রাশেদুল মজিদ : কক্সবাজারে প্রায় ২০ কোটি টাকার চাল ক্রয়ে সীমাহীন অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে শাস্তি মূলক বদলি (ওএসডি) হওয়া কক্সবাজার জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক (চলতি দায়িত্ব) মো. তানভীর হোসেন অবশেষে কক্সবাজার ছেড়েছেন। গত বুধবার তিনি হঠাৎ করেই কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা ও এক কর্মচারীকে ডেকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে গোপনে কক্সবাজার ত্যাগ করেন। তাঁর কক্সবাজার ছেড়ে যাওয়ার বিষয়টি কাউকে জানতে দেয়া হয়নি। এমনকি খাদ্য বিভাগের দু’একজন ছাড়া কেউ বিষয়টি জানতেন না। তাঁর এভাবে কক্সবাজার ছেড়ে যাওয়ার ঘটনায় খাদ্য বিভাগে নানা আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। এর আগে গত মধ্য অক্টোবরে কক্সবাজারে প্রায় ২০ কোটি টাকার চাল ক্রয়ে সীমাহীন অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে শাস্তি মূলক বদলি হিসেবে তাকে ওএসডি করে খাদ্য অধিদপ্তরে সংযুক্ত করা হয়। কিন্তু এরপরও নানা তালবাহানায় তিনি গত তিন মাস ধরে কক্সবাজার জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের পদ আটকে ছিলেন। অবশেষে গত বুধবার উধ্বর্তন কর্তৃপক্ষের চাপের মুখে তিনি অনেকটা গোপনেই কক্সবাজার ছেড়ে যান। যোগদানের মাত্র সাড়ে তিন মাসের মাথায় অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে এ খাদ্য কর্মকর্তাকে শাস্তিমূলক বদলি করা হয়। চাকরিতে সদ্য যোগ দেয়া এ কর্মকর্তাকে যোগ্য না হলেও শুণ্যতা পূরণে জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক পদে পদায়ন করে গত ২৬ জুন কক্সবাজার পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু তাঁর অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে কক্সবাজারে ৮৪৯২ মেট্রিক টন চাল ক্রয়ে সরকারের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও ২১৬৩ মেট্রিক টন চাল ক্রয় অবশিষ্ট রেখেই ক্রয় কার্যক্রম বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক ও জেলা খাদ্যশস্য সংগ্রহ কমিটির সভাপতি মো. আলী হোসেন। গত ২ সেপ্টেম্বর জেলা খাদ্যশস্য সংগ্রহ কমিটির সভায় সংগ্রহ নীতিমালা লঙ্ঘন করে চাল ক্রয়ের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। সভার সিদ্ধান্ত মতে, জেলা প্রশাসক ও জেলা খাদ্যশস্য সংগ্রহ কমিটির সভাপতি মো. আলী হোসেন অবশিষ্ট ২১৬৩ মেট্রিক টন চাল অন্য জেলা থেকে ক্রয়ের জন্য নীতিমালা শিথিল করতে খাদ্য অধিদপ্তরে চিঠি লিখেন। কিন্তু তা অনুমোদন করা হয়নি। এ অবস্থায় ক্রয় করা ৬৩২৯ মেট্রিক টন চাল ক্রয়ে সংগ্রহ নীতিমালা লঙ্ঘন করে প্রায় ৬ কোটি ৯৬ লাখ ১৯ হাজার টাকা লোপাট করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠে জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো. তানভীর হোসেনের নেতৃত্বে গড়ে উঠা সিন্ডিকেটটির বিরুদ্ধে। ‘কোটিপতি ডিসিফুড’ হিসেবে নিজেকে পরিচয়দানকারী এ কর্মকর্তা চাল ক্রয়ের দুর্নীতির টাকায় প্রতি সপ্তাহেই বিমানে ঢাকা আসা-যাওয়া করতেন। এ প্রসঙ্গে কক্সবাজার সদর উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো. শাহ জামাল গতকাল সকালের কক্সবাজারকে বলেন, ‘গত বুধবার ডিসি ফুড স্যার (জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক) আমাকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে কক্সবাজার ত্যাগ করেন। তিন মাস আগেই তিনি বদলি হয়েছিলেন।’
এদিকে শত শত বঞ্চিত কৃষকের পক্ষে আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী মুক্তিযোদ্ধা মোজাফ্ফর আহমদ বলেন, ‘শুধু ওএসডি করেই এসব দুর্নীতিবাজদের বাঁচিয়ে দেয়ার চেষ্টা চলছে। এ ধরণের দুর্নীতিবাজদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় নিয়ে আসা উচিত।’ তাঁর শাস্তির দাবী করে দ্রুত সংশ্লিষ্ট দপ্তরে আবেদন জানানো হবে বলেও তিনি জানান।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, সারা দেশের ন্যায় কক্সবাজার জেলায় বোরো (আতপ) চাল সংগ্রহ কার্যক্রমের আওতায় মোট ৮ হাজার ৪৯২ মেট্রিক টন চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। গত ১ আগষ্ট থেকে চাল ক্রয় শুরু হয়। কিন্তু সরকারের চাল ক্রয়ে সীমাহীন অনিয়ম-দুর্নীতির আশ্রয় নেন স্বয়ং জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো. তানভীর হোসেনের নেতৃত্বে একটি সিন্ডিকেট। গত ১০ আগষ্ট থেকে জেলায় খাদ্যশস্য সংগ্রহে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা লুটপাটের অভিযোগে তথ্য ভিত্তিক ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে দৈনিক সকালের কক্সবাজার। এর প্রেক্ষিতে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক ও জেলা খাদ্যশস্য সংগ্রহ কমিটির সভাপতি মো. আলী হোসেন তা তদন্তের নির্দেশ দেন। এর মধ্যে গত ১৯ আগষ্ট বুধবার বিকালে কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের নিবার্হী ম্যাজিষ্ট্রেট সোহাগ চন্দ্র সাহা রামু খাদ্য গুদামে অভিযান চালিয়ে ৪৩ মেট্রিক টন চালসহ দুটি ট্রাক জব্দ করে। সরকারের সংগ্রহ নীতিমালা লঙ্ঘন করে উত্তরাঞ্চল থেকে নি¤œমানের এসব চাল প্রতি কেজি ১৯/২০ টাকা দরে ক্রয় করে তা প্রতি কেজি ৩১ টাকা দরে খাদ্য গুদামে সরবরাহের জন্য আনা হয়েছিল। এভাবে রামু খাদ্য গুদামে ২০৬০ মেট্রিক টন চাল মজুদ করা হয়েছে। আর জেলার ৬টি খাদ্য গুদামে ক্রয় করা হয়েছে ৬৩২৯ মেট্রিক টন চাল। নি¤œমানের কম দামের এসব চাল বেশি মূল্যে ক্রয় দেখিয়ে প্রায় ৬ কোটি ৯৬ লাখ ১৯ হাজার টাকা লোপাট করেছে জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো. তানভীর হোসেনের নেতৃত্বে গড়ে উঠা সিন্ডিকেটটি।
সূত্র জানিয়েছে, বোরো (আতপ) চাল সংগ্রহ কার্যক্রমের আওতায় কক্সবাজার জেলায় ৮ হাজার ৪৯২ মেট্রিক টন চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। এর মধ্যে কক্সবাজার সদর উপজেলায় ৫৩৩ মেট্রিক টন, চকরিয়ায় ৩৫০ মেট্রিক টন, পেকুয়ায় ৩৫৪ মেট্রিক টন, মহেশখালীতে ২০৯ মেট্রিক টন, রামুতে ৩০৭৬ মেট্রিক টন, উখিয়ায় ৩৪৭২ মেট্রিক টন ও টেকনাফে ৪৯৮ মেট্রিক টন। এসব চাল সরবরাহের জন্য কক্সবাজার জেলার ২২ জন রাইচ মিল মালিকের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয় কক্সবাজার জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়। গত ১ আগষ্ট থেকে নির্ধারিত পরিমান চাল সংগ্রহ শুরু হয়। কিন্তু জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো. তানভীর হোসেন ও অফিস সহকারী রোকসানার যোগসাজসে সংশ্লিষ্ট উপজেলা খাদ্য গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক, খাদ্য পরিদর্শক, কক্সবাজারের শীর্ষ কালোবাজারি তাজরেজা ফ্লাওয়ার মিলের ম্যানেজার সাগর-রফিক, শহরের চাউলবাজারের এসবি এন্টারপ্রাইজের বুলবুল ও উখিয়ার আবদুর রহিমের সাথে সিন্ডিকেট করে খাদ্য গুদাম গুলোতে ময়মনসিংহ, বগুড়া, গাইবান্ধাসহ উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলা থেকে আনা নি¤œমানের কম দামের চাল মজুদ করা হয়। এসব বিষয়ে দৈনিক সকালের কক্সবাজার পত্রিকায় তথ্য ভিত্তিক সংবাদ প্রকাশের পর কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক ও জেলা খাদ্য শস্যসংগ্রহ কমিটির সভাপতি মো. আলী হোসেন তা তদন্তের নির্দেশ দেন। কিন্তু খাদ্য বিভাগের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা জেলা প্রশাসকের নির্দেশের তোয়াক্কা না করে নীতিমালা লঙ্ঘনের মাধ্যমে খাদ্য গুদাম গুলোতে দেদারছে নি¤œমানের চাল মজুদ অব্যাহত রাখে। ১৯ আগষ্ট বিকালে জেলা প্রশাসকের নির্দেশে নিবার্হী ম্যাজিষ্ট্রেট সোহাগ চন্দ্র সাহা রামু খাদ্য গুদামে অভিযান চালিয়ে ৪৩ মেট্রিক টন চালসহ দুটি ট্রাক জব্দ করে। চট্রগ্রাম আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো. আনিসুজ্জামানও রামু খাদ্য গুদাম পরিদর্শন করে নানাবিধ জটিলতায় সংগ্রহ কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে জানিয়ে লক্ষ্যমাত্রার অবশিষ্ট বরাদ্দ বিভাগে সমর্পনের কথা বলেন।
সূত্র জানিয়েছে, গত ১৯ আগষ্ট নিবার্হী ম্যাজিষ্ট্রেট সোহাগ চন্দ্র সাহা ঢাকা মেট্রো-ট-১৮-৬৬২৭ ট্রাকে ২৩০০০ কেজি (৪৬০ বস্তা) এবং যশোর-ট-১১-২৬৮৮ ট্রাকে ২০০০০ কেজি (৪০০ বস্তা) চাল ভর্তি দু’টি গাড়ি জব্দ করেন। জিজ্ঞাসাবাদে গাড়ির চালক ও হেলপাররা জানান, রামু খাদ্য গুদামের জন্য জনৈক ব্যক্তি (নাম জানে না কিন্তু মোবাইল নং দেয়া হয়েছে -০১৭৯৬৪৯১৭৩৯ এবং ০১৮১৯৭৪৯৪২৮) গাইবান্ধা থেকে ২৩ মেট্রিক টন ও ময়মনসিংহ থেকে ২০ মেট্রিক টন চাল নিয়ে আসেন। জব্দকৃত চালের বস্তাগুলোতে ‘খাদ্য অধিদপ্তরের জন্য-উৎপাদন এপ্রিল/২০১৫, নীট ওজন ৫০ কেজি, ষ্টার আলকায়েদ জুট মিলস লিঃ’ এবং মা-মনি অটো রাইচ মিল, গর্জনিয়া বাজার, রামু, ২০১৫’ নামে সীলমোহরযুক্ত লেখা রয়েছে। ওই সময় ঢাকা মেট্রো-ট-১৮-৬৬২৭ গাড়ির চালক আবিদুরের নামে জব্দকৃত চালের একটি চালানও জব্দ করা হয়। চালানটিতে লেখা রয়েছে, ‘মেসার্স এম.বি. ট্রেডার্স, ডি.বি.রোড, গাইবান্ধা। ড্রাইভার-আবিদুল, শাহজাহানপুর বগুড়া, ট্রাক মালিক-মো. সাইফুল ইসলাম, শাহজাহানপুর বগুড়া। চালের পরিমান ২৩০০০ কেজি, ট্রাক ভাড়া-৩৭৯৫০ টাকা।’ এসব চালের প্রতি কেজি মূল্য দেখানো হয়েছে ২০ (বিশ) টাকা। বর্তমানে এ সংক্রান্ত একটি মামলার তদন্ত চলছে। ঘটনার সময় উপস্থিত সরকারী কর্মকর্তা, ঘটনায় সংশ্লিষ্ট সরকারী কর্মকর্তা, রাইচ মিল মালিক, প্রত্যক্ষদর্শীসহ প্রায় সকলের সাথে কথা বলছেন তদন্তকারী কর্মকর্তা। এছাড়া কক্সবাজার সচেতন নাগরিক আন্দোলন নামের একটি সংগঠন এবং কৃষকদের পক্ষে মুক্তিযোদ্ধা মোজাফ্ফর আহমদ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, খাদ্য মন্ত্রণালয়, খাদ্য অধিদপ্তর, দুর্নীতি দমন কমিশনসহ বিভিন্ন দফতরে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন। এসব অভিযোগের প্রেক্ষিতে সরকারের একটি প্রভাবশালী গোয়েন্দা সংস্থা এবং বিভিন্ন দফতর অনিয়ম-দুর্নীতির ঘটনা তদন্ত করছে।