রাজনীতিক ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাই ইয়াবা ছড়াচ্ছে। এই গুরুতর অভিযোগ তোলা হলো খোদ আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকেই। গত বৃহস্পতিবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এ কমিটির বৈঠক হয়। বৈঠকে এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে মন্তব্য করা হয়, শর্ষের ভেতরের ভূত না তাড়াতে পারলে যত অভিযানই হোক, ইয়াবা রোধ করা যাবে না। পরে ইয়াবা রোধে সর্বোচ্চ কঠোর হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।
অন্যদিকে ইয়াবা পাচারে কক্সবাজার এলাকার রাজনীতিকরা জড়িত থাকলেও আইনের ফাঁকে তারা পার পেয়ে যাচ্ছে বলেও বৈঠকে আলোচনা হয়। আইন পরিবর্তন ও কঠোর করার জন্য এরই মধ্যে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর থেকে লেখা হয়েছে মন্ত্রণালয়ে। এ ছাড়া প্রতিনিয়তই ইয়াবা পাচারকারীরা কৌশল বদলাচ্ছে। তাদের সর্বশেষ কৌশল—শুকনো মরিচ কেটে বিচি বের করে এর ভেতর ইয়াবা ঢুকিয়ে চালান করা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিপ্তর ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
জানতে চাইলে বিজিবির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ইয়াবা থেকে রক্ষা পেতে হলে যাদের অ্যারেস্ট করা হচ্ছে, তাদের দ্রুত বিচার করে সাজা দিতে হবে। ইয়াবা ব্যবসায়ী হিসেবে যারা লিস্টেড তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
ইয়াবা রোধে দায়িত্ব পালনকারীদের মধ্যে যারা জড়িত বলে অভিযোগ আছে, তাদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে মিয়ানমারের সঙ্গে কথা বলে এ সমস্যা সমাধানে আরো অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে। পাশাপাশি মিয়ানমার সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া ও রাস্তা করা গেলে ইয়াবা রোধ সহজ হবে।’
গত ৭ এপ্রিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু। উপস্থিত ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ বেশ কয়েকজন মন্ত্রী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তা ও গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সভায় ইয়াবা বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। একপর্যায়ে একজন কর্মকর্তা বলেন, মিয়ানমার থেকে প্রতিনিয়ত লাখ লাখ ইয়াবা ঢুকছে দেশে। এর কিছু ধরা পড়ছে, কিন্তু সিংহভাগ দেশের ভেতরে ছড়িয়ে যাচ্ছে, যার সঙ্গে রাজনীতিকসহ প্রভাবশালীরা জড়িত। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু অসাধু সদস্যও ইয়াবা পাচারে সরাসরি জড়িত। এ সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অন্য এক কর্মকর্তা একমত পোষণ না করলে উত্তেজনা দেখা দেয়। পরে গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা বৈঠকে জানান, ঘটনা সত্য। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কারা কারা ইয়াবা পাচারে জড়িত, তাদের তালিকা দেওয়া হয়েছে। অন্য এক কর্মকর্তা এ পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যারা ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার হয়েছে, তাদের নাম উল্লেখ করেন এবং ইয়াবা পাচারের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরেন, যা শুনে অবাক হয়ে যান উপস্থিত মন্ত্রীরাও।
বৈঠকে গত বছর ২০ জুন ফেনীর লালপোল এলাকায় এলিয়ন গাড়িসহ এসবির এএসআই মাহফুজুর রহমানকে সাত লাখ ইয়াবাসহ আটক করার বিষয়টি তুলে ধরা হয়। এ ছাড়া ২০১৪ সালে দারুসসালাম থানার কনস্টেবল কামরুল হাসানকে ইয়াবাসহ আটক করে পুলিশ। সম্প্রতি পুরান ঢাকার হাজারীবাগ এলাকা থেকে তিন হাজার পিস ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার করা হয় সাব-ইন্সপেক্টর বরকত উল্লাহকে। এসব উদাহরণ তুলে ধরার পর মন্ত্রিসভা কমিটি ইয়াবা রোধে কঠোর হওয়ার নির্দেশ দেয়।
কক্সবাজার এলাকায় বিভিন্ন পর্যায়ের রাজনীতিক ইয়াবা পাচার করছে বলেও জানানো হয় বৈঠকে। তাদের অনেকে ইয়াবার গডফাদার হিসেবে তালিকাভুক্ত। পরে মন্ত্রিসভা কমিটি ইয়াবার গডফাদার যত শক্তিশালীই হোক বা যে দলের রাজনীতিকই হোক, তার বিরুদ্ধে কঠোর হওয়ার নির্দেশ দেয় বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়।
অভিনব সব কৌশল : গত ৫ ফেব্রুয়ারি সকালে কক্সবাজারের টেকনাফের দমদমিয়া চেকপোস্ট দিয়ে যাচ্ছিল একজন ব্যক্তি। তার হাতে ছিল একটি ব্যাগ। বিজিবির সদস্যরা ব্যাগ তল্লাশি করে দেখতে পান, ব্যাগের ভেতরে ‘স্বাস্থ্যবান’ শুকনো মরিচ। হঠাৎই শাজাহান নামের এক বিজিবি সদস্যের চোখে পড়ে, একটি মরিচের মাঝখানে কাটা। সঙ্গে সঙ্গে মরিচটি বের করে ভেতরে দেখতে পান পলিথিনে মোড়ানো ইয়াবা। পরে মরিচের ওই চালানের ভেতর থেকে সাত হাজার ৫৭৭ পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। শুধু তাই নয়, মাছের পেট কেটে, ফুটবলের ভেতরে, পেঁয়াজের ভেতরে—অভিনব সব কৌশলে পাচারের সময় ইয়াবা ধরা পড়ছে।
গত জানুয়ারি মাসে টেকনাফ এলাকার ইয়াবার গডফাদাররা টাকার প্রলোভন দেখিয়ে মো. ইসমাঈল বাঘাইয়া নামের এক যুবকের পায়ুপথ দিয়ে পেটের ভেতর এক হাজার ইয়াবা ঢুকিয়ে দেয়। চট্টগ্রাম পৌঁছে দেওয়ার জন্য টেকনাফ থেকে বাসে করে রওনা দিলে পথে তার জ্বালা-যন্ত্রণা শুরু হয়। হ্নীলা বাসস্টেশনে নেমে সে তার বড় বোনের বাড়িতে আশ্রয় নেয়। সন্ধ্যায় তাকে টেকনাফ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়ার পথে তার মৃত্যু হয়। সংবাদ পেয়ে পুলিশ লাশটি উদ্ধার করে রাতে কক্সবাজার সদর হাসপাতাল মর্গে পাঠায়। ময়নাতদন্ত করে তার পেট থেকে ইয়াবার পোঁটলা পাওয়া যায়।
জানতে চাইলে টেকনাফে থাকা বিজিবি-২ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবুজার আল জাহিদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি টেকনাফে যোগ দেওয়ার পর গত দুই বছর পাঁচ মাসে ৮২ লাখ ইয়াবা ধরা পড়েছে। নানা কৌশলে পাচারকারীরা ইয়াবা পাচার করে থাকে। আমরাও তাদের ধরার জন্য নানা কৌশল নিই।’
আইনের ফাঁকে গডফাদার পার : আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এক কর্মকর্তা বলেন, ইয়াবাসহ পুলিশ ধরা পড়ার কারণে ইয়াবার গডফাদার এবং রাজনীতিকরা এলাকায় বলতে শুরু করেছে—ইয়াবা পাচারের সঙ্গে পুলিশ জড়িত, তারা নয়। ওই কর্মকর্তা বলেন, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের দুর্বলতার কারণে রাজনীতিক ও ইয়াবার গডফাদারদের কিছু করা যাচ্ছে না। যারা ধরা পড়ে তারা বহনকারী। তাদের জিজ্ঞাসাবাদে যেসব গডফাদারের নাম পাওয়া যায় তাদের কিছু করা যাচ্ছে না। কারণ আইন অনুযায়ী মাদকসহ ধরা না পড়লে কারো বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া যায় না। আর এই সুযোগে রাজনীতিকরা বাহক নিয়োগ দিয়ে কলকাঠি নেড়ে এই ব্যবসা চালিয়ে যেতে সক্ষম হচ্ছে।এ বিষয়ে জানতে চাইলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক ফজলুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে কারো কাছে যদি মাদক পাওয়া না যায় তাহলে সে বিক্রেতা হলেও তাকে আইনের আওতায় আনা যায় না।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আইনের দুর্বলতা কাটানো ও কঠোর করার জন্য মন্ত্রণালয়ে লেখা হয়েছে।’ধরা পড়ছে লাখ লাখ : একসময় দেশে শত শত ইয়াবা ধরা পড়ত। এরপর ধরা পড়েছে হাজার হাজার। ইদানীং ধরা পড়ছে লাখ লাখ। গত ৫ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরের বয়া এলাকা থেকে ১৫ লাখ ইয়াবা আটক করে নৌবাহিনী, যার আনুমানিক মূল্য ৮৩ কোটি টাকা। গত ৯ এপ্রিল টেকনাফ এলাকায় অভিযান চালিয়ে বিজিবি ৭০ হাজার ইয়াবা আটক করে। গত ১৭ জানুয়ারি ঢাকা ও চট্টগ্রামে অভিযান চালিয়ে ২৮ লাখ ইয়াবা আটক করে র্যাব। ২৬ ফেব্রুয়ারি টেকনাফে অভিযান চালিয়ে এক লাখ ২০ হাজার ইয়াবা আটক করে বিজিবি।