‘একটুকু ছোঁয়া লাগে একটুকু কথা শুনি, তাই দিয়ে মনে মনে রচি মম ফাল্গুনি’… প্রথম দর্শনের মাহেন্দ্রক্ষণটি কে ভুলতে পারে। দূর থেকে একটু দেখা, কাছে আসার পর আলতো ছোঁয়া আর মনে মনে ফাগুন রচনার ওই ক্ষণকালের নামই বোধহয় প্রেম।
আজ ভালোবাসার দিন। আজ প্রেয়সীর পানে একগুচ্ছ গোলাপ তুলে দিয়ে প্রেমকাতর হৃদয় বলে উঠবে পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যাকুল করা বাক্যটি ‘আমি তোমায় ভোলোবাসি’। আর তার সঙ্গে সঙ্গে ফাল্গুনের এই রাঙা সকাল, বিকেল বা রাতটাও হয়ে উঠবে প্রেমিক যুগলের জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়।
আজ ভ্যালেন্টাইস ডে। আজ প্রথম কবিতার মতো যেমন অনেকের জীবনে প্রথম প্রেম ধরা দেবে, তেমনি অনেক প্রেমিক যুগল হয়তো সেলিব্রেট করবেন তাদের একসঙ্গে পথচলার ৫ বা ১০ বছর। প্রিয় মানুষটির সামনে ভালোবাসার রঙে নিজেকে সাজিয়ে উপস্থিত হবেন আরেকবার। আবার তারা হয়তো নুতন করে একে অপরের প্রেমে পড়বেন। দূরে কোথাও হারিয়ে যাবেন বসন্তের উতল হাওয়ার মতোই। নিজেদের মতো করে কাটিয়ে দেবেন ভালোবাসার দিনটি। বাহুবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে কবি উৎপলকুমার বসুর কথাগুলো আওড়ে যাবেন ‘যা নয় তোমার বাহু/ তাই কালো তাই অন্ধকার’।
ভ্যালেন্টাইনস ডে বা ভালোবাসা দিবস সার্বজনীন হলেও দিবসিটিতে তারুণ্যেরই জয়জয়কার দেখা যায়। আর দিবসটির মূলত প্রেমিক-প্রেমিকা বা মানব-মানবীর চিরায়ত প্রেমকেই বোঝানো হয়ে থাকে। বাঙালির জীবনে এখন চলছে মধুর বসন্ত। ফাল্গুনের পলাশ শিমুল ফোটার সময় আজ ভালোবাসা দিবসে প্রেমিক যুগলদের আনাগোনা থাকবে শহরের নানা প্রান্তরে। উদ্যানগুলো হয়ে উঠবে নন্দনকানন।
রাজধানীতে চলছে অমর একুশে গ্রন্থমেলা। তাই সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণও হয়ে উঠবে ভালোবাসার মিলনমেলা। টিএসসি শাহবাগ, চারুকলা, ধানমন্ডির রবীন্দ্র সরোবরেও থাকবে যুগলদের পদচারণায় মুখর। অনেকে আবার ধানমন্ডি, বনানী, গুলশান, উত্তরার ফাস্টফুড ও কফিশপগুলোতে মিলিত হবেন। দুজনে একান্ত সময় কাটানোর পাশাপাশি চলবে খাওয়া-দাওয়া।
কেউ কেউ হয়তো প্রেয়সীকে নিয়ে একেবারেই নিজেরে মতো করে সময় কাটানোর জন্য লং ড্রাইভে চলে যাবেন। আবার কেউ কেউ হয়তো নির্জন গৃহকোণে মাতবেন ভালোবাসার অভিসারে। অনেক প্রেমিকযুগল বর্তমানে আবার ভালোবাসা দিবসকে বেছে নিয়েছেন প্রেমকে চিরস্থায়ী রূপ দিতে অর্থাৎ বিয়ের দিন হিসেবে। তাই এখন ভালোবাসা দিবস বিয়ের দিন হিসেবেও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
ভালোবাসা দিবসে উপহার আদান-প্রদানের প্রচলনও আছে। আজ চকোলেট, পারফিউম, বই, প্রিয় পোশাক, আংটি, ঘড়ি, খেলনা উপহার হিসেবে দেয়া-নেয়া চলবে। তবে সবচেয়ে বেশি দেয়া-নেয়া হবে রক্তগোলাপের। পাশাপাশি প্রেমবার্তা, শুভেচ্ছা কার্ড, ই-মেইল, মোবাইলে এসএমএস পাঠানো চলবে সমান তালে।
ভালোবাসা দিবস আমাদের দেশে এখন ঘটা করে পালন করা হলেও এটি এসেছে পশ্চিমা সংস্কৃতি থেকে। ভালোবাসা দিবস উদযাপনের ইতিহাস বেশ পুরনো এবং এ নিয়ে একাধিক কাহিনি প্রচলিত আছে। তবে সবচেয়ে বেশি প্রচলিত গল্পটি হচ্ছে সেন্ট ভ্যালেন্টাইনকে নিয়ে।
সময়টা ২৬৯ খ্রিস্টাব্দ। সেন্ট ভ্যালেন্টাইন নামে একজন রোমান ক্যাথলিক ধর্মযাজক যিনি একাধারে একজন চিকিৎসকও ছিলেন। সেই সময় রোমান সম্রাট ছিলেন দ্বিতীয় ক্লডিয়াস। রোমানরা একের পর এক রাষ্ট্র জয় করে চলেছে। যুদ্ধের জন্য রাষ্ট্রের বিশাল সৈন্যবাহিনী গড়ে তোলা দরকার। কিন্তু রাজ্যের লোকজন বিশেষ করে তরুণরা এতে উৎসাহী নয়। সম্রাট ধারণা করলেন, পুরুষরা বিয়ে করতে না পারলে যুদ্ধে যেতে রাজি হবে। তিনি তরুণদের জন্য বিয়ে নিষিদ্ধ করলেন।
কিন্তু প্রেমিক তারুণ্য মন এমন নিয়ম মানতে চায় না। তাদের পাশে এগিয়ে এলেন সেন্ট ভ্যালেন্টাইন। ভ্যালেন্টাইন প্রেমাসক্ত তরুণ-তরুণীদের বিয়ের ব্যবস্থা করলেন। কিন্তু একসময় ধরা পড়ে গেলেন ভ্যালেন্টাইন। তাকে জেলে নেয়া হলো। দেশজুড়ে এই খবর ছড়িয়ে পড়লে তরুণ-তরুণীদের মধ্যে প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। অনেকেই ভ্যালেন্টাইনকে জেলখানায় দেখতে যান। কারাগারের জেলারের একজন অন্ধ মেয়েও ভ্যালেন্টাইনকে দেখতে যেত। চিকিৎসক ভ্যালেন্টাইন মেয়েটির অন্ধত্ব দূর করলেন। একসময় হৃদয়ের বন্ধনে বাঁধা পড়লেন তারা। ধর্মযাজক হয়েও নিয়ম ভেঙে বিয়ে করেন ভ্যালেন্টইন।
এ খবর যায় সম্রাটের কানে। তিনি ভ্যালেন্টাইনের মৃত্যুদণ্ড দেন। সে তারিখটি ছিল ২৬৯ খ্রিস্টাব্দের আজকের দিন ‘১৪ ফেব্রুয়ারি’। ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার আগে ভ্যালেন্টইন তার প্রেয়সী এবং বধূকে যে চিঠিটি লেখেন তার শেষটায় লেখা ছিল ‘লাভ ফ্রম ইওর ভ্যালেন্টাইন’। এরপর দুই শতাব্দী নীরবে-নিভৃতে ভালোবাসা দিবস হিসেবে পালিত হয়েছে ১৪ ফেব্রুয়ারি। ৪৯৬ খ্রিস্টাব্দে রোমের রাজা পপ জলুসিয়াস এই দিনটিকে ভ্যালেন্টাইন দিবস হিসেবে ঘোষণা করেন।
ভালোবাসা দিবসকে ঘিরে নানারকম আয়োজনও রয়েছে। তবে আজ সবচাইতে বড় আয়োজন হতে যাচ্ছে শাহবাগ চত্বরে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের আয়োজনে সুন্দর পরিচ্ছন্ন ঢাকা শহর শহরবাসীকে উপহার দিতে জনসচেতনতা বৃদ্ধির আজ ভালোবাসা দিবসে শাহবাগ চত্বরে ‘প্রাণসখা ঢাকা’ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগে এবং চ্যানেল আই ও বিজ্ঞাপনী সংস্থা মাত্রা’র সহযোগিতায় আয়োজিত ওই অনুষ্ঠান সকাল ১০টা থেকে শুরু হয়ে বিকাল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত চলবে। এতে থাকছে গুণীজনের কথা, ঢাকার ঐতিহ্যের প্রদর্শনী, ঢাকাইয়া খাবারের আয়োজন, নাচ, কবিতা আবৃত্তি, ভালোবাসার গানের কনসার্ট, যাতে থাকছে দেশের জনপ্রিয় সঙ্গীতশিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, জেমস, জলের গান, শিরোনামহীনসহ আরো অনেক ব্যান্ড দলের শিল্পীদের পরিবেশনা।
‘যত গোপনে ভালোবাসি পরান ভরি/ পরান ভরি ওঠে শোভাতে/ যেমন কালো মেঘে অরুণ-আলো লেগে/ মাধুরী ওঠে জেগে প্রভাতে’… এই ফাগুনে ভালোবাসায় পলাশরাঙা মন গেয়ে উঠছে ঠাকুরের গান। ভরে উঠছে মুঠোফোনের মেসেজ, ই-মেইল অথবা অনলাইনের চ্যাটিংয়ে পুঞ্জ পুঞ্জ প্রেমকথায়।