কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানের ভাষায় ‘মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা/ অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা।/ রসের আবেশ রাশি/ শুস্ক করে দাও আসি/ মায়ার কুজঝটিকাজাল যাক দূরে যাক … এসো, এসো, এসো, হে বৈশাখ।’
অপ্রাপ্তি ও বেদনাকে ধুয়ে মুছে, আকাশ-বাতাস ও প্রকৃতিকে অগ্নিস্নানে সূচি করে তুলতেই আবার এসেছে বৈশাখনতুন স্বপ্ন, উদ্যম ও প্রত্যাশার আলোয় রাঙানো নতুন বাংলা বছর। স্বাগত ১৪২৩।
গ্লানিময় অতীতকে ভুলে যাবার এক সহজাত প্রয়াসের মধ্যদিয়ে দুয়ারে এসেছে ১৪২৩ বঙ্গাব্দ। আজ বৃহস্পতিবার পহেলা বৈশাখ।
গতকাল পশ্চিম দিগন্তে ১৪২০ বঙ্গাব্দের শেষ সূর্য অস্তমিত হয়। নতুন ভোরে নতুন আশা ও স্বপ্ন নিয়ে নতুন দিন ও বছরের যাত্রা শুরু । পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে আজ জাতীয় ছুটির দিন। এদিকে বর্ষবরণের সকল প্রস্তুতি গতকালই সম্পন্ন হয়েছে। নববর্ষ উদযাপন নির্বিঘ্ন করতে নেয়া হয়েছে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা।
নববর্ষে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম সমাজের জঞ্জাল সরাতে ঘোষণা করেছেন নতুনের মহত্তম আহবান ‘ঐ নতুনের কেতন ওড়ে…. তোরা সব জয়ধ্বনি কর’। রেনেসাঁর কবি ফররুখ আহমদ বাংলা নববর্ষকে দাওয়াত করেন আরো প্রত্যয়মগ্ন হয়ে গভীর আকুলতায় ‘অগণ্য অসংখ্য বাধা ওড়ায়ে হয় প্রবল কণ্ঠে। তুলি পুরুষ হুংকার, হে বৈশাখ এসো…।’ পহেলা বৈশাখ, কেবল জ্যোতির্বিদ্যা নিরুপিত পৃথিবী আহ্নিক গতির ওপর নির্ভরশীল একটি দিন তা নয়। আমাদের জীবনে চেতনা এবং স্বকীয় সংস্কৃতির পরিচয়ও বটে।
আবহমান বাংলার এক চিরন্তন রূপ নিয়ে বৈশাখের আগমন ঘটে সারা বাংলায়। প্রকৃতির ধূলিধূসর কিংখহবের আবরণটুকু বৈশাখের তুমুল হাওয়া উড়িয়ে নেয় দূরে বহুদূরে। পুরনো জীর্ণতাকে মুছে দিয়ে নিসর্গের ক্যানভাসে অঙ্কিত করে এক নবজাগরণের, নতুন স্বপ্নের দিনলিপি। বাঙালী সংস্কৃতির প্রতিটি স্তবকে রয়েছে ঐতিহ্যের ধারক বৈশাখের অফুরন্ত ছোঁয়া। যে ছোঁয়ায় উজ্জীবিত হয়ে ওঠে মন আর দৈনন্দিন জীবন। আকাশে থমকানো মেঘের টুকরোর মতো উচ্ছ্বাস যেন বাংলা নববর্ষের বর্ষবরণে ভিন্ন এক মাত্রা নিয়ে উন্মোচিত হয়। যার ছাপ পড়ে জীবনের প্রতিটি স্পন্দনে, ছন্দে। ব্যবসা-বাণিজ্য, পোশাক-পরিচ্ছদ, খাওয়া-দাওয়া, জীবনাচার, চাষাবাদ থেকে শুরু করে প্রতিটি পঙ্ক্তিতে পহেলা বৈশাখের ছাপ লক্ষ্য করা যায় নতুন বর্ষের সূচনা লগ্ন থেকে।
এই বৈশাখকে ঘিরে যেমন সমগ্র বাংলার পথেপ্রান্তরে নতুন ফসলের তরঙ্গবীথির দুলুনি মনকে প্রসন্ন করে তোলে। একই ভাবে চোখে পড়ে বাঙালী মানসের উচ্ছ্বাস। সেই তরঙ্গ বৈশাখী উৎসবে মেতে উঠে যেন সারা বাংলার পল অনুপল। বৈশাখের রঙে রেঙে যায় বাঙালী নারী আর পুরুষ। এ যেন এক অভূতপূর্ব জলরঙ ছবি। যে ছবির অন্তর্গত মহিমার সঙ্গীত বাজে অমিয় সুরের ধারায়। সঙ্গে হৃদয়ে গুঞ্জরিত হয় অসাম্প্রদায়িক চেতনার উজ্জ্বল ইশ্তেহার। শুধু কি তাই। বাঙালীর জীবনে বৈশাখ এক উদ্দীপনারও দৃশ্যমান প্রেক্ষিত। ভাঙা আর গড়ার মধ্য দিয়ে বৈশাখ যেমন রুদ্ররূপে কখনও কখনও আবির্ভূত হয়। তেমনি বৈশাখের রয়েছে সবুজ, সুন্দর এক সর্বজনীন চিরায়ত প্রতিচ্ছবিও। যে প্রতিচ্ছবির গহনে লোকজ উৎসবের ছন্দময় লিমোরিকগুলো আপনা থেকেই পিয়ানোর রিডের মতো বেজে ওঠে।
গ্রামীণ জনপদে যেমন বাংলা নববর্ষের একটা অনস্বীকার্য প্রভাব রয়েছে। একইভাবে নগরজীবনেও পহেলা বৈশাখের প্রবল উত্তাল, আনন্দমুখর উৎসারণ যেন সকল পঙ্কিলতাকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে আকণ্ঠ আবেগ, মানবিক চৈতন্যের দরজায় এসে ডোরবেল বাজায়।
ভোরবেলার মুখরিত ইলিশ-পান্তা ভোজন, মঙ্গল শোভাযাত্রা, লাল-সাদার শুদ্ধতা বিজড়িত নন্দিত প্রহর যেন বৈশাখের গলায় এক চিরকালীন সম্প্রীতির মালা পরিয়ে দিয়ে যায়।
আর এ মালায় গ্রথিত ফুলের ঘ্রাণে বছরজুড়ে বাঙালীর প্রাণ যেন থাকে উদ্বেলিত।
বাংলা নববর্ষ তাই বাঙালী প্রাণের উৎসবে আজ পর্যবসিত, কবিতায়, গানে, শিল্প-সংস্কৃতি, সাহিত্য, নাটক, চিত্রকলা, চলচ্চিত্র, ফ্যাশনসহ সব শাখাকেই যুগ যুগ ধরে দিয়ে যাচ্ছে নতুনত্বের গভীর অনুরণন। যার সূচনাটা করে ছায়ানট সেই ষাটের দশকের গোড়ায়। সেই থেকে আজ অবধি বাঙালিয়ানার এক সুবিশাল রিদম বুকের মধ্যে জাগিয়ে রেখে ছায়ানটের বরেণ্য শিল্পবৃন্দ কাকডাকা ভোরে এসে রমনার বটমূলে মিলিত হয়ে সমবেত বৈশাখী গানের মূর্ছনায় প্রতিবছর বাংলা নববর্ষকে বরণ করে নেয়ার সূচিত রীতিটির প্রচলন ঘটায়। শুরু থেকে এখনও অবধি সেই ধারাটি নগরজীবনের পহেলা বৈশাখকে এক জীবন্ত রূপৈশর্যের ধারায় বইয়ে দিয়েছে। আর এই ধারার মোহনায় যেমন এসে মিলিত হয় নাগরিক জীবনের সকল ব্যস্ততাকে পাশে রেখে নগরে বসবাসকারী শিশু থেকে শুরু করে সব বয়সী নারী ও পুরুষ। তেমনি ঢাকার উপকণ্ঠের অধিবাসীরাও ছায়ানটের উদ্যাপিত বাংলা নববর্ষ বরণের প্রভাতিক অনুষ্ঠানের টানে ছুটে আসে রমনার বটমূলে। দিনব্যাপী এই বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের শুভ সূচী ঘটে পান্তা-ইলিশের নিদারুণ রসাস্বাদনের মধ্য দিয়ে।
সারা বছরের বিভোর ব্যস্ততা, ধুলো-ময়লা, ভিড়ভাট্টা, যানজট, কোলাহল, কর্মমুখর অধ্যয়ন, শিল্পচর্চাসমূহের সব কিছুতে ক্ষণিকের বিরতি টেনে সকলেই যেন দাঁড়িয়ে যায় পহেলা বৈশাখ উদযাপনের রঙিন কাতারে। দিনভর স্বপ্নসুখের অক্ষর বুনে অন্তরে এক উন্মনা উচ্ছলতা ধারণ করে সন্ধ্যায় সবাই ঘরে ফিরে যার বৈশাখের চেতনায় ভিজে ভিজে।
এই বাংলা নববর্ষ বরণের আলো থেকে দূরে সরে নেই মফস্বল শহর, এমনকি গ্রামবাংলার দূর প্রান্তও। জারি সারি, বাউল গান, বৈশাখী লোকজ মেলার বেজে ওঠা আড়ের মুগ্ধ বাঁশির সুরে যেন মাতোয়ারা হয়ে পড়ে গ্রাম্য মাঠ-প্রান্তরও। আনন্দে উচ্ছ্বাসে প্রতিটি বাঙালী নারী ও পুরুষ পহেলা বৈশাখকে অন্য এক আবেগে বরণ করে নেয়।
মনেপ্রাণে যেমন বৈশাখের ছাপ পরিলক্ষিত হয়। বৈশাখের উন্মাতাল উচ্ছলতা যেন আরও প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে বৈশাখের ফ্যাশনেবল দেশীয় ফেব্রিকে তৈরি লাল-মাদার কম্বিনেশন টানা কারুকার্যময় পোশাকে। প্রতিষ্ঠিত ফ্যাশন হাউসগুলো বৈশাখের রাঙ্গা প্রভাতকে আরও রাঙ্গিয়ে দিতে নতুন ডিজাইনের বৈশাখী ড্রেস ডিসপ্লেতে উপস্থাপন করে। নগরবাসী পছন্দের পোশাকটি সংগ্রহ করে বাংলা নববর্ষকে বরণের আমেজকে আরও বাঙ্ময় করে তোলার সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করে প্রহর গুণতে থাকে সেই মাহেন্দ্রক্ষণের। যে ক্ষণটিকে রসনার বটমূলে ছায়ানটের মিহিন ফোয়ারা দেবে ভিজিয়ে। সিক্ত হবে সমবেত বাঙালী নারী ও পুরুষের আকুল করা মন। এভাবেই বাংলা বর্ষবরণ বছর ঘুরে আসে নগর জীবনে-আসে পহেলা বৈশাখ।