কক্সবাজারের শ্রমবাজার রোহিঙ্গাদের দখলে রয়েছে। দেশী শ্রমিকরা কম মজুরী নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে। ফলে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির কষাঘাতে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে তারা। কক্সবাজার শহরের ফদনার ডেইল এলাকার শ্রমিক নুর হোসেন (৬৫)। তিনি কুতুবদিয়া থেকে ২০ বছর আগে কক্সবাজারে এসেছেন। সংসারে স্ত্রী, ২ কন্যা ও ৩ পুত্র। তিনি বলেন, সংসারে আমি এবং বড় ছেলে ছৈয়দ নুর মাটি কাটা, ঢালাইয়ের কাজ করি। সপ্তাহে ৩ থেকে ৪ দিন কাজ পায়। সকাল ৮ টা থেকে সন্ধ্যা ৬ টা পর্যন্ত কাজ করে প্রতিদিন ৫০০ টাকা থেকে ৬০০ টাকা পায়। কিন্তু সপ্তাহের মধ্যে ২ থেকে ৩ দিন কাজ না পেয়ে বাড়িতে ফিরে যেতে। এতে বাপ-বেটা খুব কষ্টে সংসার চালায়। গতকাল শনিবার সকালে শহীদ সরণীস্থ প্রধান সড়কের পাশে বসে থাকা এ রকম প্রায় সব শ্রমিকেরই একই অবস্থা। শহীদ সরণীস্থ প্রধান সড়কের পাশে বসে থাকা লেবার আহমদ হোসেন (৬০), হোছন (৪৫), জামাল (৫৫) ও জয়নাল আবেদীন (৫৫) অভিযোগ করে বলেন, আমরা সবাই এখানে কাজের জন্য বসে আছি। কিন্তু এখানে লেবারদের সাথে কথা বললে দেখবেন শতকরা ৮০ জন রোহিঙ্গা। এসব রোহিঙ্গাদের কারণে আমরা কাজ পাচ্ছি না। এতে সংসার নিয়ে অনাহারে অর্ধহারে চলতে হচ্ছে। শহরের মাঝিরঘাট এলাকায় ইট ভাঙার কাজ করছেন তসলিমা (৪৫)। পাশেই তার ১০ বছর বয়সী মেয়ে লুনা। সেও ইট ভাঙার কাজ করছে। সংসারে স্বচ্ছলতা আনতে তসলিমার আরেক মেয়ে ফাতেমাও একই কাজ করছে। মা ও মেয়েরা ৩ জনে কাজ করে মাসে ৬ হাজার টাকা আয় করে। তারমধ্যে ২০০০ টাকা ঘর ভাড়া দেয়। বাকি টাকা দিয়ে কোনোমতে সংসার চলে। এভাবে কাজ করে তারা কোনো স্বপ্ন দেখতে পারছেন না। ভবিষ্যৎ বলতে কিছুই নেই। তাদের সংসার অনেকটা দিন আনে দিন চলার মতো চলছে বলে তসলিমা জানান। জানা যায়, বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী উপজেলা টেকনাফ উখিয়ার বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে অবৈধভাবে মিয়ানমার নাগরিকের অনুপ্রবেশ শুরু হয় ১৯৭৮ সাল থেকে। সামরিক সরকারের নির্যাতন ও নিপীড়নের অভিযোগে ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশে রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটে। দ্বিতীয় দফায় রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ হয় ১৯৯২ সালে। এই ২ দফা রোহিঙ্গা শরণার্থীর অনুপ্রবেশের কারণে জেলায় ব্যাপক হারে রোহিঙ্গার আনাগোনা বৃদ্ধি পায়। এছাড়া রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ অব্যাহত রয়েছে প্রায় প্রতিদিন। কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের দেয়া তথ্য মতে, বর্তমান টেকনাফ ও উখিয়ায় পৃথক শরণার্থী ক্যাম্পে তালিকাভূক্ত ৩২ হাজার রোহিঙ্গা রয়েছে। এর বাইরে কক্সবাজার জেলায় ৩ লাখের অধিক রোহিঙ্গা অবৈধভাবে বিভিন্ন স্থানে বসবাস করে যাচ্ছে। অরক্ষিত সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে এসব রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আনাগোনা করে থাকে। পাশ্ববর্তী রাষ্ট্র মিয়ানমারের থেকে নানাভাবে শ্রম পেশার লোকজন বাংলাদেশে চলে আসে। অনুসন্ধানে জানা যায়, কক্সবাজার জেলার অধিকাংশ পেশা রোহিঙ্গারা দখল করে নিয়েছে। কক্সবাজার জেলা শহরে বর্তমানে বৈধ-অবৈধ ৫ হাজার ইজিবাইক (টমটম) ও ৩ হাজার রিক্সা চলাচল করছে। যার মধ্যে ৩ হাজারের অধিক ইজিবাইক ও রিক্সাচালক অনুপ্রবেশকারী মিয়ানমার রোহিঙ্গা। শহরের সমিতি পাড়া, কুতুবদিয়া পাড়া, ফদনার ডেইল, লারপাড়া, কলাতলী, সাহিত্যিকা পল্লী ও নাজিরারটেক এলাকায় শুটকি মহালে শ্রমিকদের মধ্যে সিংহভাগই মিয়ানমারের নাগরিক। নাজিরারটেক শুটকি মহালে কাজ করেন রহিমা খাতুন (৪৯)। তিনি বলেন, শুটকি মহালে প্রতিদিন সকাল ৯ টা থেকে বিকাল ৫ টা পর্যন্ত কাজ করে ২০০ টাকা পেতাম। কিন্তু বর্তমানে বিভিন্ন এলাকা থেকে রোহিঙ্গা শ্রমিকরা কম দামে কাজ করায় ১৫০ টাকার ভিত্তিতে কাজ করতে হচ্ছে। রোহিঙ্গা শ্রমিকরা এখানে এসে আমাদের কাজগুলো কম দামে করায় শুটকি মালিকরা আমাদের মূল্যায়ন করে না। এছাড়া শহরে নির্মাণ শ্রমিক, মাটি কাটা, লেবার ও পরিবহন শ্রমিক হিসেবেও ব্যাপক সংখ্যক রোহিঙ্গা কাজ করে যাচ্ছে। এসব রোহিঙ্গারা শহরতলীর বৈদ্যঘোনা, পাহাড়তলী, সমিতি পাড়া, ফদনার ডেইল, কুতুবদিয়া পাড়া, নুনিয়ার ছড়া, কলাতলী, আলীর জাহাল, বিডিআর ক্যাম্প সহ বিভিন্ন এলাকায় গড়ে উঠা সস্তা মূল্যের ভাড়া বাসায় বসবাস করে শ্রম পেশায় নিয়োজিত রয়েছে। নুনিয়ারছড়াস্থ ফিশারী ঘাটে মাছ আনা-নেয়ার কাজে নিয়োজিত কয়েকজন শ্রমিক জানান, রোহিঙ্গা শ্রমিকরা কম মূল্যে বিভিন্ন শ্রমে নিয়োজিত হচ্ছে। ফলে দেশীয় শ্রমিকদের দিয়ে মালিক পক্ষ কাজ করাচ্ছে না। এতে ক্রমান্বয়ে শ্রম বাজার রোহিঙ্গাদের দখলে চলে যায়। এতে বেকার হয়ে যাচ্ছে দেশীয় শ্রমিকরা। একারণে কিছু কিছু দেশীয় শ্রমিক বেঁচে থাকার প্রয়োজনে রোহিঙ্গাদের মতো কম মূল্যে শ্রম বিনিয়োগ করে থাকে। –