সুনীল বড়ুয়া , ডেইলি কক্সবাজার প্রতিবেদন:
চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক ধরে যেতে যেতে রামু পৌঁছালেই দেখা মিলবে সবুজের অনাবিল হাতছানি। এই মনোমুগ্ধকর দৃশ্য চা বাগান এলাকার। নাম চা বাগান হলেও চারপাশেই দেখা যাবে উঁচু নীচু পাহাড় টিলায় অসংখ্য রাবার গাছ। চা বাগান স্টেশনের বুকচিরে পশ্চিম দিকে চলে গেছে একটি সড়ক। ওই সড়ক ধরে একটু গেলেই দেখা মেলে শান্ত কোমল সবুজের মাঝে মানুষের বসতি। পরিবেশ এবং এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মনোমুগ্ধকর। এটি কক্সবাজার রামু উপজেলার জোয়ারিয়ানালা ইউনিয়নের উত্তর মিঠাছড়ি গ্রাম। সেই অসাধারণ সৌন্দর্য্যে ঘেরা একটি পাহাড়ের চূড়ায় এক টুকরো সবুজের মাঝেই বৌদ্ধ ভিক্ষু করুনাশ্রী গড়ে তোলেছেন ‘বিমুক্তি বিদর্শন ভাবনা কেন্দ্র’। সেখানেই তিনি নির্মাণ করেন বিশালাকার একটি বুদ্ধমূর্তি। উত্তর দক্ষিণ কাত হয়ে শায়িত মহামানব গৌতম বুদ্ধের বিশালাকার এ মূর্তিটি দেশের সবচেয়ে বড়। এটির দৈর্ঘ্য একশ ফুট, আর উচ্চতা বিশ ফুট।
ভাবনা কেন্দ্রের পরিচালক ও এ মূর্তির প্রতিষ্ঠাতা করুণাশ্রী থের জানান, অহিংসা, সাম্য ও মৈত্রীর বাণী নিয়ে বৌদ্ধ জাতিকে আলোর পথ দেখান মহামানব গৌতম বুদ্ধ। তিনি শান্তির প্রতীক, বৌদ্ধদের পথ প্রদর্শক। তাই এ মূর্তির নাম দেওয়া হয়েছে বিশ্বশান্তি সিংহ শয্যা গৌতম বুদ্ধমূর্তি। বর্তমানে এটিই রামুর সবচেয়ে আকর্ষণীয় তীর্থস্থান। এটি দেখার জন্য প্রতিদিন এখানে আসছে দেশী বিদেশী অনেক পর্যটক।
তিনি জানান, মূলত ২০০৬ সালের ১৫ অক্টোবর ব্যক্তিগত উদ্যোগে এ বুদ্ধমূর্তি তৈরীর কাজ শুরু করেন। তিন’শটি ধর্মপূজা (থারাপই), তিনশটি মংগলঘট ও প্রদ্বীপ জ্বালিয়ে এ কাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন তৎকালীন বাংলাদেশ ভিক্ষু মহাসভার সভাপতি পন্ডিত সত্যপ্রিয় মহাথের ও ধর্মপাল ভিক্ষু সংসদের সভাপতি প্রয়াত প্রজ্ঞামিত্র মহাথের। এ মূর্তি তৈরীর জন্য কারিগর আনা হয়েছে মিয়ানমারের ইয়াঙ্গুন থেকে। থোয়াইংছি রাখাইনের নেতৃত্বে দীর্ঘ চার বছর কাজ চলার পর এটির নির্মাণ কাজ শেষ হয়। কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধনের আগেই ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে রামুতে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা ঘটে।
ওইরাতে রামুর যে বারটি বৌদ্ধ বিহার হামলার শিকার হয় এরমধ্যে এটি একটি। ওইদিন ভেতরে ককটেল বিষ্ফোরণ ঘটিয়ে এ বুদ্ধমূর্তিটিও ধ্বংস করার চেষ্টা চালানো হয়। এতে মূর্তির বিভিন্নঅংশে ফাটল দেখা দেয়। পরবর্তীতে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে সরকারী উদ্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত সকল বৌদ্ধ বিহার পুননির্মাণ করা হয়। এ সময় এ বিহারটি পুননির্মাণসহ বিহারের চারপাশ সাজানো হয় আকর্ষণীয়ভাবে।
নির্মাণ শিল্পী থোয়াইংছি রাখাইন বলেন,এ মূর্তির মডেল সংগ্রহ করা হয়েছে মিয়ানমারের ইয়াঙ্গুনের ধাম্মাদূত বৌদ্ধ বিহার থেকে। ওই মন্দিরে সংরক্ষিত গৌতম বুদ্ধের মূর্তির আদলে এটি নির্মান করা হয়েছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এ মূর্তির নির্মাণশৈলী দেশী বিদেশী সকল মানুষকে আকৃষ্ট করবে এবং দেশের পর্যটন শিল্পের প্রসার ঘটাবে।
ঈদের ছুটিতে ঢাকা শ্বশুর বাড়ি থেকে রামু বেড়াতে আসেন ইংলিশ মিডিয়াম শিক্ষক উমে রাখাইন। দেখতে যান এ মূর্তিটি। তার অনুভূতি – ‘রামুতেই আমার বেড়ে ওঠা হলেও দীর্ঘদিন ধরে আছি ঢাকা শহরে। তাই রামুতে এসে অবশ্যই ভাল লাগছেই,বিশেষ করে গৌতমবুদ্ধের এ মূর্তিটি দেখে সত্যিই আমি অভিভূত হয়েছি। বিহার এবং এ মূর্তির চার পাশের সাজানোগুছানো পরিবেশ অসাধারণ লাগছে’।
রামু প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি খালেদ শহীদ জানান,রামুর শ্রীকুল,লামারপাড়া,হাজারীকুলসহ বিভিন্ন স্থানে প্রায় বিশটি প্রাচীন বৌদ্ধ বিহার দেখা মেলে। এরমধ্যে ২০১২ সালের ঘটনায় কয়েকটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
যে কয়েকটি প্রাচীন পুরাকীর্তি এখনো বর্তমান এসব বিহারের অপূর্ব স্থাপত্য শৈলী খুব সহজেই মানুষকে অভিভূত করে। তাই নতুন এবং পুরনো বৌদ্ধ বিহার মিলে রামু এখন পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় পর্যটন নগরী। যে কারণে বছরের পুরোটা সময় রামুতে দেশী বিদেশী পর্যটকের আনাগোনা দেখা যায়। আমি বলবো,অপূর্ব সুন্দর এসব বৌদ্ধ বিহারের মধ্যে এখন নতুন বিস্ময় এ মূর্তিটি। দেশের সবচে বড় বিশালাকার এ বুদ্ধমূর্তিটির কারণে উত্তরমিঠাছড়ি বিদর্শন ভাবনা কেন্দ্র এখন পর্যটকদের কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থান।
স্থানীয় সংসদ সদস্য সাইমুম সরওয়ার কমল বলেন, সত্যিই মূর্তিটির দেখলেই প্রাণ জুড়িয়ে যায়। বৌদ্ধ পুরাকীর্তির শহর রামুর ইতিহাসে এটি যেন অনন্য সংযোজন। আকর্ষণীয় এ বুদ্ধমূর্তি দেশের পর্যটন শিল্পের বিকাশে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এক সময় শুধু কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত দেখার জন্য পর্যটকেরা কক্সবাজার আসতো। এখন রামু বৌদ্ধ বিহার দেখার জন্য আসছে। আমি বলবো রামু এবং কক্সবাজার যেখানে আসেন না কেন পাহাড়চৃড়ার এ বুদ্ধ মূর্তিটি না দেখলে তাদের ভ্রমণই অসম্পূর্ণ হবে।
দক্ষিণ চট্টগ্রামের বৌদ্ধদের সর্বোচ্চ ধর্মীয় গুরু পণ্ডিত সত্যপ্রিয় মহাথের জানান, সম্রাট অশোকের ঐতিহাসিক রাংকূট বনাশ্রম বৌদ্ধ বিহার, লামার পাড়া ক্যাং, চেরাংঘাটা বড়ক্যাং, লালচিং বা কলকিত্যাচিং, সাদাচিং সহ অপূর্ব স্থাপত্য শৈলীতে তৈরী বেশকিছু প্রাচীন বৌদ্ধ বিহার ও কিছু কিছু ঐতিহাসিক স্মৃতি চিহ্নের জন্য রামুকে পুরাকীর্তি ও প্রত্মতাত্তক নিদর্শনের পুণ্যভূমি বলা হয়। দৃষ্টি নন্দন বিশাল এ মূর্তি আর ও নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এটি শুধু রামু কক্সবাজার নয় বাংলাদেশের গৌরবময় কীর্তি।
কিভাবে আসবেন :
ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে এসি,ননএসি বাসে করে রামুতে আসা যায়। এখানে আসতে হলে আপনাকে কক্সবাজারের ১৭ কিলোমিটার আগে রামু চা বাগান ষ্টেশনে নামতে হবে। সেখান থেকে রিক্সা অথবা পায়ে হেঁটে যেতে পারেন বিদর্শন ভাবনা কেন্দ্রে। আবার কক্সবাজার থেকেও মিনি বাস, মাইক্রোবাস, সিএন,জি অটো রিকশা করে এখানে আসা যায়। তবে থাকার জন্য এখন রামুতেও কয়েকটি হোটেল-মোটেল ও সরকারি বাংলো রয়েছে। সবচেয়ে ভাল হয়,আপনি কক্সবাজারেই রাত যাপন করলে। তখনই একঢিলে মারা যাবে দুই পাখি। কারণ কক্সবাজারেই তো আছে বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত।