কক্সবাজার দক্ষিণ বনবিভাগের ইনানী রেঞ্জে রয়েছে ২০ হাজার ২৬১ একর বনাঞ্চল। ৫টি বনবিট নিয়ে এ রেঞ্জ গঠিত। এরমধ্যে জালিয়াপালং বনবিটের আওতাধীন সংরক্ষিত বনভূমি রয়েছে ২ হাজার একর। এই ২ হাজার একর বনভূমির মধ্যে ৫ হাজার একর বনাঞ্চলে ছিল লাখখানেক জামগাছ। এটি চাককাটা জাম বাগান নামে পরিচিত। এক সময়ে গহীন অরণ্য ঘেরা এই জাম বাগানে ভুলেও মানুষের পা পড়তো না। এই জামবাগানে ছিল ভয়ঙ্কর বন্যপ্রাণীদের ভয়। ছিল হাজারও পশু পাখির আস্তানা। ৫ বছর আগেও দেখা যেতো এ দৃশ্য। কিন্তু, সেই অভয়ারণ্য আর নেই। নেই কোনও পাখির কলকাকলী। নেই কোনও বন্য প্রাণীর আস্তানা। আছে শুধু ন্যাড়া টিলা। আর এই ন্যাড়া টিলাগুলোতে টিকে আছে একটিমাত্র অল্পবয়সী জামগাছ।
এক সময়ের গহীন অরণ্যঘেরা এই এলাকাটির নাম চাককাটা। সম্প্রতি সরেজমিন ওই এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, বনের জায়গাটিতে এখন আছে গোটা কয়েক ন্যাড়া টিলা। এসব টিলাতেও হামলে পড়েছে ভূমি দস্যুরা। অন্য টিলাগুলো কেটে এরইমধ্যে সমান করে ফেরা হয়েছে। সেখানে গড়ে উঠেছে অবৈধ বসতি। স্থানীয় বনদস্যুরা বনটি সাবাড় করে দিয়ে এখন ভূমিদস্যু হয়ে এই জমিগুলো এখন স্ট্যাম্পের ওপর বেচে দিচ্ছে! সেই জমিতে কেউ করছে বসতি স্থাপন, কেউবা করছে চাষ।
ওই গ্রামের সোলতান আহমদ নামের এক ব্যক্তির কাছে জামবাগানটা কোথায় জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখন তো জামবাগান নাই। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর এই জামবাগানের ওপরে নজর পড়ে স্থানীয় প্রভাবশালীদের। বনবিভাগের অফিসারদের সঙ্গে তারা জোট বেঁধে এই এলাকার সবগুলো গাছ কেটে সাবাড় করে দিয়েছে। ৫/৬ বছর আগেও এই অঞ্চলে লাখ লাখ জাম গাছ ছিল। কক্সবাজারের সবচেয়ে বড় জাম বাগান ছিল এটি। এখন আছে একটিমাত্র জাম গাছ। সেটাও কাটার চেষ্টা করেছিল কাঠপাচারকারীরা। কিন্তু কেন জানি সেটি কেটে নিয়ে যেতে পারেনি তারা।
কী কারণে এই গাছটি তারা রেখে দিয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, শুনেছি রাতের আঁধারে ওই গাছ থেকে নাকি অলৌকিক শব্দ হয়। কী যেন বলতে চায়। এলাকার অনেকেই নাকি এই শব্দ শুনেছে। তারপরেও দিনের বেলাতেও কাঠ পাচারকারীরা গাছটা কাটার চেষ্টা করেছে। কিন্তু নিয়ে যেতে পারেনি। এলাকার মানুষ বলে গাছটিতে ভূতের আছড় রয়েছে। তাই ওটা এখনও টিকে আছে।
ঐতিহ্য রক্ষার জন্য কখনও কখনও জনশ্রুতিকে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিয়ে ভাঙতে নেই। তাই জামগাছটিকে রক্ষায় এর ভূতের আছড়ের গল্পটির অসারত্ব না খুঁজে বাংলা ট্রিবিউনের পক্ষে চলে বনটি সাবাড়কারীদের খোঁজ।
কাঠপাচারকারীদের উৎস খুঁজতে কথা হয় একই এলাকার আব্দুর গফুর নামে আরেক ব্যক্তির সঙ্গে। তিনিও জানান, এই এলাকায় এক সময়ে গহীন বন ছিল। কিন্তু, বন বিভাগের কিছু দুর্নীতি পরায়ণ কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে যোগসাজসে এলাকার প্রভাবশালীরাই এক জোট হয়ে এই বন সাবাড় করেছে। শুধু গাছই নয়, গাছের চিহ্ন মুছে ফেলতে গাছের গুড়ি পর্যন্ত উঠিয়ে নিয়ে গেছে তারা। এরপর সেই জায়গার ছোট ছোট টিলা ও পাহাড় কেটে একেবারে সমতল ভূমি বানিয়ে সমবায় সমিতির নাম দিয়ে জায়গাগুলো এখন বিক্রি করছে। অথচ এগুলো বন বিভাগের জায়গা। এই জায়গায় এখন জমি কিনে বসতি করেছে কিছু স্থানীয় আর রোহিঙ্গারা।
চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী ও স্থানীয় বাসিন্দা মোহাম্মদ হোসেন খন্দকার বলেন, এই এলাকায় তো এখন জাম বাগান নেই। এটি এখন সমিতি ঘোনা নামে পরিচিত। স্থানীয় প্রভাবশালীরা সমিতি গঠন করে বনবিভাগের সহযোগিতায় একের পর এক পাহাড় কেটে ধানি জমিতে পরিণত করেছে। জামগাছ তো দূরের কথা, গাছের মুলা (গুড়ি) পর্যন্ত তুলে নিয়ে গেছে ভূমিদস্যুরা।
কক্সবাজার আদালতে কর্মরত ও স্থানীয় বাসিন্দা পেশকার নুরুল আমিন জানান, এই জাম বাগান নিয়ে তো আরও আগে রিপোর্ট লেখা উচিত ছিল। এই এলাকায় লাখ লাখ জাম গাছ ছিল। আর এখন জাম গাছ খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। দিন-দুপুরে বনবিভাগের সহযোগিতায় সমিতির নামে শত শত একর জমি সাবাড় করেছে। কই এখনও পর্যন্ত তাদের নামে একটি মামলা পর্যন্ত হয়নি।
ওই জাম বাগানে স্থায়ীভাবে বসবাসরত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ব্যক্তি জানিয়েছেন, গত ৫ থেকে ৭ বছর আগে স্থানীয় সাবেক মেম্বর মফিজ উল্লাহ, শামশুল আলম ওরফে বলি শামশু, নূর মোহাম্মদ সওদাগর, আলী হোসেন, ছৈয়দ আলম ওরফে তাবাইয়া, আলী আহমদ, ফরিদ আলম, সোনাইয়া, মোহাম্মদ আলম, ছৈয়দ আলমসহ বেশ কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি দেড় শতাধিক লোক নিয়ে সমিতি গঠন করে বনভূমি নিধন শুরু করে। এসময় জামগাছ সহ বনাঞ্চলে থাকা লাখ লাখ গাছ কেটে সাবাড় করে তারা। পরবর্তীতে সেখানে শত শত একর পাহাড় কেটে তা সমতল ভূমিতে পরিণত করে চড়া দামে বিক্রি শুরু করে। এখনও সেখানে জমি বিক্রি করছে ওই প্রভাবশালী মহল। কিন্তু বন বিভাগের পক্ষে এ পর্যন্ত একটি মামলাও হয়নি।
এসব গাছকাটার অভিযোগ যাদের বিরুদ্ধে তাদের একজন সাবেক ইউপি মেম্বর মফিজ উল্লাহ। তার সঙ্গে এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে তিনি অপরাধের দায় এড়িয়ে যান। তিনি বলেন, এলাকাটি সরকারি বাগান। তিন চার বছর আগেও এখানে পাহাড় ও লাখ খানেক জামগাছের বাগান ছিল। কিন্তু, এলাকার লোকেরা এসব গাছ চুরি করেছে। আর এসব অপকর্মের সঙ্গে বনবিভাগের লোকেরাই দায়ী।
তিনি আরও বলেন, গাছ কাটার ঘটনা ইনানী রেঞ্জের সাবেক বন কর্মকর্তা মীর আহম্মেদ এর সময়ে সবচেয়ে বেশি হয়েছে। আর বনবিভাগের সঙ্গে স্থানীয় প্রভাবশালীদের বেশিরভাগই এ ঘটনায় জড়িত। এতো বড় বন উজাড় এবং বনের এলাকা বেহাত হয়ে যাওয়ার ঘটনায় বনবিভাগ কোনও মামলা করেছে বলেও শোনেননি তিনি।
স্থানীয় হওয়ার পরেও বনের গাছ উজাড় ও জায়গা বেহাত হওয়ার ঘটনায় কোনও প্রতিবাদ করেছেন কিনা জানতে চাইলে মফিজ উল্লাহ বলেন, স্থানীয়রাই এ কাজে জড়িত, তাই প্রতিবাদ করার কথা ভাবিনি।
এ ঘটনায় কারা জড়িত জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘স্থানীয় সন্ত্রাসীরাই জড়িত। তারাই গাছ কেটে সাবাড় করেছে, এখন বনের জায়গার টিলা কেটে সমান করে সেই জায়গা স্ট্যাম্পের ওপর দলিল করে একজন আরেকজনকে বুঝিয়ে দিচ্ছে। এই জায়গায় এখন এতো বসতবাড়ি যে বোঝাই যায় না আগে এখানে বন ছিল।’
সন্ত্রাসীদের নাম জানতে চাইলে মোহাম্মদ আলম ও সোনা মিয়াসহ এলাকার শ’খানেক ব্যক্তি এ কাজে জড়িত বলে জানান তিনি।
এ ঘটনায় তিনি নিজেও জড়িত এমন অভিযোগ পাওয়া গেছে জানালে সাবেক ইউপি মেম্বর মফিজ উল্লাহ তা অস্বীকার করে অসংলগ্ন কথা বলতে শুরু করেন। দায় এড়াতে তিনি বলেন,‘আমার বাড়ি ওই এলাকা থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে। তাই ওইখানে কী হয়েছে আমি জানি না। আমি দশবছরের মধ্যে ওই এলাকায় যাইনি।’
এ ঘটনায় অভিযুক্ত মোহাম্মদ আলম ও সোনা মিয়াসহ আরও কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলেও তাদের মুঠোফোনে পাওয়া যায়নি।
২০১৫ সাল পর্যন্ত ওই রেঞ্জের দায়িত্ব পালন করেন মীর আহম্মদ। স্থানীয়দের অনেকেই এই বন কর্মকর্তার যোগসাজসে বনের গাছ চুরি হওয়া ও বনের জায়গা উজাড় হওয়া সম্পর্কে অভিযোগ করলেও ইনানী রেঞ্জের সাবেক এই কর্মকর্তার সাফ দাবি, তার সময়ে ওই রেঞ্জের একটি গাছও কাটা পড়েনি। ওই এলাকারও কোনও পরিবর্তন ঘটেনি বলে বাংলা ট্রিবিউনের কাছে দাবি করেন তিনি। এমনকি জালিয়াপালং বনবিটের চাককাটা জামবাগান থাকার কথা অস্বীকার করে তিনি এই জায়গা চেনেন না বলে দাবি করেন বাংলা ট্রিবিউন-এর কাছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে উখিয়ার জালিয়াপালং বনবিট কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম বলেন, বিষয়টি তার জানা নেই। কারণ তিনি এ বনবিটে যোগদান করেছেন মাত্র দেড় বছর হয়েছে। ওই এলাকায় এক সময়। লাখ লাখ জাম গাছ ছিল এটা শোনার কথা স্বীকার করলেও এসব তিনি দেখেননি বলে জানান। তবে ওই বাগানে এখনও ৫০টিরও বেশি জাম গাছ রয়েছে দাবি করে তিনি আরও বলেন, তারা সব সময় কাঠ পাচারকারী ও ভূমি দস্যুদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন। কিন্তু, জনবল ও আগ্নেয়াস্ত্রসহ বিভিন্ন সরঞ্জামাদি সংকটের কারণে গাছ রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
এ বিষয়ে ইনানী রেঞ্জ কর্মকর্তা ব্রজ গোপাল রাজবংশী বলেন, আমি এই রেঞ্জে মাত্র এক সপ্তাহ হলো যোগদান করেছি। এ বিষয়ে আমি কিছুই বলতে পারবো না। এই রেঞ্জে আমার আগে যারা কর্মরত ছিল, মূলত: তারাই ভালো বলতে পারবেন।
আর কক্সবাজার দক্ষিণ বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. আলী কবির জানান, বিষয়টি আমার কাছে ক্লিয়ার নয়। কারণ, এটি অনেক দিন আগের কথা। জাম বাগান সম্পর্কে বিস্তারিত খোঁজ নিয়ে দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।