: যখন কিশোরী ছিলাম, আমার ইচ্ছে করতো সকাল দুপুর রাত একা হেঁটে বেড়াই, নদীর ধারে, গ্রামের মাঠে আলপথে, শহরের ফুটপাতে, পার্কে স্রেফ একা হাঁটি। আমার বড় ইচ্ছে করতো, সীতাকুন্ড পাহাড়ে যেতে, ইচ্ছে করে হঠাৎ একদিন শালবন বিহার দিয়ে পুরো বিকেল কাটাই। ইচ্ছে করতো সেন্ট মার্টিনের সমুদ্রে নেমে গাঙচিলের খেলা দেখি, ইচ্ছে করতো খুব মন খারাপ করা দুপুরে ঘাসের ওপর শুয়ে শুয়ে আকাশ দেখি, ইচ্ছে করতো সংসদ ভবন এলাকার সিঁড়িতে একা বসে থাকি, বিকেলে রমনায় গাছে হেলান দিয়ে অলস দাঁড়াই। ক্রিসেন্ট লেকের জলে সারা সন্ধ্যে পা ডুবিয়ে বসে থাকি, হঠাৎ আবার শীতলক্ষায় নৌকা নিয়ে ঘুরি।
আমি জানতাম, খুব ভালো করেই জানতাম, আমার ইচ্ছাগুলো ঘটতে গেলে আমাকে লোকের ঢিল, থুতু, গা-ধাক্কা খেতে হবে। আমাকে অপদস্থ হতে হবে, ধর্ষিতা হতে হবে। আমাকে কেউ ‘পাগল’ বলবে, কেউ ‘নষ্ট’ বলবে, কিন্তু সকলে নিশ্চয়ই একথা স্বীকার করবেন কোনও পুরুষের বেলায় এ ধরণের ইচ্ছেকে পূর্ণতা দিতে গেলে অশ্লীল বাক্যবাণে তাকে আহত হতে হয় না, কোনও পুরুষের বেলায় অপহরণ, অপঘাত, ধর্ষণ, হত্যা ইত্যাদি ঘটনাগুলো ঘটে না।
কেবল নারীর বেলায় ঘটে। কারণ নারী কেন সঙ্গে একজন পুরুষ ছাড়া হেঁটে বেড়াবে? পুরুষের না হয় বিচিত্র স্বভাব থাকে, পুরুষকে তা মানায় বটে! নারী কেন ফুটপাতে হাঁটবে, গাছের ছায়ায় দাঁড়াবে, সিঁড়িতে একা বসবে, খোলা মাঠের ঘাসে শোবে? নারীর এত ইচ্ছে থাকতে নেই। নারীকে ঘরে বসে থাকতে হয়, নারীর জন্য ঘরের দেওয়ালে ভেন্টিলেটরের ব্যবস্থা আছে, ওই ভেন্টিলেটর ফাঁক দিয়ে যে আলো-হাওয়া তার গায়ে এসে লাগে, সেটিই কি যথেষ্ট নয় বেঁচে থাকবার জন্য?
হ্যাঁ, যথেষ্টই বটে। বেঁচে থাকবার জন্য এটুকু আলো হাওয়াই যথেষ্ট। নারীর বেঁচে থাকাটুকু সকল পুরুষই চায়। কারণ নারীকে তাদের প্রয়োজন। ভোগের জন্য, বংশরক্ষার জন্য। নারী না হলে পুরুষের ভোগ হবে না, বংশ রক্ষা হবে না, নারী না হলে কর্তৃত্ব করবার, শক্তি খাটাবার, গলার জোর, গায়ের জোর দেখাবার জায়গা কোথায় পুরুষের! ওপরতলার মানুষের নিয়মই নিচের তলার মানুষকে শোষণ করা, বিত্তহীনকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়া। নারীর ওপর পুরুষের তাই সর্বময় অধিকার, তাকে চর্ব চোষ্য লেহ্য পেয়ে করবার, তাকে আহত করবার। নারী নিচের তলার মানুষ, নারী দুর্বল, নারী সহায় সম্বলহীন উদ্বাস্তু। তাই নারীকে বাঁচিয়ে রেখে নারীর ওপর চড়াও হবার ইচ্ছা সকল ভদ্রলোকের।
খাঁচার ভেতর পাখির জন্যও আলো ঢুকবার ব্যবস্থা থাকে, পাখিকে সময় মত আহার দেওয়া হয়, পাখিকে কিছু বাঁধা কথা মুখস্থ করানো হয়। একই রকম নারীকেও। নারীকেও ভেন্টিলেটর দেওয়া হয়, সকাল দুপুর খাবার দেওয়া হয়, নারীকে সমাজ খুশি হয় এমন কিছু কথা শেখানো হয়, নারীকে তার সীমিত বাক্য, সীমিত পথ, সীমিত খাঁচায় বন্দি পাখির মত খোলা আকাশ, খোলা মাঠ, বন-বনান্তর, অনন্ত সবুজের স্বাদ থেকে বঞ্চিত করা হয়।
নারীকে দুর্বল ভাবে কারা? যারা বলে, নারী শরীরে দুর্বল, ভুল বলে। যারা বলে, মনে দুর্বল, তারা ভুল বলে। তারা মিথ্যে বলে। এখনও দুটো ছেলে ও মেয়ে-শিশুকে ভরা পুকুরে ছেড়ে দিলে যে শিশুটির আগে মৃত্যু হবে সে ছেলে শিশু। যদি মেয়ে শিশুর ফুসফুস বা হৃদপিন্ড ছেলে শিশুর চেয়ে অধিক শক্তিশালী হয়, যদি প্রতিরোধ ক্ষমতা বা বেঁচে থাকবার প্রচন্ড ক্ষমতা মেয়ে শিশুরই বেশি হয়, তবে কি করে এক বাক্যে রায় দেওয়া হয় যে, মেয়ে মাত্রই দুর্বল, কোমল, ভীতু ও লজ্জাবতী।
আসলেই এ সবই নারীর ওপর চাপিয়ে দেওয়া সামাজিক বিশেষণ। নারী বিবেক বুদ্ধি দ্বারা অধিক চালিত বলে বা মমতা ভালবাসা ধারণ করবার ক্ষমতা সে বেশি রাখে বলে হিংস্র যুদ্ধে খুব বেশি ঝাঁপিয়ে পড়ে না, এর অর্থ এই নয় যে সে দুর্বল। নারী গর্ভবতী হয়, সন্তানের প্রতি তার মায়া জন্মে, ভালোবাসার কাছে নারী নত হয়, নিমগ্ন হয়। এর অর্থ এই নয় নারী ভীতু,লজ্জাবতী।
নারীকে ভয় এবং লজ্জা শিখিয়েছে সমাজের পুরুষেরা। ভয় এবং লজ্জা থাকলে পুরুষের আধিপত্য বিস্তারে বেশ সুবিধে হয়, ভয় এবং লজ্জাকে তাই নারীর ‘ভূষণ’ বলে ভাবা হয়, নির্ভীক এবং লজ্জাহীন নারীকে সমাজে খুব কম লোকই আছে যে মন্দ বলে না।
যেহেতু ভয় এবং লজ্জাকেই নারীত্বের প্রধান গুণ ভাবা হয়, যেহেতু সীমিত পথই নারীর চলাচলের জন্য নির্দিষ্ট হয় তাই সে যদি রমনায়, রকে, রেস্তেরোঁয় হাঁটে বা বসে, লোকে তার দিকে অবাক তাকাবে,শিস দিবে, গা ঘেঁসে দাঁড়িয়ে পরখ করবে মেয়ে ‘বেশ্যা’ কিনা। কারণ বেশ্যা ছাড়া কোনও মেয়ে দুর্বিনীত হাঁটে না, বেশ্যা ছাড়া কেউ শহর জুড়ে একা,উদ্ধত, সীমানা ছাড়া পথ পেরোয় না।
যারা ঘরে বসে থাকে, যারা অভিভাবক নিয়ে বা পুরুষ নিয়ে নিরাপদে ঘরের বার হয়, অথবা একাই শোভন সীমানার মধ্যে বিচরণ করে প্রয়োজন শেষে ঘরে ফেরে, সমাজ তাদের ভদ্র মেয়ে বলে। ভদ্রতার বাইরে গেলেই মেয়েদের ‘বেশ্যা’ বলে গালি দেওয়া হয়। পুরুষেরা ‘বেশ্যা’-কে গাল দেয় ঠিকই কিন্তু বেশ্যা ছাড়া তাদের চলেও না। তারাই নিজেদের স্বার্থে নিজেদের নাগালের মধ্যে বেশ্যালয় খুলেছে।
পুরুষেরা বেশ্যা বলবে বলে নারী একা হেঁটে বেড়ায় না দূরের কোনও খোলা মাঠে, নারী ইচ্ছে হলেওচন্দ্রনাথ পাহাড়ে যায় না, ইচ্ছে হলেও নদীর পাড় ঘেঁষে দাঁড়ানো হিজল গাছের ছায়ায় বসে দু’এক কলি গান গায় না, ইচ্ছে করলেও নির্জন ফুটপাত ধরে একা হাঁটে না। নারী বেশ্যা নামটিকে বড় ভয় পায়, এই নাম থেকে বড় গা বাঁচিয়ে চলে। পুরুষের চোখে নিজেকে আকর্ষণীয় করবার জন্য নারী সাজে। চোখে, গালে, ঠোঁটে রঙ লাগায়। পুরোপৃথিবীতে প্রসাধনী দ্রব্যের উৎপাদন কী হারে বাড়ছে তা আমার সাধ্য নেই হিসাব করি। বেশ্যারা সাজে অসামাজিক খদ্দেরের আশায়, আর ভদ্র নারীরা সাজে সামাজিক খদ্দেরের আশায় — দু’সাজেই উদ্দেশ্যই খদ্দের পাওয়া।
যার যত ভাল খদ্দের জোটে, তার ইহলৌকিক সুযোগ-সুবিধে তত বেশি। নারীকে তারা সুযোগ-সুবিধে দিচ্ছে বলে, খেতে পরতে দিচ্ছে বলে নারীর পায়ে তারা শিকল পরায়, ছাগলকে মাঠে ছেড়ে গলায় দড়ি বেঁধে যেমন খুঁটি গেড়ে দেওয়া হয়, অনেকটা তেমন। নারীকে গরু ছাগল ভেড়ার মতই একটি মাপা গণ্ডির ভেতরে চলতে ফিরতে দেওয়া হয়। পুরুষেরা দড়ি বাঁধা নারীর স্বাদ পেতে চায় আবার দড়ি ছেঁড়া নারীর স্বাদও। মূলত পুরুষের রসনা তৃপ্ত করবার জন্যই নারীকে একবার ঘরবন্দি হতে হয়, আরেকবার ঘর ছাড়া। নারী কিন্তু নারীই, সে বেশ্যা হোক, সে কুলবধুই হোক, দুর্ভোগ পোহাবার জন্যই তার জন্ম।
সমাজের নারীরা পুরুষ ছোবল দেবে ভয়ে, আবার পুরুষ তাদের মন্দ বলবে ভয়ে ইচ্ছে করলেও মহাস্থানগড় থেকে একবার বেড়িয়ে আসে না, শ্রীমঙ্গলের চা বাগানে উদাস হেঁটে বেড়ায় না, ব্রহ্মপুত্রের জলে আনন্দে সাঁতার কাটে না, সুন্দরবনের পূর্ণিমায় শরীর ভেজায় না। একটাই মাত্র জীবন মানুষের। এই জীবনকে নারী যেমন ইচ্ছে যাপন করতে পারে না। এই জীবনকে মানুষের কাছে আকাশ ও নক্ষত্রের কাছে, জল ও হাওয়ার কাছে, সবুজ অরণ্যের কাছে, একলা নদীর কাছে এনে জীবন চেনায় না। তার সকল ইচ্ছে, তার সকল সাধ ও স্বপ্নের ঘরে আগুন জ্বেলে সে পুরুষের ঘর আলোকিত করে।
নারীর ব্যর্থ জীবনের জন্য শোকে ও সন্তাপে আমি মাথা নত করি, মনুষ্যত্ব কিছু আছে বলেই করি।
কিশোরী বেলায় নিজের ইচ্ছেকে দমন করেছি। এখন এই পরিণত বয়সেও নিজের ইচ্ছেকে দমন করতে হয়। নারী হয়ে জন্ম নেওয়ার অপরাধে সেই আগেও যেমন ইচ্ছেকে দমন করতে হতো, এখনও হয়। প্রতিবাদী নারী হওয়ার কারণে ইচ্ছের ডানা মেলের ওড়ার ব্যাপারে প্রতিবন্ধকতা আগের চেয়ে অনেক বেশি। আগেও যেমন হাতে পায়ে শেকল ছিল। এখনও হাতে পায়ে শেকল। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই শেকল পরেই বাঁচতে হবে। এ ছাড়া মুক্তি নেই।
লেখক: কলামিস্ট