শুরুতে কক্সবাজারের সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে বিনিয়োগ করতে চেয়েছিল চীন। প্রকল্পটি বিলম্বিত হওয়ায় পায়রা বন্দর নির্মাণে আগ্রহী হয়ে উঠেছে দেশটি। বন্দরটি নির্মাণে এরই মধ্যে সরকারের কাছে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ প্রস্তাবও দিয়েছে চীন। নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় ও চীনা দূতাবাস সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
জানা গেছে, কক্সবাজারে দেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে ২০১২ সালের জানুয়ারিতে সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর কর্তৃপক্ষ আইন, ২০১১-এর খসড়া অনুমোদন করে মন্ত্রিসভা। ২০১৪ সালের মাঝামাঝি সমুদ্রবন্দরটি নির্মাণে চীনের সঙ্গে চুক্তি হওয়ার কথা থাকলেও শেষ মুহূর্তে তা পিছিয়ে যায়। এছাড়া জাপানের একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান সমুদ্রবন্দরটি নির্মাণে যে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করেছিল, তাও পুরনো হয়ে গেছে। ফলে নতুন করে আবার সমীক্ষা প্রয়োজন বলে মনে করছে সরকার। সম্ভাব্যতা সমীক্ষার প্রতিষ্ঠান চূড়ান্ত করতে পরামর্শক নিয়োগে দরপত্র আহ্বানের কথা থাকলেও এখনো তা করতে পারেনি নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়।
অন্যদিকে সরকারের আটটি অগ্রাধিকার প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দরও। তাই এ বন্দরেই বিনিয়োগে এখন বেশি আগ্রহী চীন। চীনের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন চায়না হারবারসহ দেশটির আট-নয়টি প্রতিষ্ঠান পায়রা বন্দর নির্মাণে এরই মধ্যে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা এ প্রসঙ্গে বলেন, সোনাদিয়া নিয়ে এখন আর কোনো কাজ হচ্ছে না। আর পায়রার ব্যাপারে এইচআর ওয়েলিংফোর্ডের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে নির্ধারণ হবে কোন দেশের কোন সংস্থা ও কাদের অর্থায়নে কোন কাজ হবে। পায়রা বন্দরকে ঘিরে যে ২০টি কমপোনেন্ট রয়েছে, তা ২০টি সংস্থা বা রাষ্ট্রকে দেয়ার সিদ্ধান্ত রয়েছে। তবে এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে অগ্রাধিকার প্রকল্প মনিটরিং কমিটি।
সূত্রমতে, ১৮ কোটি ৩৬ লাখ টাকা ব্যয়ে পায়রা বন্দরের ধারণাগত মহাপরিকল্পনা তৈরি করেছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা সংস্থা এইচআর ওয়েলিংফোর্ড সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল হাইড্রোলিকস। ধারণাগত মহাপরিকল্পনার প্রতিবেদন এরই মধ্যে জমাও দিয়েছে এইচআর ওয়েলিংফোর্ড।
জানা গেছে, পায়রা গভীর সমুদ্র বন্দরের টার্মিনাল, জেটিসহ অন্যান্য স্থাপনা তৈরি হচ্ছে। এর বাইরে তেল শোধনাগার, বিদ্যুেকন্দ্র, রফতানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল, অর্থনৈতিক অঞ্চল, এক্সক্লুসিভ ট্যুরিস্ট অঞ্চল, বিমানবন্দর ও জাহাজ নির্মাণের ব্যবস্থাও থাকবে। এজন্য জায়গা চেয়েছে সংশ্লিষ্টরা। জমি সংস্থান করতে এরই মধ্যে পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ ভূমি অধিগ্রহণ আইন, ২০১৫ আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় চূড়ান্ত হয়েছে। প্রণয়ন করা হয়েছে পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ আইন, ২০১৩ও।
সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে আগ্রহের কথা ব্যক্ত করেন ঢাকায় নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত মা মিং কিয়াং। ওই অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, পায়রা কিংবা সোনাদিয়া নয়, বাংলাদেশের গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রক্রিয়ায় যেকোনো দেশকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করতেও রাজি চীন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে আগ্রহ দেখিয়েছিল চীনের দুটি প্রতিষ্ঠান। তবে তারা জানে, এটি এখন বাংলাদেশের অগ্রাধিকার প্রকল্প নয়। এজন্যই পায়রার ওপর বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে দেশটি। আর গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে যেকোনো দেশের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার বিষয়েও তাদের নমনীয় অবস্থান দেখা গেছে।
জানতে চাইলে সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ূন কবির বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে কানেক্টিভিটি বাড়াতে চায় চীন। এছাড়া দেশটি নতুন যে ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেছে, সেটিও এর মাধ্যমে গতিশীল করতে চায়।
জানা গেছে, দেশের দুই সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম ও মংলায় বড় জাহাজ (মাদার ভেসেল) প্রবেশে প্রয়োজনীয় গভীরতা নেই। এজন্য গভীর সমুদ্রে ফিডার ভেসেল পণ্য খালাস করে আনতে হয় বন্দর জেটিতে। এজন্যই তৃতীয় সমুদ্রবন্দর হিসেবে পায়রা নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করা গেলে চার হাজার টিইইউএস ক্ষমতাসম্পন্ন কনটেইনারবাহী জাহাজ এ বন্দরে ভিড়তে পারবে।
পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলার লালুয়া ইউনিয়নের রাবনাবাদ চ্যানেলে ২০১৩ সালের ১৯ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পায়রা বন্দরের ভিত্তিফলক উন্মোচন করেন। ২০১৮ সাল নাগাদ পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর দিয়ে পণ্য আমদানি-রফতানির পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। আর পুরো প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন করার লক্ষ্য রয়েছে ২০২৩ সালের মধ্যে।
উল্লেখ্য, প্রাথমিকভাবে পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দরের জন্য প্রায় ৭ হাজার একর জায়গা প্রয়োজন হবে। ৭ হাজার একরের বাইরে লাইট হাউজ নির্মাণ ও রাজপাড়া থেকে পায়রা বন্দর পর্যন্ত চার লেনের সংযোগ সড়ক নির্মাণের জন্যও ভূমি অধিগ্রহণ প্রয়োজন।