তৃতীয় ধাপের পর ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনের বাকি তিন পর্বে আর অংশ নেবে না বিএনপি। এ ব্যাপারে দলের শীর্ষ পর্যায়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। বিএনপির সূত্রগুলো জানায়, শিগগির দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের সভা ডেকে বিষয়টি চূড়ান্ত করা হবে।
বিএনপির দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র জানায়, মোটা দাগে দুটি কারণে দলের শীর্ষ নেতৃত্ব ইউপি নির্বাচনের পরের তিনটি ধাপ বর্জনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রথমটি হচ্ছে, নির্বাচনী মাঠে সরকারি দল আওয়ামী লীগের প্রার্থী-সমর্থকদের ত্রাস সৃষ্টি, কেন্দ্র দখল ও ভোট কারচুপি। দ্বিতীয়টি হলো, মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীদের নানামুখী ঝুঁকি এড়ানো।
বিএনপির সূত্রগুলো বলছে, গত ২২ মার্চ ও ৩১ মার্চ—দুই দফায় অনুষ্ঠিত ইউপির ফলাফল ও নির্বাচন পরিস্থিতি দেখে দলের শীর্ষ নেতৃত্ব নীতিগত সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে যে বাকি নির্বাচনে অংশ নেওয়া হবে অনর্থক। সারা দেশের ৪ হাজার ২৭৫টি ইউপিতে মোট ছয় ধাপে ভোট গ্রহণ করবে নির্বাচন কমিশন। ইতিমধ্যে দুই ধাপে ১ হাজার ৩৫৬টি ইউপির নির্বাচনে বিএনপি মাত্র ৯৮টিতে জিতেছে। ২০০ ইউপিতে তারা প্রার্থীই দিতে পারেনি।
দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা মনে করছেন, গত দুই ধাপের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা ভোটকেন্দ্র দখলে নিতে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছেন, তাতে নির্বাচনে অংশ নেওয়া, না নেওয়ার মধ্যে খুব একটা পার্থক্য নেই। বরং সব জেনেশুনে শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে থাকার অর্থ হবে জোরজবরদস্তি জয়ী হওয়া সরকারি দলের প্রার্থী এবং নির্বাচন কমিশনকে নৈতিকভাবে বৈধতা দেওয়া।
অবশ্য দলের একটি সূত্র জানায়, ২৩ এপ্রিল অনুষ্ঠেয় তৃতীয় ধাপের নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থীরা অংশ নিতে পারেন। কারণ, ওই নির্বাচনের জন্য ইতিমধ্যে প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত করে দলীয় মনোনয়ন ঘোষণা করা হয়েছে। যদিও তৃতীয় পর্বে ৬৮৩টি ইউপির ৪৭টিতে বিএনপি প্রার্থী দিতে পারেনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির ইউপি নির্বাচনের অন্যতম সমন্বয়ক ও দলের যুগ্ম মহাসচিব মো. শাহজাহান গতকাল শুক্রবার বলেন, ‘তৃতীয় না চতুর্থ ধাপ থেকে বিএনপি সরে দাঁড়াবে, তা নীতিনির্ধারকেরা ঠিক করবেন। তবে আমরা সে চিন্তাই করছি, যে খেলার ফলাফল আগে থেকে নির্ধারিত থাকে, সে খেলা খেলে কী লাভ!’
বিএনপির নেতারা বলছেন, কয়েক বছর ধরে মামলা-হামলায় দলের মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীরা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমে নতুন করে ঝুঁকিতে পড়ছেন নেতা-কর্মীরা। একদিকে নিষ্ফলা এই নির্বাচনে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে। আরেক দিকে নির্বাচনে নেমে প্রতিপক্ষ ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের কাছ থেকে জীবনহানির হুমকি ও হামলার শিকার হতে হচ্ছে। অনেক জায়গায় নির্বাচনী হাঙ্গামা ও খুনখারাবির ঘটনায় দলের নেতা-কর্মীদের নতুন করে মামলায় জড়ানো হচ্ছে। সার্বিক পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর মনস্থির করেছে শীর্ষ নেতৃত্ব।
ওই সূত্র জানায়, এর পাশাপাশি ইউপি নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতায় এ পর্যন্ত ৩২ জনের প্রাণহানি ও আড়াই হাজারেরও বেশি মানুষ আহত হয়েছেন। এ অবস্থায় নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়ে মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীদের ঝুঁকি এড়াতে চাইছে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব।
সরকার স্থানীয় সরকারের পাঁচটি স্তরের সবচেয়ে বড় স্তর ইউনিয়ন পরিষদে দলীয় প্রতীকে নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নিলে বিএনপি নীতিগতভাবে এর বিরোধিতা করেছিল। শেষ পর্যন্ত তারা নির্বাচনে অংশ নেয়। যুক্তি হিসেবে ওই সময় দলটির নেতারা বলেছিলেন, বিএনপি স্থানীয় সরকারের নির্বাচন কখনো বর্জন করেনি। তা ছাড়া মাঠপর্যায়ে দলকে সংগঠিত করা এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের চলমান আন্দোলনের অংশ হিসেবে তারা এ নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। এ ছাড়া তারা ভেবেছিল যে, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে যেহেতু সরকারের পরিবর্তন হয় না, সে কারণে সরকারও প্রহসনের নির্বাচনের মনোভাব থেকে সরে আসবে। কিন্তু ইউপি নির্বাচনের দুই ধাপে সেই ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে বিএনপি ইউপি নির্বাচনের বাকি ধাপগুলোতে অংশ না নেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বিএনপির এ ধরনের চিন্তা সম্পর্কে জানতে চাইলে এখনই এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবীদের সংগঠন শত নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক এমাজউদ্দীন আহমদ।
নির্বাচন বর্জনের চিন্তাকে ‘আত্মঘাতী’ বলে মন্তব্য করেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্যাহ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বিগত সংসদ নির্বাচনে অংশ না নেওয়ায় বিএনপি জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। তা ছাড়া ১০ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকায় নেতা-কর্মীরাও হতাশ হয়ে পড়েছেন। এ অবস্থায় ইউপি নির্বাচনে অংশ নেওয়া ছিল সঠিক সিদ্ধান্ত। এখন নির্বাচন থেকে সরে যাওয়া হবে আত্মঘাতী। এ রকম হলে আগামী নির্বাচনে দল হিসেবে বিএনপির অস্তিত্ব থাকবে না।
তবে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘শেখ হাসিনার অধীন সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে কী মর্মান্তিক পরিণতি হতো, তার সর্বশেষ আলামত দেশবাসী দেখেছে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, এ নির্বাচন থেকে সরে আসা উচিত।’
বিএনপির অভিযোগকে ‘রাজনৈতিক বক্তব্য’ বলে মন্তব্য করেন নির্বাচন কমিশনার মো. শাহনেওয়াজ। নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর বিষয়ে জানতে চাইলে গত রাতে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা অফিশিয়ালি জানি বিএনপি নির্বাচনে আছে এবং থাকবে। ওনারা (বিএনপি) যদি অফিশিয়ালি জানান, তখন আমরা আমাদের বক্তব্য দেব।’