কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার রত্নাপালং ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের মিয়ানমার সীমান্ত ঘেষা দুর্গম পাহাড়ী এলাকা চাকবৈঠা-করইবনিয়া গ্রামে ২০১২ সালে জঙ্গির অর্থায়ানে মাদ্রাসাটি নির্মাণ করা হয়েছে। এ নিয়ে গ্রামবাসির মধ্যে চরম ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, ওই এলাকার ওমর আলীর ছেলে মোহাম্মদ বেলাল আয়েশা ছিদ্দিকা নামের মাদ্রাসাটি স্থাপন করেন। এটি এখন দারুল হিকমা আল ইসলামিয়া মাদ্রাসা নামে পরিচালিত হচ্ছে। অথচ মাদ্রাসাটির পরিচালককে রহস্যজনক আচারণের কারনে গত দেড় বছর আগে জঙ্গি সন্দেহে পুলিশ তাকে আটক করেছিল। পরে ছাড়া পেয়ে তিনি তাঁর বাবাকে নিয়ে মালয়েশিয়া চলে যান বলে এলাকাবাসি জানিয়েছেন। বুধবার উপজেলা পরিষদ সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত মানবপাচার বিষয়ক শীর্ষক আলোচনা সভায় উপজেলা আওয়ামালীগের সভাপতি, অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী ওই মাদ্রাসার বিতর্কিত কর্মকান্ডের কারণে প্রশাসনকে যাছাই-বাছাই করে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার আহবান জানালে ইউএনও মোহাম্মদ মাঈনুদ্দিন বলেন, বিষয়টি ইতিমধ্যে আমি এবং উখিয়া থানার ওসি মোঃ হাবিবুর রহমান তদন্ত করে দেখেছি, পরবর্তীতে স্থানীয় চেয়ারম্যান নুরুল কবির চৌধুরীকে বিস্তারিত পর্যালোচনা করে একটি রিপোর্ট পেশ করার জন্য ও দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
জানা গেছে, তিনি মালয়েশিয়া থেকে বিভিন্ন জঙ্গি গোষ্টির সাথে আতাত করে অর্থ যোগান দিয়ে যাচ্ছে। ধর্মীয় রীতি অনুয়াযী তাদের কার্যক্রম এলাকাবাসি কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হলে তাদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। মাদ্রাসায় শিক্ষকতায় যারা জড়িত রয়েছেন, এরা সাবাই বহিরাগত। ছাত্রদের মধ্যে অধিকাংশ ছাত্র কক্সবাজার জেলার বাইরের। চাকবৈঠা জামে মসজিদের ইমাম হাফেজ মাওলানা আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘মাত্র ১০০ গজ দূরে একটি জামে মসজিদ থাকার পরও মাদ্রাসাটিতে একটি জামে মসজিদ চালু করা হয়েছে। মসজিদটিকে কেন্দ্র করে ইসলাম ধর্মের কায়দা-কানুন নিয়ে যথেষ্ট বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। সর্বোপরি রোহিঙ্গা জঙ্গি এবং এ দেশীয় অজ্ঞাতনামা লোকজন এখানে কী করছেন সেটা আমাদের অজানাই থেকে যাচ্ছে।’ তিনি বলেন, প্রতি বৃহস্পতিবার নারীদের গোপন বৈঠক, প্রতি শুক্রবার জুমার নামাজে দূর-দূরান্ত থেকে লোকজনের আসা, মসজিদ ও মাদ্রাসার তহবিল এসব নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। মাদ্রাসা-ঘেঁষেই চট্টগ্রাম সরকারি সিটি কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদের বাড়ি। তিনি বলেন, ‘এখানে আসলে কী হচ্ছে বোঝা মুশকিল। যাঁরা পড়াচ্ছেন তাঁদের মধ্যে স্থানীয় বাসিন্দা নেই; যারা পড়ছে তাদের মধ্যেও স্থানীয়দের সংখ্যা নগণ্য। এসব বিষয় সন্দেহের মাত্রাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে।’ তিনি বলেন, গোপনীয় বিষয় যাতে ফাঁস না হয় সে জন্যই হয়তো স্থানীয়দের ঢুকতে দেওয়া হয় না। অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ বলেন, দীর্ঘদিন ধরে শোনা যাচ্ছে, জুমার নামাজে মাদ্রাসাসংলগ্ন মসজিদে অনেক অজানা-অচেনা লোকের জমায়েত হয়। এ তথ্য যাচাই করার জন্য তিনি গত শুক্রবার জুমার নামাজ পড়তে যান ওই মসজিদে। তিনি লক্ষ করেন, অনেক লোক যানবাহন নিয়ে নামাজ পড়তে এসেছে; তারা গ্রামের লোক নয়। মুসল্লিদের মধ্যে স্থানীয় ছিলেন মাত্র চারজন। অন্যরা অচেনা। মসজিদের লোকজন তাঁকে পেয়ে তাঁদের সঙ্গে খাওয়ার জন্য দাওয়াত দেন। প্রতি সপ্তাহে একই স্থানে অনেক লোকের জড়ো হওয়ার পেছনে কোনো উদ্দেশ্য অবশ্যই রয়েছে। অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদের ধারণা, ধর্মীয় বিভ্রান্তির মাধ্যমে একদিকে সমাজে বিরুদ্ধবাদী সৃষ্টি করা হচ্ছে, অন্যদিকে জঙ্গিবাদের প্রসার ঘটানো হচ্ছে। এর প্রতিফলন যথাসময়ে ঘটবে।
মাদ্রাসাসংলগ্ন এলাকার বাসিন্দা কুতুপালং শরনার্থী শিবিরে কর্মরত এনজিও কর্মী সিরাজুল হক বলেন, গত শুক্রবার আমি ওই মাদ্রাসায় জুমার নামাজ পড়তে যাই, ওখানে খুতবারত মৌলভী সাহেবে বিভিন্ন বক্তব্য ইসলাম ধর্মের বিতর্ক সৃষ্টির মতো বক্তব্য প্রদান করেছেন । তিনি খুতবায় বলেন, সাইয়েফি, ,মালেকি মাজহাবের পরে কোন কিছু মাজহাব আমরা অনুসরণ করিনা। এতে তিনি ব্যাপক সন্দেহ পোষন করেন যে, এরা জঙ্গি সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত থাকতে পারে।
স্থানীয় বাসিন্দা মাষ্টার ছৈয়দ বলেন, মাস খানেক আগেও মাদ্রাসায় আটজনের একটি বিদেশি টিম এসেছিল। শুনেছি, তারা পাকিস্তানি। মাঝে মাঝেই এরকম টিম আসে।’ তিনি বলেন, বেলাল আগে থেকেই ধর্মীয় উসকানি দেওয়ার কাজ করছিলেন এলাকায়। তিনি মাঝে মাঝে উধাও হয়ে যেতেন। তাই তিনি ‘রহস্যপুরুষ’। বেলাল ও তাঁর বাবা বর্তমানে মালয়েশিয়ায় রয়েছেন। তিনি আরো বলেন, যে বিষয়টি এলাকাবাসীকে সবচেয়ে বেশি ক্ষুব্ধ করেছে তা হলো, এখানে গোপনে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। নারীদেরও গোপনে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে বলে তাঁর অভিযোগ।
এলাকাবাসিরা আরো অভিযোগ করে বলেন, ‘মাদ্রাসা ও মসজিদ আমাদের এলাকার কিন্তু এসব পরিচালনা করছে রোহিঙ্গা জঙ্গি নেতা হাফেজ দেলোয়ার হোছেন, হাফেজ নুরুল ইসলাম, নাটোর জেলার ফিরোজ, রোহিঙ্গা আলম, উক্ত জঙ্গীদেরকে সার্বিক সহযোগিতা করে আসছে চাকবৈঠা এলাকার মৃত মীর কাশেমের পুত্র ফরিদ আলম, একই এলাকার মৃত অজিউল্লার পুত্র ছৈয়দ হামজা, আর এতে স্থানীয় জামায়াত সমর্থিত এক ইউপি চেয়ারম্যান উক্ত জঙ্গীদের অর্থায়নে পরিচালিত মাদ্রাসাকে প্রত্যেক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে সহযোগিতা করে আসছে বলে জানা গেছে। আর মাদ্রাসা পরিচালনার জন্য আসছে মোটা অঙ্কের বিদেশি টাকা। এলাহী খানাপিনা হয়। মাদ্রাসা ও মসজিদে ধর্মীয় যে আচার ও রীতির প্রচলন রয়েছে তা নিয়ে স্থানীয় আলেম-ওলামাদের বড় আপত্তি রয়েছে। আপত্তিকর কাজও চলে সেখানে।’
রত্নাপালং ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান নুরুল কবির চৌধুরী বলেন, ‘মাদ্রাসাটিকে নিয়ে নানা কথা রয়েছে, এটা ঠিক। জঙ্গি কার্যক্রম চলছে বলেও শুনেছি। আমি এটার বিরুদ্ধে ছিলাম। কিন্তু মাদ্রাসার উদ্যোক্তারা ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় পর্যায়ের কিছু লোকের সঙ্গে গোপন আতাত করে মাদ্রাসাটি পরিচালিত হয়ে আসছে। তবে ইউএনও সাহেবের নির্দেশে বর্তমানে আমি ওই মাদ্রাসার যাবতীয় কার্যক্রম দেখে, স্থানীয় লোকজনের সাথে কথা বলে একটি তদন্ত রিপোর্ট তৈরি করতে যাচ্ছি।
মাদ্রাসা নিয়ে সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন মাদ্রাসার পরিচালক জহিরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ‘প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল মোহাম্মাদ বেলাল মালয়েশিয়ায় আছেন। তিনি সেখান থেকে টাকা পাঠান। আমি মাদ্রাসার দায়িত্বে রয়েছি। এখানে কোনো খারাপ কাজ চলে না। পাশের মসজিদের লোকজন এসব কথা অহেতুক ছড়াচ্ছে।
সম্প্রতি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে মাদ্রাসা সংশ্লিষ্ঠ পরিচালক জহিরুল ইসলাম, দেলোয়ার, ছৈয়দ আলম এবং ফরিদ আলম ৪জনকে আটক নিয়ে এসে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করে।