একসময় আওয়ামী লীগের জেলা সভাপতিরা প্রায় সবাই ছিলেন নিজ নিজ জেলায় সর্বজনশ্রদ্ধেয়। নির্লোভ সেই নেতারা রাজনীতির জন্য শুধু ত্যাগই করেছেন। কালক্রমে পাল্টে গেছে সেই রাজনীতির চিত্র। সর্বশেষ টানা সাত বছর দল ক্ষমতায়, তাই আওয়ামী লীগের জেলা নেতাদের সংগঠনের চেয়ে অন্যদিকেই মনোযোগ বেশি। কমপক্ষে দুই ডজন নেতা ক্ষমতা ভাগাভাগি ও নিজেদের আখের গোছানোয় ব্যস্ত। সরকারি-বেসরকারি জমি দখল থেকে শুরু করে জেলার সব ব্যবসা-বাণিজ্য ও নিয়োগের একচ্ছত্র আধিপত্য নিজেদের মধ্যে করে নিয়েছেন ভাগবাটোয়ারা। অন্যগুলোতে এ দুই পদের রাজনীতিকদের নাম ব্যবহার করে অহরহই হচ্ছে দখল, তদবির, টেন্ডারবাজি ও চাঁদাবাজি। টানা দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর এসব ক্ষেত্রে এসেছে বেপরোয়া ভাব। দেখে বা শুনেও তারা কিছু বলছেন না বা বলতে পারছেন না। অবশ্য বেশকিছু জেলায় সংগঠনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের চেয়ে ক্ষমতাসীন হয়ে বসেছেন হাইব্রিড নেতারা। তারা নিজেদের মতো করে চলছেন। তোয়াক্কা করছেন না এতদিনের ত্যাগী রাজনীতিকদের। বেশির ভাগ জেলায় তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের চেয়ে এখন কদর বেশি সুযোগসন্ধানীদেরই। এমপিদের মাধ্যমে তারাই ছড়ি ঘোরাচ্ছেন জেলা আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের ওপর। বাংলাদেশ প্রতিদিনের সারা দেশের নিজস্ব প্রতিবেদক, ব্যুরো ও জেলা প্রতিনিধি এবং স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের দেওয়া তথ্য থেকে এ চিত্র উঠে এসেছে। জানা যায়, ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক মত্স্য ও প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী আবদুল হাই এমপি নিজের নামে কোনো ব্যবসা-বাণিজ্য না থাকলেও অভিযোগ আছে যে, তিনি তার পিএস জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুল হাকিমকে দিয়ে বিভিন্ন ব্যবসা-বাণিজ্য করান। ইতিমধ্যে তার পিএস হাকিম খুলনা বিভাগের শ্রেষ্ঠ করদাতা হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সদর পৌর মেয়র সাইদুল করিম মিন্টুও পরিবহন ও ঠিকাদারি ব্যবসার মাধ্যমে যথেষ্ট অর্থবিত্তের মালিক। তিনি জেলা বাস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক। জেলা আওয়ামী লীগের আরেক সাংগঠনিক সম্পাদক মাহমুদুল ইসলাম ফোটন দল ক্ষমতায় আসার পর আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন। পিতার নামে অর্ধশত কোটি টাকা ব্যয়ে গড়ে তুলেছেন বিলাসবহুল মকবুল প্লাজা।
নেত্রকোনা জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মতিয়র রহমান খানের বিরুদ্ধে অভিযোগ জমি দখল করে নির্মিত স্থাপনায় সমাজকল্যাণের নামে প্রতিষ্ঠান চালানোর। আবার তার দুই ছেলে জেলা পরিষদের কাইলাটি বাজারের মার্কেট দখল করে ভাড়া আদায় করছেন। রেল স্টেশন এলাকায় সরকারি জায়গার দখল বিক্রিও করেছেন তারা। জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক সাবেক এমপি আশরাফ আলী খান খসরুর অনুগতরা তার নাম ব্যবহার করে ইতিমধ্যেই চাকরি বাণিজ্য, ঘুষ বাণিজ্যসহ দখল বাণিজ্যে অনেক বিত্তবৈভবের মালিক হয়েছেন। মালিক না হয়েও বৈধ চালকল মালিকদের মতোই সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন অনেকে। মাদারীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাহাবুদ্দিন মোল্লার বিরুদ্ধে সরকারি সম্পত্তি দখল করে মার্কেট নির্মাণের অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়াও প্রভাব খাটিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ঠিকাদারি কাজ বাগিয়ে নেওয়ার অভিযোগও উঠেছে তার নামে। সাধারণ সম্পাদক কাজল কৃষ্ণ দের একক নিয়ন্ত্রণে রয়েছে সরকারি টেন্ডার। দল ক্ষমতায় আসার আগে টিনশেড বাড়িতে বসবাস করা কাজল কৃষ্ণ এখন বহুতল ভবন বানাচ্ছেন।
মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি দিয়ে চলা ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ধর্মমন্ত্রী প্রিন্সিপাল মতিউর রহমান। তার দখলে আছে শহরের নাটক ঘর লেন রোডের আলমগীর মনসুর মিন্টু মেমোরিয়াল কলেজের প্রিন্সিপালের জন্য নির্ধারিত বাড়িটি। একসময় তিনি এই কলেজের প্রিন্সিপাল হিসেবে বর্তমানে ৪ কোটি টাকার বাড়িটিতে উঠেছিলেন। সেই বাড়ির দখল আর ছাড়েননি। মন্ত্রী বয়স্ক এবং তাকে সরকারি কাজে থাকতে হয় ব্যস্ত, সেই সুযোগে তার ব্যক্তিগত এক কর্মকর্তা হয়ে উঠেছেন জেলায় প্রতাপশালী। বাগেরহাট জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাবেক প্রতিমন্ত্রী ডা. মোজাম্মেল হোসেন এমপি। তিনি এখন একটি সংসদীয় কমিটির সভাপতি। মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে নিজের ও শিক্ষক ছেলের ঢাকা, খুলনা ও বাগেরহাট শহরে তিনটি বিলাসবহুল বহুতল ভবন নির্মাণ নিয়ে এলাকায় রয়েছে নানান সমালোচনা। তৃণমূলের কর্মীদের অভিযোগ, নিজ দলেও কেউ তার বিরুদ্ধে মুখ খুললে ক্যাডার ও পুলিশ দিয়ে শক্ত হাতে দলের নেতা-কর্মীদের দমন করেন; এ বিষয়ে তার জুড়ি মেলা ভার। এ ছাড়া অনুসারী ক্যাডারদের দিয়ে নিজ দলের নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা-মামলা, আটক ও এলাকাছাড়া করা এবং বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে টাকার বিনিময়ে জামায়াত-শিবির ক্যাডারদের চাকরি দেওয়ার অভিযোগও আছে। বছরের পর বছর ধরে সাইন বোর্ড-মোরেলগঞ্জ-শরণখোলা নামের একটি মাত্র আঞ্চলিক মহাসড়কের কাজই তিনি শেষ করাতে পারেননি। জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক শেখ কামরুজ্জামান টুকু এখন জেলা পরিষদের প্রশাসক। এক সংবাদ সম্মেলনে তার বিরুদ্ধে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের জমি দখল করে চিংড়ি ঘের করার অভিযোগ করেছেন রামপাল-মংলা কৃষি জমি রক্ষা কমিটির আহ্বায়ক ও কমিউনিটি লিডার সুশান্ত কুমার দাস। রংপুরে দল গোছানোর চেয়ে তদবিরবাজিতে বেশি ব্যস্ত জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি-সম্পাদকরা। জেলা কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মমতাজ উদ্দিন আহমেদ জেলা পরিষদ প্রশাসক পদে নিয়োগ পাওয়ার পর দলীয় কাজে খুব একটা সময় দেন না। মহানগর কমিটির সভাপতি সাফিউর রহমান সফি আগে ছোটখাটো ব্যবসা করলেও পদ পাওয়ার পর ঠিকাদারিতে নাম লিখিয়েছেন। তার নামে সরকারি অফিসে চলছে দাপট দেখিয়ে কাজ বাগানো। মহানগর সাধারণ সম্পাদক তুষারকান্তি মণ্ডল দল ক্ষমতায় আসার পর ওএমএস ডিলারশিপ নিয়েছেন এবং বানিয়েছেন পাঁচতলা বিলাসবহুল বাড়ি। বরগুনা আওয়ামী লীগের সভাপতির নাম ব্যবহার করে বরগুনা, আমতলী ও তালতলীতে চলছে চাঁদা আদায় ও দখলবাজি। জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর কবিরের কাছে জিম্মি হয়ে আছেন ব্যবসায়ীরা। প্রায় ৪০ বছর ধরে দখল করে আছেন বরগুনা চেম্বার অব কমার্স। তার ভয়ে সাধারণ ব্যবসায়ীরা কোনো প্রতিবাদ করতে পারছেন না। চেম্বার অব কমার্সের জমি ও ভবন তার নিজের নামে দলিল করার অভিযোগ রয়েছে।
মেহেরপুরে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে এমপি হয়েছিলেন আগে ঢাকায় শিক্ষকতা করা ফরহাদ হোসেন। পরে গত বছর তিনি হন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ— দলকে নয়, নিজের পরিবারকে প্রতিষ্ঠিত করতে তিনি ব্যস্ত। তাই দলীয় কমিটি ও সাবেক সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকরা এখন কোণঠাসা। দল পরিচালনার ক্ষেত্রে ভগ্নিপতি ও জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আবদুস সামাদ বাবলু বিশ্বাস মুখ্য ভূমিকায়। তার ইশারায় এখন দল ও দলের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠন পরিচালিত হচ্ছে। জেলার উন্নয়ন কর্মকাণ্ড থেকে শুরু করে সবকিছুই পরিচালিত হয় তার মতামতের ভিত্তিতে।
ঠাকুরগাঁওয়ে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি দবিরুল ইসলামের বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসার সিন্ডিকেট, ভূমি দখল, টেন্ডারবাজি, সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজে জড়িত থাকার সুস্পষ্ট অভিযোগ আছে। চা-বাগান করেছেন হিন্দু সম্প্রদায়ের জমির ওপর। চেষ্টা করেছেন শ্মশানের জমি দখলেরও। জেলা ছাত্রলীগের দুটি গ্রুপের একটির নিয়ন্ত্রণ তার হাতে। তারা করছে নানা রকম অপরাধমূলক কাজ। নাটোরে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম শিমুল এমপির বিরুদ্ধে রয়েছে নানান অভিযোগ। তার ভগ্নিপতি মীর আমিনুল ইসলাম জাহান এবং এমপির ব্যবসার অংশীদার আশফাকুল ইসলাম বর্তমানে করছেন ৩০০ কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ। এ ছাড়া নিজ দলের বিপক্ষ গ্রুপ ও বিরোধী রাজনৈতিক পক্ষকে শায়েস্তার জন্য তার নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী রয়েছে। এ বাহিনীর সন্ত্রাস, হামলা, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ভূমি দখল, মাদক ও অস্ত্র ব্যবসা, অপহরণের মতো কুকাজ এখন ওপেনসিক্রেট। নিয়োগ বাণিজ্য, বদলি বাণিজ্য, পদোন্নতি, ডিও বাণিজ্য করে কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে সুযোগসন্ধানীরা।
কুষ্টিয়া জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি সদর উদ্দিন খানের বিরুদ্ধে রয়েছে টেন্ডারবাজি ও চাল-গম সংগ্রহ অভিযান থেকে কমিশন আদায়সহ নানা অপকর্মের অভিযোগ। গত মেয়াদে তার রোষানলে পড়ে খোকসা উপজেলার শ্যামনগর এলাকার বেশ কিছু হিন্দু পরিবার দেশত্যাগ করে ভারতে চলে যেতে বাধ্য হওয়ার অভিযোগ এলাকার সবারই জানা।
পাবনা জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি শামসুর রহমান শরীফ ডিলু এমপি এখন ভূমিমন্ত্রী। তার নিকটাত্মীয়রা মন্ত্রীর নাম ব্যবহার করে টেন্ডার, জমি দখল ও নিয়োগ বাণিজ্য চালাচ্ছে প্রকাশ্যেই। জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম ফারুক প্রিন্স এমপির অনুসারীরা আরও একধাপ এগিয়ে। এ কারণে গত কয়েক বছরে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর, পানি উন্নয়ন বোর্ড ও শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরে দলীয় নেতা-কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে বেশ কয়েকবার। জয়পুরহাট আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এস এম সোলায়মানের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগের চিহ্নিত ৮ থেকে ১০ জন নেতা-কর্মীর দ্বারা চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, নিয়োগ বাণিজ্য, চোরাকারবারি, অবৈধ দখলদারি, সরকারি অফিস ও থানায় থানায় তদবির বাণিজ্য, সরকারি শত শত গাছ লুটের অভিযোগ রয়েছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল ওদুদ এমপির বিরুদ্ধে সরাসরি তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো অভিযোগ নেই। কিন্তু ঘনিষ্ঠজনরা তার নাম ব্যবহার করে টেন্ডারবাজি ও সন্ত্রাসী কাজে জড়িত। ভয়ে কেউ এ নিয়ে অভিযোগ করেন না।