সাগরে চলছে জলদস্যুদের তান্ডব। আর ডাঙ্গায় চলছে চোর, ছিনতাইকারী, অপহরণকারী আর সন্ত্রাসীদের দৌরাত্ম্য। থেমে নেই ইয়াবা কারবারীদের কারসাজিও। সব মিলিয়ে কক্সবাজার জেলায় অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে পেশাদার অপরাধীরা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উদাসীনতা ও জনগণের সচেতনতার অভাবেই অপরাধীদের বেপরোয়া হয়ে উঠার মূল কারণ এমনটাই জানিয়েছেন সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা।
পর্যটন মৌসুমে সমুদ্র শহরে ছিনতাইকারীদের বিচরণ বেড়েছে বহুগুণ। মুক্তিপনের নেশায় উম্মাদ হয়ে উঠেছে অপহরণকারী চক্র। ভাড়াটে সন্ত্রাসীরাও নিয়ন্ত্রণহীন। শীত মৌসুমে শান্ত সাগরে অশান্ত হয়ে উঠেছে জলদস্যুরা। একই সাথে সমুদ্র দিয়ে ইয়াবা পাচার হচ্ছে বেপরোয়াভাবে। কোন মতেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না জেলার অপরাধী চক্রকে। আর এ মূহুর্তেই অপরাধীদের লাগাম টেনে ধরা জরুরী বলে দাবী করেছেন বিশ্লেষকরা।
সূত্র জানায়, বছরের প্রথম ২২ দিনে জেলায় খুন হয়েছে ৪ জন। একই সময়ে সাগরে কমপক্ষে ১৫ টি ট্রলারে ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। আর জলদস্যুদের গুলিতে গুলিবিদ্ধ হয় এক জেলে। আর এই ২২ দিনে উদ্ধার হয়েছে ৪৫ লক্ষ ইয়াবা । এছাড়া নানা উপায়ে ইয়াবাপাচার করতে গিয়ে ২ জনের মৃত্যু হয়েছে। তাছাড়া ছিনতাই, চুরি, অপহরণ ও ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে অগনিত।
এর মধ্যে ১৯ জানুয়ারি ৪ লক্ষ টাকা মুক্তিপনের জন্য রামুতে দুই সহোদর শিশুকে নৃশংসভাবে হত্যা করে অপহরণকারীরা। একই দিন ছিনতাই হওয়া সিএনজি উদ্ধার করতে গিয়ে সন্ত্রাসীদের গুলিতে গুলিবিদ্ধ হন জেলা তাঁতী লীগের সভাপতির ছোট ভাই। ১৬ জানুয়ারি দিনের বেলা নিজ অফিসে প্রবেশ করে শহরের আলোচিত ভ’মিদস্যু ইলিয়াছ সওদাগরকে কোপায় ভাড়াটে সন্ত্রাসীরা। ১৫ জানুয়ারি রাতে শহরের বালিকা মাদ্রাসা রোড়ে এক পর্যটককে ছুরিকাঘাত করে তার সর্বস্ব লুট করে ছিনতাইকারীরা। ওইদিন বিকালেই লাবণী পয়েন্টে ছিনতাইকারীদের কবলে পড়েছিল সদর থানার এক এসআই। পরে জনতা ওই ছিনতাইকে ধাওয়া করে গণধোলাই দেয়। ১২ জানুয়ারি শহরে রুমালিয়ারছড়া ইয়াবার টাকা ভাগাভাগি নিয়ে সংঘর্ষে আহত হয়েছে নারীসহ ৩ জন। একই দিন দুপুরে মহেশখালিতে এক এস.এস.সি পরিক্ষার্থী ছাত্রীকে অপহরণ করা হয়। অপহরণের ১৫ ঘন্টা পর এক অপহরণকারীসহ অপহৃতকে উদ্ধার করে পুলিশ। ১৩ জানুয়ারি সদর উপজেলা গেইট এলাকা থেকে ছিনতাই হয় স্বর্ণ। ৯ জানুয়ারি গভীর রাতে শহরের বিজিবি ক্যাম্প এলাকায় মসজিদ ও মন্দিরে চুরির ঘটনা ঘটে। পায়ুপথ দিয়ে ইয়াবা পাচার করতে গিয়ে ৯ জানুয়ারী টেকনাফের কঁচুবনিয়ার এক যুবক মৃত্যুবরণ করেন। এর দুদিন আগে ৭ জানুয়ারি পেটের ভেতর করে ইয়াবা পাচার করতে গিয়ে হোয়াইক্যংয়ের মোশতাক আহমেদ মারা যায়। তার একদিন আগে রামুতে বড়বিল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মো.নুরুচ্ছফাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। আর বছরের প্রথমদিন টেকনাফের শামলাপুরে প্রতিপক্ষের হাত খুন হন এক যুবক। এ বিষয়ে কক্সবাজার জেলা ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি মোয়াজ্জেম হোসাইন জানান, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী চাইলে এক ঘন্টায় সব ধরণের অপরাধীদের নির্মূল করতে পারে। কিন্তু পুলিশের সদিচ্ছার অভাবে জেলার অপরাধীরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এছাড়া জনগণকেও সচেতন হতে হবে।
কক্সবাজার জেলা বোট মালিক সমিতির সভাপতি মুজিবুর রহমান চেয়ারম্যান জানান, চলতি মাসে জলদস্যুরা সাগরে তান্ডব চালাচ্ছে। দস্যুরা কমপক্ষে কোটি টাকার মালামাল ও মাছ ডাকাতি করেছে । এছাড়া প্রতিনিয়ত তাদের আঘাতে আহত হচ্ছে জেলেরা।
এ বিষয়ে কোস্টগার্ডের কক্সবাজার কন্টিনজেন্ট কমান্ডার এম এ হাশেম জানান, অত্যাধুনিক নৌযানের অভাবে কোস্টগার্ড গভীর সমুদ্র টহল দেয় না। তারা শুধু উপকূল ও আশেপাশের জলসীমায় পাহারা দেয়। এ কারণে জলদস্যুরা সহজেই পার পেয়ে যাচ্ছে।
কক্সবাজার জেলা কমিউনিটি পুলিশের সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী জানান, সব জায়গাতেই সবসময় কমবেশী অপরাধ হয়ে থাকে। তবে ইদানিং কক্সবাজার জেলায় অপরাধীদের দৌরাত্ম্য বেড়েছে। এজন্য পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সকল সদস্যকে আরো বেশী দায়িত্বশীল হতে হবে।
কক্সবাজার সদর থানার অপারেশন অফিসার মো. আব্দুর রহিম জানান, সদর থানা পুলিশ তার দায়িত্বের প্রতি সচেতন। গত এক মাসে ৩০ জন ছিনতাইকারীকে আটক করা হয়েছে । এছাড়া বিভিন্ন মামলার পলাতক, চিহ্নিত সন্ত্রাসীসহ কমপক্ষে আরো ২৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
রামু থানার ওসি আবদুল মজিদ জানান, রামুতে কিছু দূর্গম এলাকা রয়েছে। তারপরও পুলিশের তৎপরতায় অপরাধীরা পার পায় না। শিক্ষক খুন ও দুই শিশু হত্যার ঘটনার সাথে জড়িতদের পুলিশ ২৪ ঘন্টার মধ্যে গ্রেফতার করেছে।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ফেরদৌস আলী জানান, ভৌগলিকভাবেই কক্সবাজার অপরাধ প্রবণ এলাকা। এর একদিকে রয়েছে অরক্ষিত সীমান্ত, সাগর আর অন্যদিকে দূর্গম পাহাড়ি এলাকা। এছাড়া এখানকার জনগণও সচেতন নয়।
তারপরও দু একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া কক্সবাজার জেলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি শান্ত ও স্বাভাবিক রয়েছে।