সমাজের অপরাধ দমনের দায়িত্ব যাদের ঘাড়ে সেই পুলিশের মধ্যেই ভীষণভাবে বাড়ছে অপরাধের প্রবণতা। রক্ষক থেকে ভক্ষক হওয়ার পীড়াদায়ক এসব ঘটনায় প্রতিবছর বাড়ছে পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পৃক্ততা। এতে যেমন সম্পৃক্ত হচ্ছেন পুলিশের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা, তেমনই বাদ যাচ্ছেন না সাধারণ সেপাইরাও।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে গত এক বছরেই ৯ হাজার ৯৫৮ পুলিশ সদস্যের শাস্তি হয়েছে। পুলিশ বাহিনীর মোট সদস্যের মধ্যে এদের সংখ্যা এক শতাংশ হলেও বিষয়টাকে নৈতিক স্খলন ও বিভাগীয় আইন-শৃঙ্খলা অমান্য করার মতো ভয়াবহ অপরাধ হিসেবেই দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। গত বছরে অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের মধ্যে ৭৬ পুলিশ সদস্য আবার সরাসরি ফৌজদারি অপরাধেরও আসামি। আদালতে তাদের বিচার চলছে। তাদের চাকুরিচ্যুতও করা হয়েছে।
পুলিশ সদর দফতরের একটি সূত্র জানায়, এ মুহুর্তে পুলিশ বাহিনীতে প্রায় এক লাখ ৬০ হাজার সদস্য রয়েছে। গত পাঁচ বছরে এদের মধ্যে ৭৬ হাজার সদস্যকে অপরাধ ছাড়াও বিভিন্ন অভিযোগে সাজা দেওয়া হয়েছে। এদের বেশিরভাগেরই কর্মচ্যুতি ও কর্তব্যচ্যুতির অভিযোগে বিভাগীয় শাস্তি হয়েছে।
তবে পুলিশের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, ব্যক্তিগতভাবে কোনও পুলিশ সদস্য অপরাধ করলে তার দায় পুলিশ বাহিনী নেবে না। বৃহস্পতিবারও নওগাঁয় পুলিশের আইজি শহীদুল হক এ বিষয়ে কঠোর অবস্থান নেওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণের কথা বলেছেন।
তিনি বলেছেন, অপরাধীদের শাস্তি পেতেই হবে। পুলিশ অপরাধীদের প্রশ্রয় দেয় না। যদি বিভাগীয় তদন্তে কোনও পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে অপরাধ করার সত্যতা মেলে তাহলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এদিকে, পুলিশ সদস্যদের অপরাধ প্রবণতা কমিয়ে আনতে শাস্তি প্রদানের পাশাপাশি নানা উদ্যোগ নিচ্ছে পুলিশ সদর দফতর। পুলিশ সদর দফতর সূত্র বাংলা ট্রিবিউনকে এই তথ্য নিশ্চিত করেছে।
সূত্রটি জানায়, ২০১৫ সালে বিভিন্ন অপরাধে ৯ হাজার ৯৫৮ পুলিশকে বিভাগীয় শাস্তি দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও ৭৬ জনের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অপরাধে থানা এবং আদালতে মামলা হয়েছে। এদের মধ্যে কনস্টেবল থেকে সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) ৭০ জন, উপপরিদর্শক (এসআই) ৪ জন এবং পরিদর্শক ২ জন। যাদের আদালতে বিচার চলছে। তাদের চাকুরিচ্যুত হয়েছে। বাকিদের বিভিন্ন অপরাধে বিভাগীয় দণ্ড দেওয়া হয়েছে। কেউ লঘু দণ্ডে, কেউ কেউ গুরুদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন।
তবে পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলেও সাধারণত তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না এমন অভিযোগও পাওয়া গেছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, পুলিশের কোনও সদস্য কিংবা কর্মকর্তা ফৌজদারি অপরাধ করলে তাকে বাহিনী থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। মামলা দায়ের করে বিচারে সাজা নিশ্চিত করা হয়। ফৌজদারি অপরাধের বাইরে বাহিনীর নিয়ম-শৃঙ্খলা ভঙ্গ করাসহ বিভিন্ন অনিয়মের কারণে বিভাগীয় মামলা দায়ের করে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।
সূত্র আরও জানায়, গত সংখ্যার বিচারে ৬৯ হাজার পুলিশ সদস্য সাজা পেয়েছেন। আর এ সাজা দেওয়া হয়েছে বাহিনীর নিজস্ব আইনে। সাজাপ্রাপ্তদের একটি বড় অংশের বিরুদ্ধে নিয়ম-শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ রয়েছে। কনস্টেবল থেকে উপ-পরিদর্শক (এসআই) পদের সদস্যরা ফৌজদারি অপরাধসহ বাহিনীর অভ্যন্তরীণ নিয়মনীতি লঙ্ঘনে সবচেয়ে বেশি জড়াচ্ছেন। তবে সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) থেকে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বেলায় এই হার একেবারেই নগণ্য।
পুলিশ সদর দফতরের পরিসংখ্যান বলছে, ২০১০ থেকে ২০১৪ সাল এই ৫ বছরে কনস্টেবল থেকে এসআই পদে ৬৩ হাজার ৩৪৯ জনকে লঘুদণ্ড, তিন হাজার ৫৯০ জনকে গুরুদণ্ড, ৪৬১ জনকে বরখাস্ত বা চাকরিচ্যুত ও ১২৩ জনকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। সব মিলিয়ে ৬৭ হাজার ৫২৩ জনের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। একই সময়ে ২৩৪ জন পুলিশ পরিদর্শকের (ইন্সপেক্টর) বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এদের মধ্যে ২০৭ জনকে লঘুদণ্ড ও ২৭ জনকে গুরুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এএসপি থেকে এর ওপরের কর্মকর্তা পর্যায়ে ৪৭ জনকে লঘুদণ্ড, ১২ জনকে গুরুদণ্ড, একজনকে বরখাস্ত ও পরে চাকরিচ্যুত ও তিন জনকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে।
পুলিশ সদর দফতরের হিসেবে ২০১০ সালে কনস্টেবল থেকে এসআই পদ মর্যাদার ১১ হাজার ৩৩ জনকে লঘুদণ্ড, ৫৩৮ জনকে গুরুদণ্ড, ৪৯ জনকে চাকরিচ্যুত ও ৬৪ জনকে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়। ২০১১ সালে ১২ হাজার ৯৭২ জনকে লঘুদণ্ড, ৬১২ জনকে গুরুদণ্ড, ৯০ জনকে চাকরিচ্যুত ও ৩৭ জনকে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়। ২০১২ সালে ১১ হাজার ৭৭০ জনকে লঘুদণ্ড, ৯২১ জনকে গুরুদণ্ড, ১৭৪ জনকে চাকরিচ্যুত ও ১৪ জনকে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়েছে। ২০১৩ সালে ১৩ হাজার ১৭৪ জনকে লঘুদণ্ড, ৭৫৭ জনকে গুরুদণ্ড, ৭৫ জনকে চাকরিচ্যুত ও একজনকে বাধ্যতামূলক অবসর এবং ২০১৪ সালে ১৪ হাজার ৪০০ জনকে লঘুদণ্ড, ৭৬২ জনকে গুরুদণ্ড, ৭৩ জনকে চাকরিচ্যুত ও সাতজনকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে।
অপরদিকে ২০১০ সালে পুলিশ পরিদর্শক পদে ৩৪ জনকে লঘুদণ্ড ও ১০ জনকে গুরুদণ্ড, ২০১১ সালে ৩৭ জনকে লঘুদণ্ড ও আটজনকে গুরুদণ্ড, ২০১২ সালে ৪৫ জনকে লঘুদণ্ড ও একজনকে গুরুদণ্ড, ২০১৩ সালে ৩৬ জনকে লঘুদণ্ড ও তিনজনকে গুরুদণ্ড এবং ২০১৪ সালে ৫৫ জনকে লঘুদণ্ড ও পাঁচজনকে গুরুদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে পাঁচ বছরে এএসপি থেকে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা পদে ৪৭ জনকে লঘুদণ্ড, ১২ জনকে গুরুদণ্ড, একজনকে চাকরিচ্যুত এবং তিনজনকে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়।
পুলিশ বাহিনীর নিজস্ব আইনে তদন্ত পরবর্তী অভিযোগ প্রমাণ সাপেক্ষে সাজা প্রদান করে পুলিশ সদর দফতরের ডিসিপ্লিন অ্যান্ড প্রফেশনাল স্ট্যান্ডার্ড শাখা। গুরুদণ্ড সাজার মধ্যে রয়েছে বেতন কর্তন ও এক পদ নিচে নামিয়ে দেওয়া। লঘুদণ্ড হচ্ছে ভবিষ্যতের জন্য তিরষ্কার ও সতর্ক করা। আর তদন্তে অভিযোগ প্রমাণ না হলে অব্যাহতি দেওয়া হয়। তবে দণ্ডপ্রাপ্তদের অনেকেই উচ্চ আদালতে রিট করে চাকরিতে বহাল রয়েছেন।
অপরাধে জড়িত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ফৌজদারিসহ বিভাগীয় মামলায় বিচারে সাজা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু অপরাধে জড়ানোর হার কমছে না। মাঠ পর্যায়ে কতিপয় পুলিশ সদস্য ছিনতাই, চাঁদাবাজি, ধর্ষণের মতো অপরাধ করছে। তাছাড়া অপরাধী গ্রেফতারে সোর্স হিসেবে যাদের রাখা হয় তাদেরকে ব্যবহার করে পুলিশ সদস্য অপরাধ ঘটাচ্ছে।
গত বছরে সিলেটে শিশু সামিউল আলম রাজন হত্যার ঘটনায় জালালাবাদ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আলমগীর হোসেনকে প্রত্যাহার এবং উপ পরিদর্শক আমিনুল ইসলাম ও জাকির হোসেনকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। শিশু রাজন হত্যার ঘটনায় পুলিশের গাফিলতির কারণে এই শাস্তি দেওয়া হয়। তদন্তে পুলিশের গাফিলতির প্রমাণ মিলেছে বলে জানা যায়।
সর্বশেষ বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা গোলাম রাব্বীকে মারধর, হত্যার হুমকি ও চাঁদার দাবিতে মোহাম্মদপুর থানার এসআই মাসুদ শিকদারকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে পুলিশ তদন্ত করে দেখছে।
এবিষয়ে পুলিশ সদর দফতরের গণমাধ্যম শাখার এআইজি নজরুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাদের সমাজে অপরাধ প্রবণতা বাড়ছে, তাই প্রতিটি সেক্টরেই অপরাধ বাড়ছে। মানুষ যখন প্রলুব্ধ হয় তখন অপরাধ করে। শারীরিক ও মানসিক কারণেও অপরাধ করে থাকে। এসব মৌলিক কারণেই অপরাধ করে মানুষ। শুধু শাস্তি দিয়ে অপরাধ কমানো যাবে না। যে কারণে অপরাধ হয় সেগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। পুলিশ বাহিনী তার জন্য চেষ্টা করছে।’