এক সারিতে সাজিয়ে রাখা চারটি কফিন। চারজন করে শিক্ষার্থী ধরে কাঁধে নিলেন একেকটি কফিন। শুরু করলেন হাঁটা। তাঁদের পেছনে শতাধিক শিক্ষার্থী। সবার মুখে স্লোগান ‘চুপ করে থাকলে, খুন হবে এভাবে’, ‘আমার স্যার মরল কেন, প্রশাসন জবাব চাই’, ‘খুনিরা ঘুরছে কেন, প্রশাসন জবাব চাই’।
গত এক যুগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারজন অধ্যাপককে নৃশংসভাবে খুনের প্রতিবাদে চারটি কফিন নিয়ে প্রতীকী এ মিছিল শিক্ষার্থীদের। আজ সোমবার বেলা সাড়ে ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ কলা ভবনের সামনে ‘মুকুল প্রতিবাদ ও সংহতি মঞ্চ’ থেকে কফিন মিছিলটি শুরু হয়ে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে। আর কোনো শিক্ষক যেন খুন না হন, আর কোনো কফিন যেন শিক্ষার্থীদের কাঁধে না ওঠে, তারই দাবি জানালেন শিক্ষার্থীরা।
মিছিলটি ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবনের সামনে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির অবস্থান ধর্মঘটে গিয়ে শেষ হয়। দুপুর ১২টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত অবস্থান ধর্মঘট পালন করেন শিক্ষকেরা। এতে বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা অংশ নেন।
অবস্থান ধর্মঘটে সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক নীলুফার সুলতানা বলেন, ‘অধ্যাপক রেজাউল করিম হত্যার পূর্বে অনেককেই হত্যা করা হয়েছে। আর কত মৃত্যু হলে আমরা জাগবো, সুশীল সমাজ জাগবে? প্রতিনিয়ত আমাকে ভাবতে হচ্ছে, আমাকে মেরো না, আমি সেতার বাজাই না, আমি মুক্ত চিন্তা করি না, আমি নাস্তিক না। আমি কি স্বাধীন? অধ্যাপক রেজাউল করিম কি স্বাধীন ছিলেন? আমি স্বাধীন নই; আমার কথা বলার অধিকার নেই; আমরা সবাই চূড়ান্ত নৈরাজ্যের মধ্যে বাস করছি। আমরা এসব হত্যাকাণ্ডের শেষ চাই।’
প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক আনন্দ কুমার সাহা বলেন, ‘যখনই মুক্তির কথা বলা হয় তখনই হত্যার সম্মুখীন হতে হয়। একজন পুলিশ যখন মারা যায়, তখন তাঁকে দেখতে হাসপাতাল, পরিবারের কাছে ছুটে যান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপককে হত্যা করা হলো কেউ তাঁকে দেখতে আসেনি, সহানুভূতি জানাতে আসেনি। তাঁর অপরাধ তিনি মুক্তমনা, তিনি সেতার বাজাতেন? কে হত্যা করেছে, কারা হত্যা করেছে, সে যারাই হোক—আমাদের একটাই দাবি, এ হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই।’
অবস্থান ধর্মঘটে সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক মো. শহীদুল্লাহ বলেন, ‘আজ আমাদের সামনে এখানে চারটি কফিন রাখা হয়েছে প্রতীকী হিসেবে। এই কফিনগুলো আমাদের চারজন শিক্ষকের নৃশংস খুনের চিত্র তুলে ধরছে। এর মাধ্যমে আমরা দেশবাসীকে দেখাতে চাই দেখুন, আমাদের ক্ষত এখনো শুকিয়ে যায়নি। আমরা আমাদের আর কোনো সহকর্মীর কফিন দেখতে চাই না। কিন্তু এই লাশ শেষ লাশ, এই কফিন শেষ কফিন হবে তো?’ প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে তিনি বলেন, ‘আমরা সবাই আজ আতঙ্কগ্রস্ত। অতি দ্রুত এই হত্যাকাণ্ডের বিচার করে আমাদের মনের ক্ষোভ, হতাশা, ভয় দূর করুন।’
শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক শাহ আজম শান্তুনুর সঞ্চালনায় অবস্থান ধর্মঘটে আরও বক্তব্য দেন ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক খন্দকার ইমামুল, প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক তোফাজ্জল হোসেন, সমাজকর্ম বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ছাদেকুল আরেফিন মাতিন প্রমুখ।
শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক শাহ আজম শান্তনু জানান, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আজ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কর্মসূচি পালন করা হয়েছে। আগামীকাল মঙ্গলবার বেলা ১১টায় ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় নেতাদের অংশগ্রহণে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে মহাসমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। একই দিন সন্ধ্যা ৭টা থেকে ১৫ মিনিট বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজলা গেটে প্রদীপ প্রজ্বালন করা হবে জানিয়ে তিনি সারা দেশের মানুষকে নিজ নিজ স্থানে থেকে একইভাবে প্রদীপ প্রজ্বালনের আহ্বান জানান। এ ছাড়া আগামী বুধবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে নিজেদের উদ্বেগের কথা জানিয়ে স্মারকলিপি প্রদানের পাশাপাশি ঘটনার দৃশ্যমান অগ্রগতি না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার কথা বলেন তিনি।
এর আগে সকাল সাড়ে ১০টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ কলা ভবনের সামনে থেকে শোকর্যালি বের করেন ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। মিছিলটি ক্যাম্পাসের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে ‘মুকুল প্রতিবাদ ও সংহতি মঞ্চ’-এ গিয়ে এক ছাত্র সমাবেশ করে। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রীষ্মকালীন ছুটির মধ্যেও তাঁদের আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ও শিক্ষক সমিতির সভাপতি মো. শহীদুল্লাহ। সমাবেশে ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী ও অধ্যাপক রেজাউলের মেয়ে রিজওয়ানা হাসিন শতভি বলেন, ‘আমাদের আগামীতে যেন এভাবে আন্দোলন করতে না হয়, রক্তপাত দেখতে না হয়। এ জন্য এ হত্যাকাণ্ড যারা ঘটিয়েছে, তারা যে–ই হোক না কেন তাদের ধরতে হবে। সরকার যেন দায় সারানোর চেষ্টা না করে সে জন্য সজাগ থাকতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি শুধু আমার বাবাকে হারাইনি। আপনারাও হারিয়েছেন। তিনি শুধু আমার বাবা ছিলেন না, আপনাদেরও ছিলেন। তাই আমাদের বাবাকে যারা হত্যা করেছে, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়া পর্যন্ত আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাব।’
অধ্যাপক রেজাউল করিম হত্যার প্রতিবাদে শিক্ষক সমিতির পূর্বঘোষিত কর্মসূচি হিসেবে আজ সকাল ১০টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মবিরতি পালন করে। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো বিভাগেই ক্লাস-পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়নি। ইংরেজি বিভাগ ও শিক্ষক সমিতির পাশাপাশি অধ্যাপক রেজাউল করিম হত্যার বিচারের দাবিতে বাংলা, সমাজকর্ম, সমাজবিজ্ঞান, প্রাণিবিদ্যা, ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগও ক্যাম্পাসে প্রতিবাদ মিছিল ও মানববন্ধন করেছে।