেব যে শর্মীকে চিনতে পারবেন এবং তার নামও যে এখনো মনে আছে সেটা শর্মীর বিশ্বাস হচ্ছিল না।
শর্মী যে অবাক হয়েছে সেটা তার চেহারা দেখে বুঝা গেল, তাই রায়হান সাহেব বললেন, কি ব্যাপার শর্মী আপনি আমাকে চিনতে পারছেন না?
শর্মী একটু লজ্জা পেয়ে বললো, না মানে…
তাহলে অমন করে দাঁড়িয়ে না থেকে বসেন।
শর্মী চেয়ারে বসতেই রায়হান সাহেব বললেন, আপনার এপয়েন্টমেন্ট লেটার অনেক আগেই রেডি করা আছে। এখানে আপনি জুনিয়র এক্সিকিউটিভ হিসেবে কাজ করবেন। আর শুনুন আমি আপনাকে চাকরিটা কেন দিলাম তা নিয়ে দ্বিধায় থাকবেন না। এর কারণটা আমি আপনাকে অতি শীঘ্রই জানাবো।
শর্মী খুব অবাক হলো। তার খুব কান্না চলে আসছে। কান্নাটা কিছুতেই চেপে রাখতে পারছে না। ওর বিশ্বাস হচ্ছে না যে চাকরিটা তার হয়ে গেছে।
রায়হান সাহেব বললেন, ঠিক আছে আপনি আজ আসুন। যদি চাকরিটা করেন তবে কাল থেকে জয়েন করতে পারেন।
আজ শর্মী নয়টার আগেই অফিসে পৌঁছে গেল। অফিসে ঢোকা মাত্রই বুঝতে পারলো ও যে আজ জয়েন করবে এটা হয়তো অফিসে সবাই আগে থেকেই জানে। রিসেপশনের মেয়েটা এগিয়ে এসে সালাম দিয়ে বললো, ম্যাডাম ঐ কর্নারের রুমটা স্যার আপনার জন্য বরাদ্দ দিয়েছেন। আপনি ওখানেই বসবেন।
শর্মী নিজের রুমটা দেখে খুব অবাক হয়ে গেল। এত সুন্দর রুম। খুবই গোছানো রুমটা। দেয়ালে সুন্দর একটা পেইন্টিং। রংটাও শর্মীর প্রিয়।
এগারোটার সময় রায়হান সাহেব অফিসে এলে শর্মীর ডাক পড়লো। শর্মী রুমে ঢুকতেই রায়হান সাহেব বললেন, জয়েন করলে তাহলে? কিছু মনে করোনা আমি তোমাকে এখন থেকে তুমি করেই বলবো। তারপর বলো কেমন লাগছে অফিস?
শর্মী বললো, ভালো।
রায়হান সাহেব বললেন, আমাদের কামরুল সাহেব তোমাকে তোমার কাজ বুঝিয়ে দেবেন। আশা করি কোন সমস্যা হবে না। আর শোন, লাঞ্চের পর তুমি আমার রুমে এসো তখন তোমার সাথে কথা বলবো। এখন তুমি যাও।
রুমে গিয়ে বসতেই কিছুক্ষণের মধ্যে কামরুল সাহেব এসে শর্মীর কাজ বুঝিয়ে দিলেন। শর্মীকে যে দায়িত্ব দেয়া হলো এটা শর্মীর কাছে খুব সহজ মনে হলো।
লাঞ্চের পরপরই শর্মীর ডাক পড়লো রায়হান সাহেবের রুমে। শর্মী রুমে যেতে রায়হান সাহেব বললেন, এসো শর্মী। বসো। লাঞ্চ করতে কোন সমস্যা হয়নিতো?
শর্মী বললো, না স্যার। শর্মী দেখলো এখন রায়হান সাহেবকে খুব উৎফুল্ল মনে হচ্ছে। এর আগে যে কবার রায়হান সাহেবের মুখোমুখি হয়েছে ততবারই রায়হান সাহেবকে খুব গম্ভীরভাবে কথা বলতে দেখেছে। কিন্তু এখন একটু অন্যরকম মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে কোন কারণে তার মনটা খুব ভালো।
রায়হান সাহেব বললো, তুমি কি জানো শর্মী মানুষের জীবনটা কত বিচিত্র হতে পারে। এই আমাকে দেখলে তুমি বিশ্বাসই করতে পারবে না কত নিচু থেকে আমি উঠে এসেছি। শূন্য থেকে আজ অবধি আমার যা অর্জন তা আমি পেয়েছি খুব কঠিন সময়গুলোকে পার করে। জীবনের উপলব্ধিগুলোকে গুছিয়ে উপভোগ করার সময় আমি কখনো পাইনি। কিন্তু যখন একটু একটু করে নিজের উপলব্ধিগুলোর মূল্যায়ন করতে শুরু করেছি তখন বিধাতা হয়তো সেই সুযোগ আমাকে দিতে অনিচ্ছুক। বিশ্বাস করো শর্মী আমার তাতে একটুও ক্ষোভ নেই। তুমি জোছনা দেখেছো শর্মী? জোছনা যখন চারিদিক ছড়িয়ে পড়ে তখন সবকিছু আলোকিত করে। তবে তুমি চাইলে এই আলো কখনোই ছুঁতে পারবে না। আমার উপলব্ধিগুলো এখন এই জোছনার মতো। এগুলো আমি কখনো ছুঁতে পারবো না।
শর্মী তুমি ভাবছো আমি কেন তোমাকে এত সব বলছি। আমি নিজেও জানি না কেন তোমাকে বলছি। তোমার কি মনে আছে তোমার সাথে আমার প্রথম কোথায় দেখা হয়েছিলো?
শর্মী বললো, জী স্যার। পিজি হাসপাতালে।
হ্যাঁ, ঠিক বলেছো। আমি কেন গিয়েছিলাম জান ওখানে? আমি গিয়েছিলাম কিডনী ডায়ালসিস করতে। ওখানে আমার এক ডাক্তার বন্ধু আছে যার কাছে মাঝে মাঝে কিডনী ডায়ালসিস করতে যেতে হয়। আমাকে দেখে তোমার সুস্খ মনে হতে পারে কিন্তু সত্যি হচ্ছে আমার দু’টি কিডনির মধ্যে একটি অকেজো হয়ে গেছে গত দু’মাস আগে, অন্যটিও প্রায় অকেজো হবার পথে। সব ঠিক মতো চললে আর বড় জোর ছয় মাস চলতে পারি নয়তো তারও আগে…
শর্মী বললো, কি বলছেন স্যার!
রায়হান সাহেব বললেন, অবাক হচ্ছো শর্মী? অবাক হবার কিছুই নেই। জীবনটা এমনই। তোমার নিষ্পাপ চোখ দিয়ে যে জল পড়ে তা দেখে আমি যতটুকু অবাক হয়েছি তার কিঞ্চিত পরিমাণ যদি আমার মৃত্যুর সংবাদ শুনে হতাম তাহলে মনে করতাম জীবনটা অনেক বেশি প্রয়োজন। তুমি ভয় পেয়ো না শর্মী, আমি তোমার কাছে কিছু চাইবো না। হ্যাঁ চাইতাম যদি এই পৃথিবীটা আমার জন্য আরো কিছুকাল বরাদ্দ থাকতো। চাইতাম তোমার নিষ্পাপ হাসি কান্নার সাথে আমাকে সাথী করার অধিকার। কিন্তু এখন এটা মূল্যহীন। আর তুমি এটাও মনে করো না আমি তোমাকে দয়া করে এই চাকরিটা দিয়েছি। একটু সময় নিয়ে রায়হান সাহেব আবার বলতে লাগলেন, আগামী মাসেই আমি গ্রামে চলে যাচ্ছি। গ্রামে আমার দূর সম্পর্কের এক খালা ছাড়া আপন বলতে তেমন কেউ নেই। তবে আমার মায়ের স্পর্শে সাজানো ছোট্ট ঘরটা এখনো আছে। আমি চাই বাকি কয়েকটা দিন আমি আমার মায়ের স্মৃতির স্পর্শ নিয়ে বেঁচে থাকি।
শর্মী নীরবভাবে রায়হান সাহেবের কথাগুলো শুনে যাচ্ছে। তার দু’চোখ দিয়ে অঝর ধারায় পানি ঝরছে। রায়হান সাহেব হয়তো দেখছেন শর্মীর চোখে পানি তবে তিনি এটা তেমনটা খেয়াল করছেন না। লোকটা খুব সহজ আর হাসিখুশিভাবে কথাগুলো বলে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে এটা খুব সাধারণ একটা ব্যাপার। রায়হান সাহেব বললেন, আমার এই সম্পত্তিগুলো আমার মায়ের নামে একটা ওয়েলফেয়ার ট্রাষ্ট করে দিয়ে যাচ্ছি। এখান থেকে আমার ঐ খালাটি প্রতি মাসে একটা ভাতা পাবেন যতদিন উনি বেঁচে থাকবেন। আর তোমার চাকরিটার পাশাপাশি এই ট্রাষ্টের পরিচালকদের একজন হিসেবে তুমি দায়িত্ব পালন করবে। আমি আশা করবো তুমি এতে দ্বিমত করবে না।
শর্মী কাথাটা গায়ে জড়িয়ে শুয়ে আছে। একটু একটু শীত লাগছে বলে কাথাটা গায়ে মুড়িয়ে শুয়ে থাকতে ভালোই লাগছে। এখনো ভোরের পুরোপুরি আলো ফোটেনি। তবে চারিদিক আস্তে আস্তে ঝাপসা থেকে ভেসে উঠছে। ভোরের এই সময়টা শর্মীর খুব প্রিয়। গত রাতে অফিস থেকে এসে অনেক্ষণ কেঁদেছে। শর্মী বুঝতে পারছে না লোকটার জন্য তার এতটা খারাপ লাগছে কেন? শর্মী জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকালো। আজ আকাশটা অনেক স্বচ্ছ। এক টুকরো মেঘও আকাশে দেখা যাচ্ছে না। শর্মী ভাবে মানুষের কষ্টগুলো যদি এমন স্বচ্ছ হয়ে যেত তাহলে পৃথিবীটা আরো সুন্দর হতে পারত।
আজ শর্মী একটু আগেই অফিসে আসলো। এগারোটায় রায়হান সাহেব অফিসে আসলে শর্মী তার রুমে গেল। ভেতরে ঢুকে খুব জড়োসড়ো হয়ে মাটির দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।
শর্মীকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রায়হান সাহেব বললেন, কিছু বলবে শর্মী?
শর্মী মাথা নেড়ে জবাব দিল। তারপর একটু সময় নিয়ে বললো, স্যার আজ কি আপনি আমার সাথে একটু বেরুতে পারবেন?
রায়হান সাহেব স্মিত হাসি দিয়ে বললেন, ঠিক আছে বেরুবো।
লাঞ্চের পরই দু’জন বেরুলো। শর্মী যেখানটায় এসেছে সে জায়গাটা রায়হান সাহেবের খুব পছন্দ হলো। চারিদিকে অসংখ্য গাছ। লোকজন তেমন একটা নেই। বাতাসে গাছের পাতাগুলোর আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। রায়হান সাহেব শর্মীকে বললো, তোমার প্রিয় জায়গা, তাই না?
শর্মী মাথা নেড়ে জবাব দিল, হ্যাঁ।
দু’জন একটা জায়গায় গিয়ে বসলো। যেখানে বসেছে তার সামনে ছোট্ট একটা পুকুর। পানি খুবই স্বচ্ছ। অনেকক্ষণ হলো দুজন চুপচাপ। শর্মী নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। পায়ের আঙ্গুল দিয়ে কি যেন একটা নাড়া চাড়া করছে অনেকক্ষণ।
রায়হান সাহেব নীরবতা ভাঙলেন। বললেন, কি শর্মী কিছু বলছো না যে?
শর্মীর চোখ দুটি ভিজে আসছে। তার মুখ দিয়ে কথা বের করা এখন অনেক কষ্ট হবে। তবুও ভাঙা ভাঙা গলায় বললো, আমি কি আপনার হাতটা একটু ছুবো।
রায়হান সাহেব কিছু বললেন না। হাতটা বাড়িয়ে দিলেন।
রায়হান সাহেবের একটা হাত নিজের মুঠোয় নিয়ে বাচ্চা মেয়ের মতো হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো শর্মী। রায়হান সাহেব কিছু বলছেন না। চুপ করে থাকল, অনেকক্ষণ। এক সময় বললেন, চাকরিটা তুমি ছেড়ে দিতে চাও। তাই না শর্মী?
শর্মী হ্যাঁ বলে মাথা নাড়ল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে কান্না জড়ানো কণ্ঠে বলল, আপনি আর যতদিন এই পৃথিবীর আলো স্পর্শ করবেন ততদিন আমি আপনার সাথে থাকতে চাই।
রায়হান সাহেবের পৃথিবীটার জন্য এখন খুব মায়া হচ্ছে। মায়া হচ্ছে এই নিষ্পাপ চোখের অশ্রুর জন্য। কিন্তু এটাতো হবার নয়। নিজের অতৃপ্তির উপলব্ধিগুলোর সাময়িক স্পন্দন পাওয়ার জন্য একটা নিষ্পাপ প্রাণের বিসর্জন কখনো মেনে নেয়া যায় না।
রায়হান সাহেব মনে মনে বলতে থাকেন, ভালো থেকো শর্মী। ভালো থেকো, অনেক অনেক কাল।