কামরুন নাহার রুমা:
আমি অবিবাহিতা এবং একদমই একা থাকি। ঘরে সপ্তাহে দুদিন কথা বলার সুযোগ আমার হয় আমার গৃহকর্মীর সাথে। নিজের বাজার সদাই নিজেই করি আর এটা বলতেও দ্বিধা নেই যে যখন বাজার করার সুযোগ হয়ে ওঠে না তখন ছাত্ররা বাজার করে দিয়ে যায়।
আমি কাউকে জোর করি না, ওরা ভালবেসেই দিয়ে যায় (না, না ওদের না, আমারই টাকায়)। ছাত্রছাত্রীরা দল বেঁধে প্রায়ই আমার বাসায় খেতে আসে। আমি একা থাকি ওরা এলে আমার ভালোই লাগে। খায়-দায়, হইচই করে, খুব জ্বালায়, কিন্তু আমি উপভোগ করি সেই যন্ত্রণা। এই যন্ত্রণা বড় মধুর। কিন্তু মনটা খারাপ হয় যখন বাড়িওয়ালি খালাম্মা ডেকে বলেন “তুমি অবিবাহিতা একা একজন মেয়ে, তোমার বাসায় এতো ছেলেরা আসে কেন? আমাকে তো এই সমাজের সবার সাথে মিলেমিশে চলতে হয়; তারা আমাকে অবজেকশন দেয়”।
খালাম্মা কখনওই খেয়াল করে দেখেননি যারা আসে তারা সবাই আমার ছাত্রছাত্রী, আমার বন্ধুও না, আমার প্রেমিকও না। দল বেঁধে না এলে আমি লম্বা সময় ছাত্রছাত্রীদের রাখি না। আর হঠাৎ একা কোনো ছাত্র যদি চলে আসে, আমি তাকে ১০ মিনিটের বেশি থাকতে দেই না। সমাজের বিধিনিষেধ আমি জানি এবং মেনে চলার চেষ্টা করি।
আমি অবিবাহিতা তার মানে এই নয় আমার বন্ধু থাকবে না, আমি একা থাকি তার মানে এই নয় আমার বাসায় কেউ বেড়াতে আসবে না। দিনশেষে আমি মানুষতো !
বিশ্ববিদ্যালয়ে (আমার কর্মস্থল) যাবার পথে প্রায়ই কোন না কোন শিক্ষার্থীর সাথে আমার রাস্তায় দেখা হয়। সে যাচ্ছে পড়তে, আমিও যাচ্ছি পড়াতে। দুজনেরই গন্তব্য এক। আর তাই আমি রিকশায় আমার পাশে তাকে উঠিয়ে নেই, অর্থাৎ ক্যাম্পাস অব্দি তাকে আমি লিফট দেই। সে আমার বিভাগের কিনা, ছাত্র না ছাত্রী ওসব দেখার প্রয়োজন আমি বোধ করি না। একই ঘটনা বাড়ি ফেরার পথেও হয়। সেক্ষেত্রে আমি তাকে তার বাসা বা হোস্টেলের সামনে নামিয়ে দিয়ে তারপর ফিরি।
এই কাজটা আমার ধারণা যেকোনো শিক্ষকই করে থাকেন। এটাতে অন্যায় কিছু নেই, বরং ব্যাপারটা অনেক বেশি মানবিক আর ভালবাসার, যদি সেভাবে ভাবতে পারার মত মানসিকতা আমাদের থাকে। কিন্তু ছাত্রদেরকে লিফট দেয়া নিয়েও আমাকে কথা শুনতে হয়েছে, এখনও হয়।
কারণ একটাই, আমি অবিবাহিতা। একজন অবিবাহিতা শিক্ষিকা কেন একজন ছাত্রকে রিকশায় তার পাশে বসাবে? আমি যে ছাত্রীদেরও পাশে বসাই ওটা কারো নজরে আসে না। আর আমার ছাত্রছাত্রী তো আমার সন্তান, আমার বন্ধু, আমার ভাই অথবা বোন – আমার ছাত্র আমার প্রেমিক তো নয়!
আমি খুব ঘুরতে পছন্দ করি। একাতো আর ঘোরা যায় না তাই দেখা যায় ছাত্রছাত্রীরাই আমার সফরসঙ্গী হয় ৯৯.৯৯ ভাগ ক্ষেত্রে। সেটা নিয়েও আমাকে বিস্তর কথা শুনতে হয় শিক্ষিত মানুষজনের কাছে। আমি একজন অবিবাহিতা, ইয়াং শিক্ষিকা! আমি কেন ছেলেদের নিয়ে এতো ঘুরাঘুরি করি! কোথায় লেখা আছে একজন অবিবাহিতা, ইয়াং শিক্ষিকা ছাত্রদের নিয়ে ঘুরাঘুরি করতে পারবে না!
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে আমার একটা আইডি আছে। সেখানেও আমার স্ট্যাটাস সিঙ্গেল দেয়া। আর তাতেই যতো বিপত্তি। আমি কেন এখনও বিয়ে করছি না, প্রেমে ব্যর্থ কিনা, আমার শারীরিক চাহিদা আমি কিভাবে মিটাই, আমার বেড পার্টনার আছে কিনা (বলা বাহুল্য না থাকলে সে হতে চায়) ইত্যাদি ইত্যাদি। একজন নারী কেন একা থাকে, কেন বিয়ে করছে না, সেটা তার খুব ব্যক্তিগত ব্যাপার। কাউকে জবাবদিহি করতে সে বাধ্য নয়।
আমি হেপি-গো-লাকি (এই নামে একটা মুভিও আছে) টাইপ একজন মেয়ে। সবকিছুকে সরলভাবে দেখতে, সবার সাথে সহজে মিশতে পছন্দ করি। সবাইকে খুব সহজে আপন করতেও ভালবাসতে পারার ক্ষমতা এবং যোগ্যতা দুটোই আমার আছে। আমি ভীষণ বর্ণিল এবং “ফুল অফ লাইফ” একজন মানুষ। আমার উচ্ছলতা, সহজতা, সরলতা দেখে অনেকেই আমাকে খুব সস্তা ভাবে। কিন্তু আমরা ভুলে যাই সহজ মানেই সস্তা নয়।
আমি একা আছি মানেই অশালীন আর বেপরোয়া জীবনযাপন করছি এটা ভেবে নেয়াটা ঘোরতর অন্যায়। অযাচিত আর বেপরোয়া জীবনযাপন করতে অবিবাহিত হওয়া জরুরি না।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কোন নারীর স্ট্যাটাস সিঙ্গেল দেখে যদি পুরুষের মনে হয় “ শী ইজ এভেইলেবল টু স্লিপ উইথ” তাহলে সেটা তার মানসিক বিকারগ্রস্ততা। আর্থিকভাবে স্টেবল সিঙ্গেল কোন নারী রোজ সিনা টান করে চলাফেরা করলে যদি কেউ হিংসায় জ্বলে, তবে সেটা তার ব্যর্থতা।
একজন সিঙ্গেল ফিমেল টিচারকে যদি কোন শিক্ষার্থী মা, বোন বা বন্ধু ভাবতে না পারে, অথবা পিঠ পিছে তার একা থাকা নিয়ে একটা বাজে মন্তব্য করে, তবে সেটা তার লজ্জা। একজন নারী কেন বিয়ে করছে না এই ভাবনায় যদি কোন পুরুষের রাতের ঘুম হারাম হয় তবে সেটা সেই পুরুষের মানসিক দীনতা।
একা থাকা নারী কি গণিমতের মাল নাকি যার যা খুশি বলবে, যা ইচ্ছা আচরণ করবে? একজন নারী যোগ্যতা আর সাধনা দিয়ে একাকিত্বকে আয়ত্ত্বে আনে।
বিশেষ করে মুরুব্বীরা আমাকে প্রায়ই বিয়ে করার কথা বলেন। বিয়ের ভাল দিকগুলো বোঝান। আমার ভালো লাগে। ওনারা ভালবেসে এই কাজটা করেন তাই ভাল লাগে। আবার খোঁচা মেরে বিয়ের কথা বলেন এমন মানুষও আছেন চারপাশে।
আমি বিয়ে বিদ্বেষী না বা পুরুষ বিদ্বেষীও না; প্রেমে ব্যর্থ হয়ে বিয়ে করছি না, তাও নয়। আমি স্বাধীনচেতা আর একা থাকাটা আমার অভ্যাস হয়ে গেছে। আমি একা এটা আমার মনেও হয় না। কিন্তু এই সমাজ আমাকে বারবার মনে করিয়ে দেয় আমি একা, এবং বিয়ে না করে একা থাকাটা মস্ত অপরাধ! মেয়েদের একা থাকতে নেই! কিন্তু কেন?
একজন অবিবাহিতা একা থাকা নারী যদি আর্থিক, মানসিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক কোনভাবেই কারো ক্ষতি না করে নিজের মতো থাকতে পারে, তবে এই সমাজ এবং রাষ্ট্রের তাকে থাকতে দেয়া উচিত। একজন নারীর একা থাকাটা তার অপরাধ নয়, ব্যর্থতাও নয়, একা থাকতে যোগ্যতা লাগে বাহে!
লেখক: জ্যেষ্ঠ প্রভাষক, সাংবাদিকতা ও গণযোগাযোগ বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি