কক্সবাজার ডিসি সাহেবের বলি খেলায় রামুর দিদার ও উখিয়ার শমশু বলি যৌথভাবে চ্যাম্পিয়ান হয়েছে। ১৬ এপ্রিল শনিবার বিকালে চ্যাম্পিয়ানশীপ ম্যাচে কোন ফলাফল না আসায় মেলা কর্তৃপক্ষ দুজনকে যৌথ চ্যাম্পিয়ান ঘোষনা করে। আর মধ্যো দিয়ে শেষ হয় ২দিনব্যাপি ডিসি সাহেবের বলি খেলা ও বৈশাখী মেলার।
কক্সবাজারে ‘ডিসি সাহেবের বলী খেলায়’ জুয়ারীদের সঙ্গে পুলিশের মধ্যে যেন চলছে লুকোচুরি খেলা। পুলিশে গিয়ে একবার বন্ধ করে দিয়ে আসে তো পরক্ষণেই আবার পসরা সাজানোর মতো বসে জুয়ার আসর।
খোদ জেলা প্রশাসকের নির্দেশ অমান্য করে চলছে প্রকাশ্যে জুয়ার আসর। অথচ প্রশাসন কক্সবাজার জেলা ক্রীড়া সংস্থাকে অনুমতি দিয়েছে বলী খেলা ও মেলা আয়োজনের। কক্সবাজার বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ রুহুল আমিন ষ্টেডিয়াম সংলগ্ন সড়কের পাশে দিনে-রাতে প্রকাশ্যে জুয়ার আসর বসলেও প্রশাসনের সংশ্লিষ্টরা নির্বিকার।
বৃহস্পতিবার বিকাল থেকে বলী খেলা ও মেলার একদিন আগেই বসেছে এসব জুয়ার আসর।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন বলেন, পদাধিকার বলে আমি সভাপতি হলেও মূলত বলী খেলা ও বৈশাখী মেলার আয়োজন-সার্বিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করে জেলা ক্রীড়া সংস্থা। মেলায় জুয়ার আসর বসার খবর শুনে শুক্রবারই তা বন্ধ করতে আমি সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছি।
মেলার আয়োজন ঘুরে দেখা গেছে, ষ্টেডিয়ামের অভ্যন্তরে বলী খেলা এবং বাইরে ষ্টেডিয়ামের সামনের সড়ক পাশে ও কেন্দ্রিয় ঈদগাঁও ময়দানে বসেছে মেলার বিভিন্ন স্টল। আর জুয়ার আসারগুলো বসেছে সড়কের পাশে অবস্থিত টেনিস কোর্টের সামনে। শনিবার বিকালে ১০ টি জুয়ার আসর বসতে দেখা গেছে।
জুয়ার আসর পরিচালনাকারি ব্যক্তি তার সামনে নিয়ে বসে আছেন বাঘ, মাছ, হরিণ ও ঘোড়া সহ বিভিন্ন অংকিত প্রতীকের সমন্বয়ে তৈরী একটি বোর্ড। তিনি একটি পেয়ালা জাতীয় ছোট পাত্র, বোর্ডের প্রতীকগুলো হুবহু অংকিত ষড়ভূজ আকৃতির কয়েকটি বস্তু এবং পেয়ালার নিচে একটি রেখে বিশেষ কৌশলে ঝাঁকতে থাকেন। তা জুয়ার বোর্ডে উপুর করে রেখে পেয়ালটি সরিয়ে নেন। এ পর্যায়ে ষড়ভূজ আকৃতির বস্তুগুলোর উপরিভাগে যে প্রতীকগুলো দেখতে পাবে তা জয়ী বলে ধরে নেয়া হয়। এভাবে বোর্ডের উপর জুয়ার আসর পরিচালনাকারি ব্যক্তি পেয়ালাটি উপুর না করা পর্যন্ত জুয়া খেলায় অংশগ্রহণকারিরা বিভিন্ন প্রতীকের দশ থেকে হাজার টাকার নোট রাখেন।
প্রতিটি জুয়ার আসরের রয়েছে কয়েকজনের সমন্বয়ে আলাদা সিন্ডিকেট। আসর শুরুর প্রথমদিকে সিন্ডিকেটের এসব ব্যক্তিরা সাধারণ অংশগ্রহণকারি সেজে জুয়ার বোর্ডের উপর বিভিন্ন অংকের টাকার নোট রাখতে থাকেন। আসর পরিচালনাকারির বিশেষ কৌশলের কারণে সিন্ডিকেটের এসব লোকজনই জুয়ায় জয়ী হতে থাকেন। এক পর্যায়ে আসর পরিচালনাকারি ব্যক্তি খেলা বন্ধ রেখে চলে যেতে চাইলে সিন্ডিকেটের লোকজন তাকে বাধ্য করে ফের চালু করেন। এরপরও জয়ী হতে থাকেন সিন্ডেকেটের লোকজনই। বিষয়টি লক্ষ্য করে লোভ সামলাতে না পেরে মেলায় আগত সাধারণ লোকজনও জুয়ায় অংশগ্রহণ করতে থাকেন। এক পর্যায়ে সিন্ডিকেটের লোকজনের মতো সাধারণ অংশগ্রহণকারিরাও হারতে থাকেন। এতে জুয়ারীদের প্রতারণার ফাঁদে পড়ে সাধারণ লোকজন আর্থিকভাবে চরম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
প্রকাশ্যে জুয়ার এসব আসর চলছে সকাল থেকে গভীর রাত অবধি।
কক্সবাজার শহরের বৈদ্যঘোনা এলাকার মৎস্য ব্যবসায়ী কামাল হোসেন বলেন, শুক্রবার সকালে কক্সবাজার মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র থেকে মাছ কিনে বাজারে বিক্রির পর আমার আড়াই হাজার টাকার বেশী লাভ হয়েছে। বিকালে সাড়ে ৪ টার দিকে বলী খেলা উপভোগ শেষে ফেরার পথে সড়কের পাশে বেশ লোকজনের জটলা দেখে এগিয়ে যাই।
“ লোকজন জুয়া খেলে জয়ী হয়ে টাকা পেতে দেখে লোভ সামলাতে না পেরে আমিও অংশগ্রহণ করি। খেলার প্রথমদিকে আমি লাভবান হলেও এক পর্যায়ে আমি হারতে থাকি। হারানো টাকা ফিরে পেতে আমি খেলতে থাকলে এক পর্যায়ে ব্যবসার লাভের টাকা সহ মূলধনও জুয়ায় খোঁয়া যায়। ”
কামাল হোসেন জানান, দেখা-দেখি তার ব্যবসায়িক এক অংশীদারও জুয়ায় ৬ হাজার টাকা খুঁয়েছেন।
কক্সবাজার সিটি কলেজের দ্বাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থী আনোয়ার হোসেন বলেন, বলী খেলা উপভোগ করতে আসার সময় আমার বাবা ২ শত টাকা হাতে দেন। লোকজনের জটলা দেখে কৌতুহল বশত জুয়া খেলায় আমি অংশগ্রহণ করি। জুয়ায় সব টাকা হারানোর পর আর কোন টাকা না থাকায় জুয়ারী সিন্ডিকেটের লোকজন আমার ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটিও টাকার অংকে বোর্ডের উপর বসিয়ে দেয়। এক পর্যায়ে আমি জুয়ায় মোবাইলটিও হারিয়ে ফেলি।
মেলার আয়োজকরা জানিয়েছেন, গ্রামীণ ফোনের পৃষ্ঠপোষকতায় এবছর বলী খেলা ও মেলার আয়োজন করা হয়েছে। জেলা ক্রীড়া সংস্থা ব্যবস্থাপনার সার্বিক বিষয়াদি দেখভাল করছেন।
তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি সূত্র জানিয়েছে, জুয়া খেলার পরিচালনা করতে দেয়ার শর্তে জেলা ক্রীড়া সংস্থা প্রভাবশালী একটি সিন্ডিকেটের কাছে ৩ লাখ ৬৫ হাজার টাকায় মেলা আয়োজন ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। বৃহস্পতিবার বিকাল থেকে শুরু হয় এসব জুয়ার আসর। তা আগামী ১৮ এপ্রিল পর্যন্ত চলবে। তবে বলী খেলা চলবে শনিবার পর্যন্ত।
জুয়ার আসর বসানোর ব্যাপারে কথা বলতে জেলা ক্রীড়া সংস্থার কর্মকর্তা ও মেলা আয়োজন কমিটির সদস্য সচিব হেলাল উদ্দিন কবিরের মুঠোফোনে একাধিবার যোগাযোগ করলেও তিনি সাড়া দেননি।
কক্সবাজার সদর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) বখতিয়ার উদ্দিন চৌধুরী বলেন, মেলায় জুয়ার আসর বসার খবরে পুলিশ শুক্রবার বিকাল ও রাতে দুই দফা অভিযান চালিয়ে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এরপরও জুয়ারীরা ফের আসর বসিয়েছে বলে পুলিশ জেনেছে। জুয়ার আসর বন্ধে পুলিশ আবারও অভিযান চালাবে।
শনিবার বিকাল সাড়ে ৪ টার দিকেও মেলা প্রাঙ্গন ঘুরে দেখা গেছে, বেশ জম-জমাটভাবে চলছে জুয়ার আসর। লোকজনের ভীড়ও গত দুইদিনের চেয়ে বেশী। জুয়ার আসরটি বসেছে কক্সবাজার সদর থানা থেকে গাড়ী যোগে ৫ মিনিটের দূরুত্বে।
ওসি মো. আসলাম হোসেনের সঙ্গে কথা বলার আড়াই ঘন্টা পরও জুয়ার আসর বন্ধ না হওয়ার ব্যাপারে কথা বলতে মুঠোফোনে একাধিবার যোগাযোগ করেও সম্ভব হয়নি।