এম. ইব্রাহিম খলিল মামুন :
২০১০ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি কক্সবাজারে নৌ-বন্দর নির্মাণে গেজেট প্রকাশ করে সরকার। বাঁকখালী নদীর কস্তুরাঘাট থেকে মহেশখালী চ্যানেল পর্যন্ত দু’পাড়ের এক হাজার ২০০ একর জমিতে নৌ-বন্দর প্রতিষ্ঠায় আনুুষাঙ্গিক কাজও শেষ করে বাংলাদেশ অভ্যান্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিওটিএ)। তবে প্রস্তাবিত জমির অধিকাংশই দখলে থাকায় জেলা প্রশাসন জমি বুঝিয়ে দিতে ব্যর্থ হয়। ফলে পিছিয়ে পড়েছে নৌ-বন্দর স্থাপনের কাজও।
বিআইডব্লিওটিএ’র চট্টগ্রাম আঞ্চলিক কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১১ সালের মে মাসে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন ও বিআইডব্লিওটিএ যৌথভাবে বাঁকখালী নদীর সীমানা নির্ধারণে জরিপ করে। জরিপের পর প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী নদীর দুই পাড়ের অবৈধ দখল উচ্ছেদ করে বিআইডব্লিওটিএ-কে বুঝিয়ে দিতে অনুরোধ করা হয়। তবে নৌ-বন্দরের জন্য নির্ধারিত জমি বুঝিয়ে দিতে না পারায় মন্ত্রণালয়ের স্মরণাপন্ন হয়েছে বিআইডব্লিওটিএ। সম্প্রতি অবৈধ দখলদারদের একটি তালিকা তৈরি করে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছেন তারা।
বিআইডব্লিওটিএ’র সহকারী পরিচালক (বন্দর ও পরিবহন) নয়ন শীল বলেন, কক্সবাজারে প্রস্তাবিত নৌ-বন্দরের জন্য প্রস্তাবিত নদী তীরবর্তী জমি অবৈধ দখলে রয়েছে। জেলা প্রশাসন ও বিআইডব্লিওটিএ যৌথভাবে দখলদারদের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। দখলমুক্ত করতে না পারায় নৌ-বন্দরের গেজেট প্রকাশের ৫ বছর পেরিয়ে গেলেও কাজ শুরু করা যায়নি। নৌ-বন্দর বাস্তবায়িত হলে সরকারি কোষাগারে বছরে ১০-১৫ কোটি টাকার রাজস্ব জমা হতো বলে জানিয়েছেন তিনি।
জানা গেছে, বাঁকখালী নদী দখলের প্রতিযোগিতায় এগিয়ে রয়েছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক নেতা ও প্রভাবশালীরা। তালিকায় ৫১ জনের মধ্যে ১৫টি প্রতিষ্ঠান নদী দখল করে শুটকি, হ্যাচারি, কাঁকড়া ও মাছের খামার গড়ে তুলেছেন। এছাড়া ১০টি প্রতিষ্ঠান দখল করে ভবন নির্মাণ ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের কাছে ভাড়া প্রদান করেছে। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা নদী দখল করে বসতি ভাড়া দিয়েছেন। মূলত নদীর দুই তীরে স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের অবৈধ স্থাপনা থাকায় প্রশাসনের পক্ষ থেকে উচ্ছেদ অভিযান কার্যকর হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছেন পরিবেশবাদীরা।
বিআইডব্লিওটিএ’র তালিকার তথ্য থেকে জানা গেছে, পুরাতন কস্তুরীঘাটে মেসার্স নাগু কোম্পানি নদীর পাড়ের ৯০ বর্গফুট জমি দখল করে বহুতল ভবন নির্মাণ করেছে। বেদারুল আলম নামের এক ব্যক্তি একই পরিমাণ জমি দখল করে স্থাপন করেছে ফ্লাওয়ার মিল। নদীর সবচেয়ে বেশি জমি দখল করেছে যথাক্রমে মেসার্স নয়ন ফিসারিজ ও মেসার্স বিসমিল্লাহ সী ফিস লিমিটেড। প্রতিষ্ঠান দুটির প্রত্যেকে নদীর তীরবর্তী ৪১৭ বর্গফুট জমি দখল করেছে। এছাড়া সাপ্লিমেন্ট এডুকেশন পোগ্রাম, মেসার্স সিদ্দিক কোম্পানি, অ্যাকুয়া কালার লিমিটেড, মিডওয়ে হ্যাচারি, সাগর কোল্ড স্টোরেজ, ফিস মার্ক, মাইশা এগ্রো, মোহনা বরফকল, সোনালী ফিশিং, নূর মোহাম্মদ এন্ড কোম্পানি, কর্ণফুলী সী-ফুড, সিসিডিবি, মেরিন ফিস। এছাড়াও বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান নদীর ৫০ থেকে ৪০০ বর্গফুট জমি দখল করে দোকান, বাসা ভাড়া প্রদান করেছে। এদের অনেকেই নদীর মধ্যে সীমানা তৈরি করে ভবন তৈরির প্রস্তুতি নিয়েছে।
এ প্রসঙ্গে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন বলেন, উচ্চ আদালতের নির্দেশে নদীর দখলদারদের তালিকা তৈরি ও ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে একাধিকবার উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়েছে। বর্তমানে সীমানা নির্ধারণের কাজ চলছে। উচ্চ আদালতে মামলার কারণে নিষেধাজ্ঞা থাকায় উচ্ছেদ অভিযান জোরদার করা যাচ্ছে না। নদীতে জেগে ওঠা চরের জমি বন্দোবস্ত চেয়ে দুটি পক্ষের আবেদনের কারণেও কক্সবাজারের প্রধান এ নদী দখলমুক্ত করার প্রক্রিয়া থেমে আছে বলে জানান তিনি।
কস্তুরাঘাট থেকে মহেশখালী চ্যানেল পর্যন্ত দুই পাড়ের নির্ধারিত জমির মধ্যে কক্সবাজারের ৮২১ একর এবং মহেশখালীর ৪৪৭ একর। ২০১১ সালের ১৮ মে সম্ভাব্য জমি হস্তান্তরের জন্য কক্সবাজার জেলা প্রশাসককে চিঠি দেয় বিআইডব্লিওটিএ। শিল্প প্রতিষ্ঠান ও প্রভাবশালদের দখলে নিরুপায় কক্সবাজার জেলা প্রশাসন। দখলদারদের তালিকা তৈরি হলেও রাজনৈতিক নেতাদের নাম থাকায় উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনায় গতি নেই বলে অভিযোগ উঠেছে।
গতকাল বুধবার সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, নদীর কস্তুরাঘাট, পেশকারপাড়া ও ছয় নম্বর জেটিঘাট ঘুরে দেখা গেছে, শহর থেকে পৌরসভার ট্রাকে করে আবর্জনা এনে ফেলা হচ্ছে নদীতে। ঘাট এলাকায় দখল ও আবর্জনা ফেলায় নদীর প্রস্থ অর্ধেকেরও বেশি অংশ ভরাট হয়ে গেছে। শহরের উত্তর নুনিয়াছড়া থেকে মাঝেরঘাট পর্যন্ত নদীর প্রায় পাঁচ কিলোমিটার তীরবর্তী এলাকায় ভরাট ও দখল তৎপরতা বেশি। কস্তুরাঘাটস্থ বিআইডব্লিউআইটি টার্মিনাল সংলগ্ন নদীর ভরাট জমিতে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন বাণিজ্যিক স্থাপনা। চিংড়িঘের, লবণ উৎপাদনের মাঠ, প্লট বিক্রির হাউজিং কোম্পানি, নৌযান মেরামতের ডকইয়ার্ড, ময়দা ও বরফ কল, শুটকি মহালসহ অসংখ্য টিনশেডের বসতঘর।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) রিট মামলার প্রেক্ষিতে ২০১৪ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর হাইকোর্টের বিচারপতি মির্জা হায়দার হোসেন ও ভবানী প্রসাদ সিংহ এর সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ কক্সবাজারের প্রধান নদী বাকঁখালী দখলদারদের তালিকা তৈরী করে তাদের উচ্ছেদ ও দূষণের উৎস চিহ্নিত করে তা বন্ধের নির্দেশ দেন। পাশাপাশি যেকোন উদ্দেশ্যে নদী ইজারা থেকে বিরত থাকতে ভূমি মন্ত্রণালয়ের সচিব, কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক ১০ সরকারী কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেন। আদালত বাঁকখালী নদীকে কেন প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণা করতে নির্দেশ প্রদান করা হবে না বা কেন প্রাথমিক প্রবাহ অনুযায়ী সীমানা নির্ধারণপুর্বক তা রক্ষা করার নির্দেশ প্রদান করা হবে না, কেন নদীর উভয় তীরের উপকুলীয় বন ফিরিয়ে আনার নির্দেশ প্রদান করা হবে না তা জানতে রুল জারি করে।
বাঁকখালী নদী দখল ও দূষণের বিষয়ে ক্ষোভ জানিয়েছেন পরিবেশবিদরাও। ইয়ুথ এনভায়রণমেন্ট সোসাইটি (ইয়েস) কক্সবাজারের উপদেষ্টা রাশেদুল ইসলাম অভিযোগ করে বলেন, আদালতের নির্দেশের পর প্রশাসন কতিপয় দখলদারের একটি তালিকা তৈরি করে নোটিশ জারি করেছিল। এরপর লোক দেখানো উচ্ছেদ অভিযান চালানো হলেও প্রভাবশালীদের স্থাপনা উচ্ছেদ হয়নি। এতে কক্সবাজারের একমাত্র বাঁকখালী নদী অস্তিত্ব বিলীন হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
একই অভিযোগ করেন পরিবেশ অধিদফতর কক্সবাজারের সহকারী পরিচালক সর্দার শরিফুল ইসলাম। তিনি বলেন, ৮০ কিলোমিটারের বাঁকখালী নদী বাংলাবাজার এলাকা থেকে নুনিয়াছটা পর্যন্ত ১৬ কিলোমিটার অংশে দখলের ঘটনা সবচেয়ে বেশি। নদীটির দখলদারের সংখ্যা এক হাজারের বেশি হলেও প্রশাসন মাত্র অল্প কিছু দখলদারের তালিকা তৈরি করেছে। এরপরও প্রভাবশালী দখলদারদের উচ্ছেদ করা গেলে নদীটি বাঁচানো সম্ভব হবে বলে মনে করেন তিনি।