কক্সবাজার উপকূলে চলছে শুঁটকি তৈরির ভরা মৌসুম। শীতে আবহাওয়া শুষ্ক থাকায় শুঁটকি উৎপাদন যেমন বেশি হয়, তেমনি দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রফতানিও চলে পুরোদমে। তাই উপকূলীয় অঞ্চলের ছোট-বড় সব শুঁটকি মহালগুলোতে এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন জেলে, শ্রমিক ও ব্যবসায়ীরা। আর সরকারী সহযোগিতা পেলে এ শিল্পকে আরও এগিয়ে নেওয়া সম্ভব বলে আশা তাদের।
মাছ শুকিয়ে শুঁটকি বানানোর প্রথা অনেক পুরোনো হলেও বাণিজ্যিকভাবে এর উৎপাদন হয় মূলত দেশের উপকূলীয় এলাকাতেই। কক্সবাজারের নাজিরারটেক এলাকায় মহালগুলোতে এখন শুঁটকি বানানোর ধুম। জেলেরা সাগর থেকে মাছ আনেন। আর তা প্রক্রিয়াজাত করে রোদে শুকিয়ে শ্রমিকরা ব্যস্ত শুঁটকি বানানোর কাজে। শুধুমাত্র এই এলাকাতেই শুঁটকি প্রক্রিয়াকরণ পেশার সঙ্গে জড়িত আছেন অন্তত ৪০ হাজার জেলে ও শ্রমিক। শুঁটকি মহালে কাজ করে বছরের ৯ মাস বেশ ভালই উপার্জন হয় তাদের।
কক্সবাজার নাজিরারটেক শুঁটকি মহাল ছাড়াও জেলার উপকূলীয় এলাকা কুতুবদিয়া, মহেশখালীর সোনাদিয়া, গোরকঘাটা, তাজিয়াকাটা, কুতুবজোম, কুতুবদিয়া উপজেলার বড়ঘোপ, খুদিয়ারটেক, আলি আকবর ডেইল, অংজাখালী, পশ্চিম ধুরুং, টেকনাফ উপজেলার শাহপরীর দ্বীপ, সেন্টমার্টিন, জালিয়াপাড়া, সদর উপজেলার নাজিরারটেক, খুরুশকুল, সমিতিপাড়া, চৌফলদন্ডিসহ বিভিন্ন উপকূলীয় এলাকায় বিপুল পরিমাণ শুঁটকি উৎপাদন হয়ে থাকে।
উপকূলে শুঁটকির রমরমা বাজারকক্সবাজার জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রতিদিন প্রায় ৮ থেকে ১০টি ট্রাক অর্থাৎ ৮০ থেকে ৯০ টন শুঁটকি মাছ ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন এলাকায় বিক্রির জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। যা স্থানীয় খুচরা বাজারে প্রতি কেজি লইট্যা ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা, ফাইস্যা ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা, ছুরি ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকা, ছোট চিংড়ি ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা, ছোট পোয়া ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা, রইস্যা ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা, রূপচাঁদা ১৫০০ থেকে ১৮০০ টাকা, লাক্ষা ১৪০০ থেকে ১৮০০ টাকা, মাইট্যা ৫০০ থেকে ৭০০, বড় চিংড়ি (চাগাইচা) ১৩০০ থেকে ১৫০০ টাকা। এছাড়াও বিভিন্ন প্রজাতির মাছ বিভিন্ন দামে বিক্রি হয়ে থাকে।
এছাড়াও কক্সবাজারের শুঁটকি মহালের মাছের গুড়ি সারাদেশে পোল্ট্রি ফার্ম ও ফিস ফিডের জন্য সরবরাহ হয়ে থাকে। ঢাকার বড় বড় ফিস ফিডের ফার্মসহ দিনাজপুর, নরসিংদী, চট্টগ্রামেও চাহিদা মেটায়। প্রতি মৌসুমে নাজিরারটেক শুঁটকি মহাল থেকে লইট্টা, পাইশ্যা, পোয়া, ছুরি, মাইট্যা, কেচকি, রূপচাঁদসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ বিদেশে রফতানিসহ ক্রয়-বিক্রয় হয়ে থাকে।
কক্সবাজার জেলা মৎস্য অধিদফতর সূত্র জানায়, গত ১৯৭২-১৯৭৩ সালে শুঁটকি রফতানি খাতে সরকারের আয় হয়েছে ১ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। ১৯৮৫-৮৬ সালে আয় হয়েছে ১৬ কোটি ৮ লক্ষ টাকা, ১৯৮৬-৮৭ সালে আয় হয়েছে ১২ কোটি ২৩ লক্ষ টাকা, ১৯৮৭-৮৮ অর্থ বছরে ১৫ কোটি ২৩ লক্ষ টাকা, ১৯৮৯-৯০ অর্থ বছরে ২৩ কোটি ৯৬ লক্ষ টাকা, ১৯৯০-৯১ অর্থ বছরে ২৭ কোটি ১৮ লক্ষ টাকা, ২০০৭-০৮ অর্থ বছরে ৬১ কোটি ৯ লক্ষ টাকা, ২০০৮-০৯ অর্থ বছরে ৮২ কোটি ১৫ লক্ষ টাকা, ২০০৯-১০ অর্থ বছরে ৯১ কোটি ৬ লক্ষ টাকা, ২০১০-১১ অর্থ বছরে ১০২ কোটি, ২০১১-১২ অর্থ বছরে ১২২ কোটি টাকা, ২০১২-১৩ অর্থ বছরে ১৩০ কোটি টাকা, ২০১৩-১৪ অর্থ বছরে ১৩৫ কোটি টাকা ও ২০১৫-২০১৬ অর্থ বছরে ১৫০ কোটি ছাড়িয়ে যাবে এমনটিই আশা করছেন সংশ্লিষ্ট সূত্র।
কক্সবাজার শহরের বিশিষ্ট শুঁটকি ব্যবসায়ী ও পৌর কাউন্সিলর এসআই আক্তার কামাল, নাজিরারটেক মৎস্য ব্যবসায়ী বহুমুখী সমবায় সমিতির সভাপতি শাহাদাত উল্লাহ, সাধারণ সম্পাদক খালেদ বিন জাহেদ, শুঁটকি মহালের শ্রমিক নুরুল কাদের, মোহাম্মদ শহিদুল্লাহ, মোহাম্মদ কায়সার, সরওয়ার আলম ও শফিউল আলম শফিকসহ অনেকেই জানান, শহরের এডিবি হ্যাচারী হতে নাজিরারটেক পর্যন্ত সড়ক মেরামত, অবকাঠামো উন্নয়ন ও আধুনিকায়ন হলে পরিবেশ বান্ধব এ মহাল সরকারী রাজস্ব খাতে আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
এছাড়া, কীটনাশক ঔষধ ব্যবহার বন্ধ, স্বাস্থ্য সম্মত উপায়ে শুঁটকি তৈরি, বর্ষা মৌসুমে শুঁটকি তৈরির প্রযুক্তি সরবরাহ এবং এই খাতে ঋণ প্রাপ্তি নিশ্চিত করা গেলে শুঁটকি রফতানিতে অনায়াসে ১শ’ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব হবে বলে মনে করেন শুঁটকি ব্যবসায়ীরা।
কক্সবাজার জেলা মৎস্য কর্মকর্তা অমিতোষ সেন জানান, শুধুমাত্র শহরের কুতুবদিয়াপাড়ার ১৬টি মহল্লার ৪০ হাজার জেলে ও শ্রমিক এ পেশার সঙ্গে জড়িত। এছাড়াও জেলার বিভিন্ন এলাকার ৫ হাজার পরিবার শুঁটকি ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত। প্রতিদিন ৫ হাজার নারী-পুরুষ শ্রমিক শুঁটকি শুকানোর কাজে জড়িত থাকে। শতাধিক ছোট বড় মাছের বোট, মৎষ্য আহরণ করে কূলে ভীড়ে থাকে। প্রতি বছর ৯ মাস পর্যন্ত এ মহালে শুঁটকি উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণ হয়ে থাকে। শহরের কুতুবদিয়াপাড়ার ৯৫ ভাগ লোকজনসহ অন্যান্য এলাকার ব্যবসায়ীরাও শুঁটকি ব্যবসাকে কেন্দ্র করে তাদের পরিবারের ব্যয়-ভার বহন করে থাকে। এ শুঁটকি মহালে ৫ হাজার নারী-পুরুষ শ্রমিকসহ অর্ধ লক্ষাধিক জনসাধারণ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত রয়েছে।