কক্সবাজার পৌরসভার মধ্যে কোনো কিছুতেই বন্ধ করা যাচ্ছে না পাহাড় নিধন। কারণ, পাহাড় কাটার বিরুদ্ধে মামলা করছে না পরিবেশ অধিদপ্তর।
পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের ভাষ্য, পাহাড় কাটার দৃশ্য দেখা হলেও তাঁরা দখলদারদের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারছেন না। এখন মামলা করতে হলে পরিবেশ অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার অনুমতি লাগে। যখন অনুমোদন আসে, তখন দেখা যায় পাহাড় কাটা শেষ পর্যায়ে।
গত মঙ্গলবার সকালে শহরের ঘোনারপাড়া ও বৈদ্যঘোনা পাহাড় ঘুরে দেখা গেছে, শ্রমিক নিয়োগ দিয়ে প্রকাশ্যে কাটা হচ্ছে সরকারি উঁচু পাহাড়। পৌরসভার মোহাজেরপাড়া, লাইটহাউস, আদর্শগ্রাম, কলাতলী, লারপাড়া, পাহাড়তলী, সিটি কলেজ এলাকার বিভিন্ন পাহাড়ও কেটে সাফ করা হচ্ছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা পাহাড় কাটার দৃশ্য দেখেই ফিরে যাচ্ছেন।
স্থানীয় লোকজন অভিযোগ করেন, ২ এপ্রিল থেকে ঘোনারপাড়ার বিবেকানন্দ স্কুলের দক্ষিণ পাশে কতিপয় প্রভাবশালী উঁচু পাহাড় কেটে সাবাড় করলেও পরিবেশ অধিদপ্তর দখলদারদের বিরুদ্ধে পর্যন্ত কোনো মামলা করেনি। ফলে পাহাড়ের গাছপালা উজাড়ের পাশাপাশি জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে।
জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজারের পরিদর্শক জাহানারা ইয়াছমিন জানান, ৭ এপ্রিল তাঁর নেতৃত্বে পরিবেশ অধিদপ্তরের একটি দল ঘোনারপাড়া ও সিটি কলেজ এলাকায় গিয়ে পাহাড় কাটা প্রত্যক্ষ করে। এ সময় শ্রমিকেরা জঙ্গলে আত্মগোপন করায় কাউকে আটক সম্ভব হয়নি। এরপর দখলদারদের তালিকা সংগ্রহ করে মামলার জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে। সেখানকার অনুমতি পেলে পাহাড় নিধনকারীদের বিরুদ্ধে কক্সবাজার থানায় মামলা করা হবে।
জাহানারা ইয়াছমিন বলেন, ‘পাহাড় কাটার সত্যতা পাওয়া গেলেও আমরা এখন মামলা করতে পারি না। এ ক্ষেত্রে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি লাগে। মামলার অনুমতির জন্য আমরা আবেদন করেছি।’
একাধিকবার চেষ্টা করেও চট্টগ্রাম বিভাগীয় কর্মকর্তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, গত মার্চ মাসে কক্সবাজারের সৈকতের পাশে ‘সৈকতপাড়া পাহাড়’ কেটে পৌরসভা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি আবদুর রহমানের নেতৃত্বে একটি আবাসন প্রকল্প তৈরি হচ্ছিল। ২৮ মার্চ প্রথম আলোয় সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ২৯ মার্চ জেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তর যৌথ অভিযান চালিয়ে ওই আবাসন প্রকল্প থেকে ৮০টি টিনের ঘর উচ্ছেদ করে। কিন্তু গত ১৫ দিনেও আবাসন প্রকল্পের হোতাদের বিরুদ্ধে মামলা করেনি পরিবেশ অধিদপ্তর। এই প্রকল্পে পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তার নামে একাধিক প্লট বরাদ্দের খবর মানুষের মুখে মুখে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক সরদার শরীফুল ইসলাম জানান, দখলদারদের তালিকা তৈরি হচ্ছে। তাই মামলা করতে বিলম্ব হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, শহরের ঘোনারপাড়া, কলাতলী, পাহাড়তলী, সিটি কলেজ এলাকার বিভিন্ন পাহাড় কাটার দায়ে গত তিন বছরে দুই শতাধিক মামলা করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর। তারপরও পাহাড় কাটা বন্ধ হচ্ছে না। জনবলসংকটের কারণে বহু মামলার তদন্তও শেষ করা যাচ্ছে না। এতে পাহাড়ধসে প্রাণহানির ঘটনা বাড়ছে।
পরিবেশবাদী সংগঠন ‘কক্সবাজার ও পরিবেশ সংরক্ষণ পরিষদের’ আহ্বায়ক মাসুদুর রহমান জানান, কক্সবাজার শহরসহ অন্যান্য পাহাড় নিধনের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতের কঠোর নির্দেশনা রয়েছে। তারপরও দিন-রাত সমানে চলছে পাহাড় নিধন। পাহাড় কাটা বন্ধ না হলে এই বর্ষায় পুরো শহরে তীব্র জলাবদ্ধতা দেখা দেবে।
পৌরসভার মেয়র (ভারপ্রাপ্ত) মাহবুবুর রহমান জানান, পাহাড় কাটার মাটি নেমে এসে শহরের নালা ভরাট হচ্ছে। ভরাট হচ্ছে বাঁকখালী নদী। নালা ও শহরের ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কারের বিপরীতে পৌরসভাকে অতিরিক্ত টাকা খরচ করতে হচ্ছে।
কক্সবাজার বাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক আয়াছুর রহমান জানান, পাহাড় কাটার বিরুদ্ধে পরিবেশ অধিদপ্তর অতীতে থানায় দুই শতাধিক মামলা করলেও অধিকাংশ মামলার তদন্ত শেষ হয়নি। ফলে মামলার আসামিরা ধরা পড়ছে না। পরিবেশ আইনের মামলা পুলিশের তদন্ত করার ক্ষমতা থাকলে পরিস্থিতি অন্য রকম হতো।