ফেসবুকে হত্যার হুমকি পেয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়াত অধ্যাপক, প্রথাবিরোধী লেখক ও ভাষাতত্ত্ববিদ ড. হুমায়ুন আজাদের ছেলে অনন্য আজাদ। ২০১৩ সালে ইসলামপন্থিদের তৈরি করা ‘হিটলিস্ট’-এ ৮৪ জন নাস্তিক ব্লগারের তালিকায় তার নামও রয়েছে। ঐ সময় ব্রিটিশ পত্রিকা ‘দ্য গার্ডিয়ান’-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদন বলছে, অনন্য আজাদকে ফেসবুকে হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছে।
হুমকির মুখে প্রাণভয়ে দেশ ছেড়ে গত বছরের জুনের শেষ দিকে অনন্য আজাদ চলে গেছেন জার্মানিতে। জার্মানি থেকে অনন্য আজাদ জানান, ‘আমি হুমকির মুখে জীবন বাঁচাতেই জার্মানি চলে এসেছি। কবে ফিরবো জানি না। দেশে আমি নিরাপত্তা পাইনি। তার প্রশ্ন-একের পর এক এমন নৃশংস হত্যাকান্ড আর কতো দিন দেখতে হবে?’
শুধু তাই নয়, আতঙ্কিত ব্লগার, প্রথাবিরোধী, বিজ্ঞানমনষ্ক, মুক্তমনা লেখক ও তাদের উদ্বিগ্ন পরিবারের স্বজনদের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে-এর পরের টার্গেট কে?
নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, মূলত অভিজিৎ রায়ের হত্যার পর শুরু হয় ব্লগারদের দেশছাড়ার প্রক্রিয়া। এ পর্যন্ত ৩০ জনের বেশি ব্লগার দেশ ছেড়েছেন। তাদের মধ্যে ২০ জন যুক্তরাজ্য, জার্মানি, সুইডেনসহ ইউরোপের দেশগুলোয় রয়েছেন। বাকিরা পাড়ি জমিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায়।
এদিকে, এমন অব্যাহত হুমকির মুখে নানা প্রতিবন্ধকতার কারণ যারা দেশ ছাড়তে পরেননি তারা ঘরে স্বেচ্ছাবন্দি বেছে নিচ্ছেন। নিরাপত্তার জন্য পুলিশের কোনো সহযোগিতা পাচ্ছেন না বলেও অভিযোগ রয়েছে তাদের।
এব্যাপারে পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, হুমকির মুখে ব্লগাররা থানায় জিডি করলেও থানা পুলিশের কিছুই করার থাকে না। তার মতে, এ ধরনের জিডির তদন্ত করা কঠিন। কারণ মোবাইলের কল লিস্ট বা ফেসবুক ধরে তদন্তের প্রযুক্তি থানায় নেই। ডিবির আছে। তবে এ ধরনের জিডির তদন্ত করতে হলে আদালতের অনুমতি নিতে হয়। এই হলো আইনি বেড়াজাল। যার কারণে নিরাপত্তাহীনতায় দেশের ব্লগাররা। খুন হচ্ছে একের পর এক।
এদিকে, প্রতিটি খুনের পরই প্রশ্ন উঠছে_’হু ইজ নেক্সট?’ দেশে একের পর এক নৃশংসভাবে ব্লগার হত্যাকান্ডে ব্লগার ও অনলাইন এক্টিভিস্টদের মনে এখন একটাই প্রশ্ন। শুধু প্রশ্নই নয়, রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতি ধিক্কার ও ঘৃণাসহ তাদের মধ্যে বিরাজ করছে মহা আতঙ্ক। এ আতঙ্ক শুধু ব্লগার ও অনলাইন এক্টিভিস্টদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। তা ছড়িয়ে পড়েছে সর্বস্তরের মুক্তমনা প্রগতিশীলদের মাঝেও। গত দুই দিনে প্রায় সকল ব্লগ ও ফেসবুকে মুক্তমনা লেখকদের পোস্টগুলোতে চোখ রাখলেই বোঝা যায় যেন এক অজানা আতঙ্ক বিরাজ করছে তাদের মাঝে। দুর্বৃত্তদের হাতে অকালে প্রাণ দিচ্ছেন মুক্তচিন্তার এসব মানুষগুলো। ঘটনার পর পরই মামলা হচ্ছে। আটকও হচ্ছেন দু-চার জন সন্দেহভাজন।
কিন্তু বিচারের দীর্ঘসূত্রতা ব্লগার বা মুক্তমনের লেখক হত্যার বিচারের এ দশা পরিবার ও স্বজনদের মাঝে হতাশাই ছড়াচ্ছে। যে কারণে প্রকাশক দীপন হত্যার পর তার বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেছিলেন, আমি কোনো বিচার চাই না। এ একই কথা বলেছেন নিহত ব্লগার অভিজিতের স্ত্রীও। তিনি ব্লগে লিখেছেন, দীপনের বাবার মতো আমিও বিচার চাই না।
বিগত গত তিন বছরে বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠীর সন্ত্রাসীদের হাতে প্রাণ দিয়েছেন ৮ জন ব্লগার। ২০১৩ সালের যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে যখন উত্তাল শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ, ঠিক তখনই ১৫ ফেব্রুয়ারি আহমেদ রাজীব হায়দারকে দিয়ে এ হত্যাকান্ডের শুরু। ব্লগে তিনি ‘থাবা বাবা’ নামে লিখতেন। আর সর্বশেষ গত বুধবার রাত ৯টার দিকে বাসায় ফেরার সময় পুরোন ঢাকার সূত্রাপুরের একরামপুরে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে ও গুলি করে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় আইন বিভাগের সান্ধ্যকালীন বিভাগের ছাত্র ২৭ বছর বয়সী নাজিমুদ্দিন সামাদকে।
এদিকে, নাজিমুদ্দিন হত্যাকান্ডের বিষয়ে গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার বলেছেন, গত বছরেই পাঁচ ব্লগার-লেখক খুন থেকে শুরু করে রিজার্ভ লুট, ধর্ষণ করে হত্যা কোনো ঘটনারই বিচার হয়নি। কুমিল্লায় তনুর ভাইয়ের বন্ধু সোহাগকে অপহরণ করা হলো, প্রতিটি অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার নাজিমুদ্দিন সামাদকে খুন করা হলো। অপরাধীদের ধরা হচ্ছে না, যারা অপরাধের প্রতিবাদ করছে, তাদেরকেই খুন করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, একটার পর একটা ঘটনা ঘটছে, আর আপনারা একদিন আনসারুল্লাহ, একদিন অমুক, একদিন তমুককে দায়ী করে ফাঁকা বুলি দিচ্ছেন। অপরাধীদের ধরায় কোনো আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। তাই আমাদের সন্দেহ জাগে, এই হত্যার পেছনে এমন কেউ আছে, যে কারণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কালো চশমা পরে আছে। তাই নাজিমুদ্দিন হত্যার দায় সরকারের উপরেই বর্তায়।
যদিও ব্লগারদের উপর হামলা শুরু হয় ২০১৩ সালে তবে এর আগে ২০০৪ সাল থেকে প্রথাবিরোধী মুক্তমনা লেখকদের ওপর একই কায়দায় হামলা চালানো হয়। ওই বছর ২৭ ফেব্রুয়ারি রাতে একুশে বইমেলা থেকে বাসায় ফেরার পথে বাংলা একাডেমির সামনে দুর্বৃত্তরা অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের ওপর আক্রমণ চালায় এবং তাকে হত্যার চেষ্টা করে। বিদেশে উন্নত চিকিৎসা নিয়ে কিছুটা সুস্থ হলেও ঐ বছরের ১১ আগস্ট জার্মানিতে মারা যান এই লেখক।
এসব ব্লগার বা মুক্তমনা লেখকদের হত্যাকান্ডের ঘটনায় নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনগুলোই পুলিশের সন্দেহের তালিকায়। সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে বার বার ‘তদন্ত চলছে, আসামি ধরা পড়বে, বিচার হবে’। কিন্তু বাস্তবে বিচারের দীর্ঘসূত্রতা আর নতুন খুনের ঘটনা একটি আরেকটিকে চাপা দিচ্ছে।
গত বছর ২৬ ফেব্রুয়ারি রাতে একুশে বইমেলা থেকে ফেরার পথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় কুপিয়ে হত্যা করা হয় বিজ্ঞানমনষ্ক লেখক অভিজিৎ রায়কে, মারাত্মক আহত হন তার স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা। এ ঘটনায় শাহবাগ থানায় মামলা হলে তদন্তে নেই অগ্রগতি নেই বললেই চলে। পুলিশ জানিয়েছে, অভিজিৎ হত্যাকান্ডের পর ঘটনাস্থল থেকে ১১টি আলামত এফবিআই নিয়ে যায় পরীক্ষার জন্য। তাদের ফরেনসিক পরীক্ষার রিপোর্ট এখনো হাতে না পাওয়ায় অভিজিৎ হত্যার তদন্ত ধীরগতিতে চলছে।
অভিজিৎ হত্যাকান্ডের এক মাসের মধ্যেই ৩০মার্চ রাজধানীর তেজগাঁওয়ে দক্ষিণ বেগুনবাড়িতে সকাল সাড়ে ৯টার কুপিয়ে হত্যা করা হয় ব্লগার ওয়াশিকুর রহমানকে। ঘটনার পর পালানোর সময় জিকরুল্লাহ ও আরিফুল ইসলাম নামের দু’জনকে হাতে নাতে ধরা হয়। এদের একজন পরে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। এ মামলায় পাঁচজনকে আসামি করে ঐ বছরের ১ সেপ্টেম্বর পুলিশ অভিযোগপত্র জমা দেয়। যাদের মধ্যে ৩ জন বর্তমানে কারাগারে আটক রয়েছে।
একই বছরের ৩১ অক্টোবর রাজধানীর আজিজ সুপার মার্কেটের তৃতীয় তলার ১৩২ নম্বর দোকানে জাগৃতি প্রকাশনার স্বত্বাধিকারী ফয়সল আরেফিন দীপনকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। একই দিনে তারা হত্যার চেষ্টা চালায় শুদ্ধস্বর প্রকাশনীর মালিক টুটুল, লেখক রণদীপম বসু ও কবি তারেক রহিমকে। এসব ঘটনার মামলা তদন্তে এখনো কোনো অগ্রগতি নেই।
গত বছর ১২ মে সকালে সিলেটে খুন হন ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশ। তার মামলার এখনো শুনানিই শুরু হয়নি। গত বছরের ৭ আগস্ট রাজধানীর খিলগাঁওয়ে খুন হন ব্লগার নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় ওরফে নিলয় নীল। এই হত্যা মামলাটিরও তেমন কোনো অগ্রগতি নেই বলে জানান তদন্ত কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান।
যদিও ব্লগার হত্যাকান্ড গুলোর মধ্যে শুধুমাত্র আহমেদ রাজীব হায়দারের মামলার রায় হয়েছে গত বছর ৩১ ডিসেম্বর। নিহত রাজীবকে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী কুপিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করার কথা স্বীকার করে আসামিরা আদালতে জবানবন্দি দিলেও সব আসামিকে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়নি। যার কারণে এই রায় প্রত্যাখ্যান করেছে রাজীবের পরিবার ও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন। নিহত রাজীবের বাবা বলেছেন, এ রায় প্রভাবিত। তিনি বলেন, সব আসামি মিলে পরিকল্পনা করে হত্যা করেছে আমার ছেলেকে। প্রত্যেকের কেন ফাঁসি হবে না? মামলায় আট আসামির মধ্যে দু’জনকে ফাঁসির দন্ড দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। এক আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড ও অন্যদের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড দেয় আদালত।