কক্সবাজার রিপোর্ট : বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরতে গিয়ে জেলেরা ব্যাপক হারে হাঙর শিকার করছেন। বড় হাঙরের পাশাপাশি বাচ্চা হাঙরও মারা হচ্ছে। কক্সবাজার বঙ্গোপসাগরে অবৈধভাবে হাঙর শিকারে মেতে উঠেছেন উপকূলীয় অঞ্চলের জেলেরা। বাণিজ্যিকভাবে হাঙ্গর শিকার বেড়ে যাওয়ায় সামুদ্রিক এই প্রাণীটির সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে হ্রাস পাচ্ছে।
জেলার শুঁটকি ব্যবসায়ীদের কাছে অন্য মাছের তুলনায় হাঙর শুঁটকি অত্যন্ত লাভজনক এবং জেলেরা কোনো ভোগান্তি ছাড়াই বেশি দামে বিক্রির সুযোগ পায় বলে হাঙর শিকার থামছেই না। নির্বিঘেœ হাঙর নিধন করে স্থানীয় পর্যায়ে শুঁটকি তৈরি করা হচ্ছে। আর এ কারণে উপকূল ও এর আশেপাশের জেলেরা মাছের পরিবর্তে শুধু হাঙর শিকারের নেশায় মেতে উঠেছেন। ফলে বিপন্ন হতে চলেছে সমুদ্রচারী হাঙর। এ হাঙর দিয়ে তৈরি শুঁটকি, পাখা, তেল, কান, দাঁত ও লেজ বিক্রি করে আর্থিকভাবে অধিকতর লাভবান হওয়ার সুযোগ থাকায় মাছ শিকারের বদলে তারা হাঙর শিকার করছেন। কক্সবাজার সংলগ্ন বঙ্গোপসাগরে আবারও হাঙর শিকারের উৎসবে মেতে উঠেছেন জেলেরা।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, হাঙ্গরের পাখার স্যুপ অত্যান্ত জনপ্রিয় হওয়ায় আর্ন্তজাতিক বাজারে এর চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। চীনা সম্প্রদায়গুলোতে হাঙ্গরের পাখার স্যুপ বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোর তুলনায় সবচেয়ে বেশি। এ কারণে হাঙ্গরের পাখাগুলো মূল্যবান এবং এর দাম বেশি থাকায় মৎস আহরণকারীদের কাছে হাঙ্গর একটি মূল্যবান শিকারে পরিনত হয়েছে।
জেলেদের তথ্যানুসারে, জেলের মাছ শিকারের পাতানো ফাঁদে গত এক মাস ধরে হাঙর ধরা পড়ায় জেলেরা মাছ ধরতে আর আগ্রহী হচ্ছেন না ! তার পরিবর্তে তারা শুধু হাঙর শিকারের নেশায় মেতে উঠেছেন। মাছ শিকারি ও শুঁটকি ব্যবসাযীদের প্রস্তুতির যেন শেষ নেই। প্রতিটি মাছ ধরার ট্রলারের জেলেরা অধির আগ্রহে হাঙর শিকার করে শুঁটকিপল্লীতে বিক্রির জন্য নিয়ে আসছেন। প্রতিদিন সন্ধ্যা থেকে বেচাকেনা শুরু হয় আর চলে রাত প্রায় ১২টা পর্যন্ত। এরপর সারা রাত ধরে চলে হাঙর কেটে মাচায় ওঠানোর পালা। এসব হাঙর রোদে শুকিয়ে শুঁটকি করতে ৪ থেকে ৫ দিন সময় লাগে বলে সংশিষ্ট শুঁটকি পল্লীর শ্রমিকরা জানিয়েছেন।
শহরের পেস্কার পাড়ার ট্রলার মাঝি আবু তাহের জানান, সাগরে এখন হাঙরের বাচ্চা ছাড়া তেমন কোনো মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। গত বারের তুলনায় এবার সাগরে অনেক বেশি হাঙর ধরা পড়ছে এবং হাঙ্গরের দাম বর্তমান বাজারে তুলনা মূলক বেশি।
নুনিয়ার ছরার জেলে মো: বাবুলসহ কয়েকজন জেলে জানান, হাঙর শিকারের জন্য বিভিন্ন ধরনের জাল ব্যবহার করা হয়। সমুদ্রের তলদেশের পানির তাপমাত্রা কমে গেলে হাজার হাজার হাঙর ঝাঁক বেঁধে পানির উপরিভাগে খাদ্যের সন্ধানে চলে আসে। এ সময় বিশেষ এক ধরনের জাল দিয়ে জেলেরা এ সব হাঙর শিকার করেন। ছোট হাঙর জালে আটকা পড়ার ২ থেকে ৩ ঘণ্টার মধ্যে মারা যায়। এ ছাড়া উপকূলে আসার আগে শিকার করা হাঙর সাধারণত পচে যায় না। এর ফলে বরফ কেনার দরকারও পড়ে না। সে কারণেই জেলেরা হাঙর শিকারের দিকেই বেশি আগ্রহ দেখান।
আড়ৎদার ও শুঁটকি ব্যবসায়ীদের সূত্র মতে, তারা ছোট ১০০ পিস হাঙর ২ হাজার থেকে সাড়ে ৩ হাজার টাকায় কেনেন। হাঙরের আকৃতি ছোট থাকায় প্রতি কেজিতে এর সংখ্যা হয় ৪ থেকে ৫টি। তবে, বড় হাঙর কিনছেন মণ হিসেবে। প্রতি মণ হাঙরের দাম ৩০ থেকে ৫০ হাজার টাকা। এরপর শিকার করা হাঙর দিয়ে শুঁটকি বানিয়ে ঢাকাসহ দেশ–বিদেশ ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকায় বিক্রি করছেন। আড়তের শ্রমিকরা হাঙরের মাথা, পাখা, লেজ, কান ও দাঁত কেটে রাখে। একেকটি হাঙরের ওজন ৪০ থেকে ৭৫ কেজি পর্যন্ত হয়। হাঙরের মাথা, দাঁত ও চামড়া তুলে খুচরাবাজারে বিক্রি করে।
শুঁটকি ব্যবসায়ী আব্দুল মোনাফ জানান, হাঙরের তেল আলাদাভাবে বিক্রি হয়। আর কান প্রতিমণ ২৫ থেকে ৩৫ হাজার টাকা, তেল প্রতিমণ ৮ হাজার টাকা ও দাঁত প্রতিমণ ৪ থেকে ৫ হাজার টাকায় বিক্রি করা হয়।
প্রসঙ্গত, সমুদে অবৈধভাবে হাঙর শিকার করা হচ্ছে। এ বিষয়ে সরকারী, আধা সরকারী বা ব্যাক্তি মালিকানাধিন কোনো সংস্থার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
তবে, মাছের আড়ৎগুলো থেকে সরকার রাজস্ব আদায় করলেও সংশ্লিষ্ট বিভাগ সমুদ্রে অবৈধ কর্মকান্ডের বিষয়ে কোনো দেখভাল্ করছে না।
ফলে, সামুদ্রিক জীববৈচিত্র ও পরিবেশ হুমকির মুখে পড়ছে বলে মৎস্য বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। সামুদ্রিক জীববৈচিত্রের মধ্য হাঙর অন্যতম। ধারাবাহিক হাঙর নিধন হলে হুমকির মুখে পড়বে পরিবেশ। না বুঝে আমরা সাময়িক লাভের লোভে হাঙ্গরের অনেক প্রজাতি আজ বিলুপ্তির আশঙ্কার মুখে। হাঙ্গর না থাকলে যে নিজেদেরও ক্ষতি তা মানুষ যত তারাতারি বুঝবে ততই মঙ্গল।
হাঙর শিকার বন্ধে এখনও সুনির্দিষ্ট কোনো আইন হয়নি। তবে, পরিবেশ রক্ষার্থে ও সমুদ্রের ভারসাম্য রক্ষায় শিগগিরই একটি নীতিমালা চূড়ান্ত করা প্রয়োজন।