গত এক যুগের ব্যবধানে হারিয়ে গেছে বিশালায়তনের প্রাকৃতিক বনাঞ্চল। বিলুপ্ত হয়ে গেছে বননির্ভর অসংখ্য জাত-প্রজাতির প্রাণী, জীব বৈচিত্র্য, উদ্ভিদ। এ সময়ে শতাধিক বন্য হাতি থেকে বংশ বৃদ্ধির পরিবর্তে লুপ্ত হয়ে ১৫/২০ টিতে দাঁড়িয়েছে। ন্যাড়া হাজার হাজার একর বনভূমি সংশ্লিষ্ট বনকর্মী, হেডম্যান-ভিলেজারদের মৌখিক অনুমতিতে স্ট্যাম্প মূলে বিকিকিনি করে দখল হাতবদল করা হচ্ছে অবাধে। আর এসব কিছু ঘটছে কক্সবাজার দক্ষিণ বনবিভাগের উখিয়াসহ সর্বত্র। এতে বর্তমানে বৈশ্বিক প্রবল সংকট জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতির পরিমাণ প্রবলতর হচ্ছে। কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের কক্সবাজার সদর, রামু, উখিয়া ও টেকনাফের কয়েক লক্ষ একর জুড়ে বিশাল বনাঞ্চল। কক্সবাজার শহরের কলাতলী থেকে হিমছড়ি হয়ে রেজু নদীর উত্তর পাড় উখিয়ার সোনারপাড়া থেকে টেকনাফ সদর পর্যন্ত প্রায় ৮০ কিঃ মিঃ দীর্ঘ এলাকাজুড়ে উত্তর-দক্ষিণ লম্বালম্বি খাড়া পাহাড়, টিলা মিলে ছিল এখানকার সমৃদ্ধি প্রকৃতির বনাঞ্চল। প্রকৃতির অপরূপ খেয়াল গড়ে উঠা বন বিভাগের রক্ষিত পাহাড়ী টিলার এসব বনভূমির উচু, নিচু স্তরে, খাদে রয়েছে অসংখ্য ছরা, খাল ও পুকুর সদৃশ্য জলাশয়। এসবের সাথে সম্পৃক্ত রয়েছে সাগরের। প্রাকৃতিক বিস্তীর্ণ এ বনাঞ্চলকে ঘিরে ছিল শত শত জাত-প্রজাতের পশু-পাখি, জীব বৈচিত্র্য, হরিন, চিতাসহ বিভিন্ন জাতের বাঘ, বানর, হনুমান, বন্য মোরগ, কুকুর, শুকর, একাধিক প্রজাতির টিয়া, বক, ধনেশ, শালিক, চিল, বনমোরগ, মাছরাঙা, কাঠ টুকরা, ময়না, ঘুঘু, হাতি, বাগডাশ সহ শত প্রজাতির বিভিন্ন জীব বৈচিত্র্য পোকামাকড়, গুই সহ অসংখ্য স্তন্যপায়ী। এসব প্রাণী জীব বৈচিত্র্যের অনুকূলে প্রাকৃতিক বনাঞ্চলে ছিল অনেক রকমের ফলজ বৃক্ষ। যেমন-ওরি আম, কাঠাল, গর্জন, তেলসূর, বৈলাম, চাপালিশ, চম্পা, ভাদি, হরিতকি, বহরা, জাম, পিতরাজ, গুটগুইট্টা, জারুল সহ অসংখ্য প্রজাতির পরিবেশ জীব বৈচিত্র্যবান্ধব গাছ-গাছালি, ঔষুধি লতা-পাতা, গুল্মে ভরপুর ছিল বিস্তীর্ণ এ সমৃদ্ধ বনাঞ্চল। এসব গাছ-গাছালির ফলমূল খেয়ে নিরাপদ আশ্রয়স্থল ছিল বন্যপ্রাণী, জীব বৈচিত্র্যের। ৮০ এর দশকেও এখানকার প্রাকৃতিক বনাঞ্চল ছিল সমৃদ্ধ ও বন্যপ্রাণী- পশুপাখির কলরব। কিন্তু ৯০ দশকের শুরু থেকে সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাব প্রতিপত্তি, দুর্নীতি ক্রমান্বয়ে বিশাল আয়তনের বিচিত্র সম্পদে ভরপুর প্রাকৃতিক বন প্রায় সম্পূর্ণ নিঃশেষ হয়ে পড়েছে। তথাকথিত রাজনৈতিক প্রভাবে নেতা-তাঁতী নেতাতের নেতৃত্বে এক শ্রেণির দুর্নীতিবাজ বনসহ সরকারি বিভিন্ন বিভাগীয় দায়িত্বশীল কর্মকর্তা, কর্মচারীদের সহায়তায় গড়ে উঠে একের এক বনদস্যু বাহিনী। কথিত গণতন্ত্রের লেবাসে নিজেদের রাতারাতি টাকাওয়ালা হওয়ার দুরভি সন্ধির সাথে যুক্ত হয় দুর্নীতিবাজ সরকারি বিভিন্ন সংস্থার লোকজন। কার্যত বনজ সম্পদকে পুঁজি করে এসব শ্রেণির লোকজন অবৈধ অর্থের মালিক বনেছে বটে কিন্তু পরিবেশ ও প্রতিবেশের পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতি রোধ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। উখিয়ার সর্বত্র কালের বিবর্তনে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর আশংকাজনক হারে নি¤œমূখী হচ্ছে। স্থানীয় নদী-খাল, ছড়া, পুকুর-জলধারগুলো পলি পড়ে ভরাট হয়ে অগ্রহায়ণ মাসেই শুকিয়ে ধু ধু মরুভূমিতে রূপান্তর হচ্ছে। সমুদ্র উপকুলবর্তী অঞ্চলে মিঠা পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে, সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়ে জোয়ারের পানি অস্বাভাবিক বেড়ে চলছে। প্রাকৃতিক বনাঞ্চল ও বনজ সম্পদ বিলুপ্ত হওয়ায় অসংখ্য জাতের বন্য প্রাণী সমূহ নিরাপদ আশ্রয়স্থল ও খাদ্যাভাবে পড়ে বংশ বিনাশ ঘটছে। প্রাকৃতিক বন নির্ভর অসংখ্য মানুষ আর্থসামাজিক সংকটে পড়ায় দারিদ্রতার ঝুঁকি বৃদ্ধি পাচ্ছে। নদী ও সমুদ্র দূষণ হওয়ায় মৎস্য সংকট তীব্রতর হচ্ছে বলে পরিবেশবিদদের সাথে স্থানীয় ক্ষতিগ্রস্ত লোকজন জানান। বিশাল আয়তনের এখানকার প্রাকৃতিক বনাঞ্চলের পতিত প্রায় ৪০ হাজার একর বনভূমি স্থানীয় সন্ত্রাসী, বনদস্যু শ্রেণি, অবৈধ অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গা ও সামাজিক-রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের জবর দখলে চলে যাচ্ছে। উখিয়ায় এ ধরনের অন্তত ১৫ হাজার রক্ষিত ও সংরক্ষিত বনভূমি বন বিভাগের দখল হাত ছাড়া হয়েছে। বন বিভাগ যদিও প্রতি বছর রাজস্ব খাতের অর্থ ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার ঋণে বিদেশী প্রজাতির সামাজিক বনায়নের নামে কিছু বাগান সৃজনের মাধ্যমে এসব অর্থে শ্রাদ্ধ করছে। বিদেশী প্রজাতির এসব গাছের আশেপাশেও কোন পশু পাখি এমনকি পিঁপড়া পর্যন্তও ভিড়ে না। এসব বনায়ন পরিবেশ ও প্রতিবেশের ক্ষতির পাশাপাশি ত্বরান্বিত করছে বৈকি। কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক মোঃ সরোয়ার আলম বলেন, কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের উখিয়া ও টেকনাফ এলাকায় ব্যাপক হারে বনভূমি জবর দখল, বন উজাড়ের প্রবনতা আশংকাজনক। ইতিমধ্যে অনেক পরিচিত বন্যপ্রাণী, জীব বৈচিত্র্য বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বন বিভাগের একার পক্ষে সীমিত সংখ্যক জনবল নিয়ে বিশাল আয়তনের বনাঞ্চল ও বনভূমি রক্ষা করা কঠিন। তিনি এতদাঞ্চলে প্রাকৃতিকভাবে গড়ে উঠা তেমন কোন বনাঞ্চল বর্তমানে বিদ্যমান আছে বলে জানাতে পারেননি। উখিয়ার ইনানী রক্ষিত বনরক্ষা সহায়ক কমিটির সভাপতি অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী বলেন, ঐতিহ্যবাহী বিশাল প্রাকৃতিক বনের আর তেমন অস্থিত্ব¡ খুঁজে পাওয়া কঠিন। প্রাকৃতিক বন ধ্বংসযজ্ঞের মাঝেও ইনানী রক্ষিত বন সহায়ক কমিটির শত শত স্বেচ্ছাসেবক নতুন নতুন বনায়ন সৃজনে কাজ করছে। একই সাথে এসব বন নির্ভর স্বেচ্ছাসেবী সমিতিগুলোর নিজেদের দায়িত্বে সরকারি ও অন্যান্য বনাঞ্চল পাহারা দিয়ে বন উন্নয়ন ও আর্থ সামাজিক উন্নয়নে সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, বৃটিশ আমলের অচল বন আইন সংশোধন করে কঠোরতা অবলম্বন না করা পর্যন্ত অথবা বন বিভাগের সরকারি বনাঞ্চলকে বিশেষায়িত ঘোষনা না করা পর্যন্ত নির্দিষ্ট পরিমাণের এলাকাকে প্রাকৃতিক বনায়নের শর্তে বিভিন্ন দেশের আদলে বন নির্ভর অর্থনীতি ও শিল্পের প্রসার ঘটাতে পারে সংশোধিত বননীতি ও বিধি প্রণয়নের মাধ্যমে।