শনির রাহুতে পড়েছে কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগ। আপাতত সময়ে এই রাহুর মুক্তির কোন লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না। ফলে নাবিক-বিহীন তরীর মতো ভাসছে দেশের ঐতিহ্যবাহী এ রাজনৈতিক দলটি। নেতৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় জেলার শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা ‘বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি’ এর মতো অবস্থান নেয়ায় দীর্ঘ ২ যুগেও কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন অনুষ্ঠান করা সম্ভব হয়নি।
কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মি ও বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনের নেতাদের সাথে কথা হলে তারা এমনই অভিমত প্রকাশ করেছেন।
ঢাকায় আজ শনিবার (৯ জানুয়ারী) অনুষ্ঠিত হচ্ছে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রিয় কার্য-নির্বাহী কমিটির সভা। ওই সভায় জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন ও কাউন্সিল নিয়ে সিদ্ধান্ত হওয়ার কথা রয়েছে। কেন্দ্রিয় কমিটির ওই সভাকে ঘিরে জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ অনেক নেতা এখন অবস্থান করছেন ঢাকায়।
জেলা আওয়ামী লীগের সর্বশেষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০০৩ সালের ২০ ডিসেম্বর। সম্মেলনে কাউন্সিলরদের ভোটে ৩ বছরের জন্য গঠিত কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও কক্সবাজার পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান মরহুম একেএম মোজাম্মেল হক এবং সাধারণ সম্পাদক হন সালাহ উদ্দিন আহমদ।
আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মিদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ২০০৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে নির্বাচিত সভাপতি একেএম মোজাম্মেল হকের মৃত্যুর পর থেকে সংগঠনটির উপর ভর করে শনির রাহুদশা। ওই সময় গঠনতান্ত্রিক নিয়মে ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব পান জেলা কমিটির সহ সভাপতি ও উখিয়া-টেকনাফ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী। কিন্তু ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারির বিতর্কিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে (পরে ওই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি) মনোনয়নকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট বিরোধের জের ধরে জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি এডভোকেট একেএম আহমদ হোসেনকে দলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব দেয়া হয়। তখন থেকেই এ পর্যন্ত জেলা আওয়ামী লীগের কর্মকান্ড চলছে ভারপ্রাপ্ত সভাপতির নেতৃত্বে। আর দীর্ঘ ৮ বছরে কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল অন্তত ডজনাধিকবার। সম্মেলন অনুষ্ঠানের ওই উদ্যোগ মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মিদের মাঝে উত্তাপ ছড়ালেও কোন বারই আলোর মুখ দেখেনি।
নেতা-কর্মিদের অভিযোগ, দলে নিয়ন্ত্রণ ও নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় জেলার শীর্ষ নেতারা যে যার মতো ‘গেইম প্ল্যান’ খেলছেন। যখনই কেন্দ্রিয় কমিটির পক্ষ থেকে জেলা কমিটির সম্মেলন অনুষ্ঠানের জন্য নির্দেশ বা উদ্যোগ নেয়া হয়, তখনই নেতৃত্ব প্রত্যাশীরা যার যার মতো খেলা শুরু করে দেন। কোন পক্ষ যখনই দেখেন যে, খেলার মাঠ তার অনুকূলে নয় ; তখন ফাউল খেলে পন্ড করেন খেলা। এধরণের খেলা খেলতে খেলতে দীর্ঘ দুই যুগেও জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন অনুষ্ঠান করা সম্ভব হয়নি। সম্মেলন আয়োজনকে ঘিরে ফাউল খেলার মতো ‘শনির রাহুদশা’ ভর করেছে জেলা আওয়ামী লীগের উপর। যেন হতে গিয়েও হলো না শেষ।
দলের নেতা-কর্মীরা জানান, জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন অনুষ্ঠানের জন্য অন্তত ডজনখানেকবার সিদ্ধান্ত বা উদ্যোগ নেয়া হয়। সর্বশেষ গত ২০১৫ সালের ১ মার্চ প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনা রামু সফরকালে নির্দেশ দিয়েছিলেন ২৮ মার্চের মধ্যে জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন অনুষ্ঠান করার। নির্দেশনা অনুযায়ী, ২৮ মার্চের মধ্যে সম্মেলন শেষ করার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। কিন্তু জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃত্বের মতনৈক্য আর বিরোধের কারণে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়নি। শীর্ষ পর্যায়ের এসব নেতাদের কেউ কেউ কাউন্সিলের পক্ষে আবার কেউ কেউ সিলেকশনের মাধ্যমে নতুন কমিটি গঠনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। ফলে প্রতিবারই সম্মেলনের উদ্যোগ ভেস্তে যায়। এমনকি বর্তমানে জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন আয়োজন করার কোন তৎপরতাও দেখা যাচ্ছে না।
জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা জানান, জেলায় একাধিক প্যানেল ও কেন্দ্রিয় দুই নেতার রশি টানাটানির কারণেই সম্মেলন বার বার পিছিয়ে গেছে। দীর্ঘদিন ধরে সম্মেলন না হওয়ায় গতি ফিরছে না দলে। সৃষ্টি হচ্ছে না নতুন নেতৃত্বও। উল্টো বর্তমান মেয়াদোর্ত্তীণ কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বিতর্কিত ভূমিকায় দলে কোন্দলের সৃষ্টি হচ্ছে। দ্বিধাবিভক্তি দেখা দিয়েছে দলের মধ্যে। দলকে আরো গতিশীল ও নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টির জন্য দ্রুত সম্মেলন ও কাউন্সিল আয়োজন করা জরুরী হয়ে পড়েছে।
জেলা আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরের নেতাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে সভাপতি পদে দুই শীর্ষ নেতা সাবেক সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম চৌধুরী ও বর্তমান সাধারণ সম্পাদক সালাহ উদ্দিন আহমদ দীর্ঘদিন ধরে মাঠে রয়েছেন। তবে সাধারন সম্পাদক পদে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় আছেন কক্সবাজার পৌর আওয়ামীলীগের সভাপতি ও ঝিলংজা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান। তবে তার সাথে নজরুল ইসলাম চৌধুরী নাকি সালাহ উদ্দিন আহমদ প্যানেলভূক্ত হচ্ছেন, তা এখনো স্পষ্ট নয়। আর কখনো সভাপতি কখনো বা সাধারণ সম্পাদক পদে নাম শুনা যাচ্ছে চকরিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান জাফর আলমের। এছাড়া জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনকে ঘিরে নেতৃত্বের প্রতিযোগীতায় নতুন করে সামিল হয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি মরহুম একেএম মোজাম্মেল হকের জৈষ্ঠ্য পুত্র রাশেদুল হক রাশেদ। তিনি সাধারণ সম্পাদক পদে প্রতিদ্বন্ধিতার ঘোষণা দিয়ে পোস্টার সাঁটাই সহ নানাভাবে প্রচারণা চালাচ্ছেন। জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন আয়োজন ও নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় এখন নতুন করে কষা হচ্ছে নতুন অংক। আর এ রকম নতুন খেলার অংকে বার বারই আটকে যাচ্ছে জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন।
তবে সম্মেলন আয়োজন নিয়ে রয়েছে নানা বির্তক ও মতবিরোধ। কক্সবাজার জেলায় আওয়ামী লীগের উপজেলা কমিটি মর্যাদার ১১টি কমিটি রয়েছে। এগুলো হল, কক্সবাজার সদর উপজেলা, কক্সবাজার পৌরসভা, চকরিয়া উপজেলা, চকরিয়া পৌরসভা, মাতামুহুরী সাংগঠনিক উপজেলা, পেকুয়া উপজেলা, কুতুবদিয়া উপজেলা, মহেশখালী উপজেলা, রামু উপজেলা, উখিয়া উপজেলা ও টেকনাফ উপজেলা কমিটি। এর মধ্যে মহেশখালী উপজেলা কমিটির সম্মেলন ছাড়া সবক’টি উপজেলারই সম্মেলন শেষ হয়েছে।
তবে আগামী ১৬ জানুয়ারী মহেশখালী উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন ও কাউন্সিল অনুষ্ঠানের দিনক্ষণ নির্ধারণের কথা জানিয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এডভোকেট একেএম আহমদ হোসেন।
আওয়ামী লীগের গঠতন্ত্র মোতাবেক জেলা কমিটির মেয়াদ হচ্ছে তিন বছর। কিন্তু ৯ বছর আগেই জেলা কমিটির মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও তিনি সম্মেলন আয়োজনের দীর্ঘসূত্রিতার জন্য সব উপজেলা কমিটির সম্মেলন যথাসময়ে অনুষ্ঠান না করাকে দায়ী করেন।
তিনি বলেন, আগামী ১৬ জানুয়ারী মহেশখালী উপজেলা কমিটির সম্মেলন সম্পন্ন করার পর বিষয়টি কেন্দ্রিয় কমিটিকে অবহিত করা হবে। এরপর কেন্দ্রিয় কমিটি যখনই সম্মেলন আয়োজনের নির্দেশনা দেবে তখনই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে।
জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘‘আমি হলাম সম্মেলনে সভাপতি পদে মূল প্রার্থী। যারা নেতৃত্বে আছেন, তারা পদ আঁকড়ে থাকতে সম্মেলন আয়োজনে দীর্ঘসূত্রিতা তৈরী করছেন। এতে সংগঠনের গতিশীলতা ও নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টিতে প্রতিবন্ধকতা তৈরী হয়েছে। সম্মেলন সিলেকশনে বা ইলেকশনের যে আঙ্গিকেই হোক আয়োজন করা অতীব জরুরী হয়ে পড়েছে।
তবে তুলনামূলকভাবে তিনি সিলেকশন নির্ভর সম্মেলনের পক্ষে না বলে জানিয়ে বলেন, ‘‘এ রকম আয়োজনের মধ্যে নেতা-কর্মিদের মধ্যে কোন উৎসাহ-উদ্দীপনার সৃষ্টি হয় না। সৃজনশীল ও নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টি করতে হলে ইলেকশন পন্থাই উত্তম পথ।’’
মহেশখালী উপজেলা কমিটির সম্মেলন শেষ করার পর জেলা সম্মেলন আয়োজনের ইঙ্গিত দিয়ে নজরুল ইসলাম চৌধুরী জানান, শনিবার ( ৯ জানুয়ারী ) আওয়ামী লীগের কেন্দ্রিয় কমিটির সভা রয়েছে। সম্ভাব্য সম্মেলনকে বাধাগ্রস্ত করতে ইতিমধ্যে জেলা কমিটির অনেক নেতা নতুন মিশন নিয়ে ঢাকায় অবস্থান করছেন। এব্যাপারে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মিদের তিনি সতর্ক থাকার আহবান জানান।
দীর্ঘদিন ধরে জেলা কমিটির সম্মেলন অনুষ্টিত না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে কক্সবাজার পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা কমিটির কাউন্সিলে সাধারণ সম্পাদক পদে প্রতিদ্বন্ধি মুজিবুর রহমান বলেন, ‘‘দীর্ঘদিন ধরে জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত না হওয়ায় সংগঠনের গতিশীলতায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। ফেব্রুয়ারী মাসে জেলা কমিটির সম্মেলন আয়োজনের প্রক্রিয়া চলছে। সিলেকশন বা ইলেকশন যে আঙ্গিকেই কাউন্সিল হোক না কেনো দ্রুত সম্মেলন অনুষ্ঠান জরুরী হয়ে পড়েছে।’’
জেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান প্রবীন নেতৃত্ব পদ আঁকড়ে থাকতে কাউন্সিলের আয়োজন করছেন না বলে অভিযোগ তুলে চকরিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান জাফর আলম বলেন, “সম্মেলন ও কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হলে বর্তমান নেতৃত্ব ছিটকে পড়বেন। জেলা কমিটিতে নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টিকে বাধাগ্রস্ত করে তারা সম্মেলন আয়োজনে দীর্ঘসূত্রিতা তৈরী করছেন।”
জেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক সহ জেলা কমিটির অনেক নেতার ধারণা সম্মেলন ও কাউন্সিল হলে তারা নতুন কমিটিতে আসতে পারবেন না এই ভয়ে আয়োজন নিয়ে কোন মাথা ব্যাথা নেই দাবি করে সাধারণ সম্পাদক পদ প্রত্যাশী জাফর আলম বলেন, “বর্তমান সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক মনে করেন- একদিন বেশী থাকতে পারলেও অন্তত একটা দিনের হলেও আখের গোছানো যাবে। তাছাড়া জেলা আওয়ামী লীগের কমিটিতে মহেশখালীর নেতারা এবং ওই এলাকার সংসদ সদস্য আশেক উল্লাহ রফিকও চান না দ্রুত সময়ে সম্মেলন ও কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হোক। কারণ বর্তমান কমিটির অধিকাংশ নেতাই জানেন, কাউন্সিল হলে তারা নতুন কমিটির নেতৃত্বে আসতে পারবেন না। ওই জন্য জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন ও কাউন্সিলকে বাধাগ্রস্ত করতে তারা মহেশখালী উপজেলা কমিটির সম্মেলন আয়োজন করছেন না।”