আহমদ গিয়াস:
কক্সবাজারের বনাঞ্চল দিনদিন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এরফলে হারিয়ে যাচ্ছে বনাঞ্চলের প্রাণীকূলও। ইতোমধ্যে কক্সবাজার অঞ্চল থেকে বাঘ, ময়ূর ও সোনা ব্যাঙ হারিয়ে গেছে। এখন বিলুপ্তির পথে রয়েছে হরিণ, হাতি ও পরিবেশ বান্ধব পাখি প্যাঁচা। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, বনভূমি দখল, নির্বিচারে বনভূমির গাছ কর্তন, পাহাড় কেটে বসতি স্থাপন ও এক শ্রেণীর বিকৃত মনের মানুষের বণ্যপ্রাণী শিকারের প্রবণতাসহ নানাবিধ কারণে এসব বণ্য প্রাণী বিলুপ্ত হচ্ছে বলে মনে করেন কক্সবাজারের বনকর্মকর্তারা।
জানা যায়, বাস্তুসংস্থানিক বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে বাংলাদেশের বনভূমি ‘ক্রান্তীয় আদ্র চিরসবুজ’, ‘ক্রান্তীয় আধা-চিরসবুজ’, ‘ক্রান্তীয় আদ্র পত্রমোচী’, ‘জোয়ারধৌত বন’ ও ‘কৃত্রিম বন’ শ্রেণীতে ভাগ করা। আর কক্সবাজারের বনাঞ্চল মূলত ‘ক্রান্তীয় আদ্র চিরসবুজ বন’ (Troppical wet evergreen forest), ‘ক্রান্তীয় আধা-চিরসবুজ বন’ (Tropical Semi-evergreen forest) ও ‘জোয়ারধৌত বন’ শ্রেণীর অন্তর্ভূক্ত। ‘ক্রান্তীয় আদ্র চিরসবুজ বন’ এর শ্রেণীভূক্ত বনগুলোতে সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্যসহ চিরসবুজ গাছগাছালির প্রাধান্য রয়েছে। এ বনে আধাচিরসবুজ ও পত্রমোচী বৃক্ষও বিদ্যমান। তবে তাতে বনের চিরসবুজ প্রকৃতি বদলায় না। এখানে ৪৫ থেকে ৬২ মিটার লম্বা বৃক্ষও রয়েছে। এখানবার আদ্র ছায়াঢাকা স্থানে পরাশ্রয়ী অর্কিড, ফার্ন ও ফার্নজাতীয় উদ্ভিদ, লতা, মস, কচু, বেত ইত্যাদি প্রায় সর্বত্রই জন্মে। গুল্ম, বীরৎ ও তৃণ সহ এ বনে প্রায় ৮০০ প্রজাতির বেশি সপুষ্পক উদ্ভিদ রয়েছে। সর্বোচ্চ ছাউনি (canopy) সৃষ্টিকারী কালিগর্জন, ধলিগর্জন, সিভিট, ধুপ, কামদেব, রক্তন, নারকেলি, তালী, চুন্দাল, ঢাকিজাম ইত্যাদি সাধারণ চিরহরিৎ বৃক্ষ প্রজাতি এখানকার বনে দেখা যায়। চাঁপা, বনশিমুল, চাপালিশ, মাদার ইত্যাদি আধাচিরহরিৎ ও চিরহরিৎ বৃক্ষ বিক্ষিপ্তভাবে জন্মায়। পিতরাজ, চালমুগরা, ডেফল, নাগেশ্বর, কাউ, গোদা, জাম, ডুমুর, করই, ধারমারা, গামার, তেজবল, মদনমাস্তা, আসার, মুস, ছাতিম, তুন, অশোক, বড়মালা, ডাকরম, বুরা ইত্যাদি দ্বিতীয় স্তরের ছাউনি সৃষ্টিকারী উদ্ভিদও রয়েছে। মাঝে মাঝে Gnetum I Podocarpus নামক দুটি নগ্নবীজী উদ্ভিদও দেখা যায়। এ বনে কয়েক প্রজাতির বাঁশও রয়েছে। চট্টগ্রামের পাহাড়ী অঞ্চল, পার্বত্য চট্টগ্রাম, দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের কক্সবাজার ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে মৌলভীবাজার জেলাতেও এ ধরনের বনভূমি রয়েছে।
কক্সবাজারে ক্রান্তীয় আধা-চিরসবুজ বনও (Tropical Semi-evergreen forest) রয়েছে। বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে এ বন সাধারণত চিরহরিৎ, কিন্তু পত্রমোচী (deciduous) বৃক্ষেরও প্রাধান্য রয়েছে। এ বনভূমি সিলেট, চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের দিনাজপুরের পাহাড়ী এলাকা নিয়ে গঠিত। চিরসবুজ বন অপেক্ষা এ জাতীয় বনে গাছতলায় (undergrowth) উদ্ভিদ অধিক জন্মে। উঁচু আচ্ছাদন সৃষ্টিকারী বৃক্ষ ২৫-২৭ মিটার উঁচু হয়। উপত্যকা ও আদ্র ঢালে চাপালিশ, তেলশুর, নারকেলি প্রজাতিগুলিই বেশি জন্মে। গুটগুটিয়া, তুন, পীতরাজ, নাগেশ্বর, উড়িআম, নালিজাম, গোদাজাম, পীতজাম, ঢাকিজাম ইত্যাদি মধ্যমাঞ্চলে ছাউনি সৃষ্টি করে। ডেফল ও কেচুয়ান নিম্নস্তরের আচ্ছাদক। অপেক্ষাকৃত অধিক উষ্ণ ও শুষ্ক ঢালে এবং খাঁজে বিভিন্ন প্রজাতির গর্জন, বনশিমুল, শিমুল, শিল করই, চুন্দুল, গুজা বাটনা, কামদেব, বুরা গামারি, বহেড়া ও মুস উপরের ছাউনি সৃষ্টি করে। গাব, উদাল ও শিভাদি মধ্যম উচ্চতার ছাউনি সৃষ্টি করে, এবং আদালিয়া, বড়মালা, গোদা, অশোক, জলপাই ও দারুম নিচু ছাউনি সৃষ্টি করে। সাধারণ চিরসবুজ উদ্ভিদ প্রজাতিগুলি হলো গর্জন, শিমুল, বনশিমুল, বাটনা, চাপালিশ, তুন, করই ও জলপাই। এ বনভূমির উদ্ভিদের উত্তরাংশের সঙ্গে পূর্ব-হিমালয় ও দক্ষিণাংশের সঙ্গে আরাকানের উদ্ভিদের সাদৃশ্য রয়েছে। এই বনগুলির মোট আয়তন প্রায় ৬,৪০,০০০ হেক্টর, যা বাণিজ্যিক কাঠের ৪০% যোগায়। তবে পূর্বে প্রবর্তিত সেগুনের সঙ্গে সাম্প্রতিক রাবার চাষের ফলে এ বনভূমির প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে।
কক্সবাজারে জোয়ারধৌত বনও রয়েছে। যাকে স্থানীয় ভাষায় ‘প্যারাবন’ বলা হয়। সমুদ্র উপকূলীয় এলাকার এ বন জীববৈচিত্র সমৃদ্ধ। কিছু বন কিছু নির্দিষ্ট বাস্তুসংস্থানে সীমিত থাকে। এসব বনের মধ্যে রয়েছে বেলাভূমি বা তটীয় বন। এ বন কক্সবাজার ছাড়াও চট্টগ্রাম, বরিশাল ও পটুয়াখালী অঞ্চলের সমুদ্র উপকূল বরাবর বিস্তৃত। এখানে নানা ধরনের ও ঘনত্বের ঝোপঝাড়ের সঙ্গে জন্মে ঝাউ, গেওয়া, গাইট্টা, কেরং, পনিয়াল, কাঠবাদাম, মাদার, পিপুল ও নিশিন্দা। বিলুপ্তপ্রায় চামচ-ঠুঁটো-বাটান পাখি দেশে একমাত্র কক্সবাজারের জোয়ারধৌত বন বা প্যারাবনেই দেখা যায়।
সূত্র জানায়, কক্সবাজারের এসব বনাঞ্চলে বাস করে নানা প্রজাতির প্রাণি ও পাখি। এরমধ্যে প্রায় ৬শ প্রকার পাখি দেখা যায় কক্সবাজারের বনাঞ্চলে। কিন্তু সাম্প্রতিককালে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, বনভূমি দখল, নির্বিচারে বনভূমির গাছ কর্তন, পাহাড় কেটে বসতি স্থাপন ও এক শ্রেণীর বিকৃত মনের মানুষের বণ্যপ্রাণী শিকারের প্রবণতাসহ নানাবিধ কারণে এসব বণ্য প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে বলে জানান কক্সবাজারের বনকর্মকর্তারা।
বন কর্মকর্তারা জানান, এই অঞ্চলে স্বাধীনতার পরেও বাঘের ভয়ে আরাকান সড়ক বা চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে সন্ধ্যার পর চলাচল করা যেত না। এখন বাঘ (রয়েল বেঙ্গল টাইগার) পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। সুন্দরবন ছাড়া দেশের আর কোথাও রয়েল বেঙ্গল টাইগার নেই। একইভাবে ময়ুরও এই অঞ্চল থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এখন চিড়িয়াখানা ছাড়া অন্য কোথাও ময়ূরের দেখা মেলে না। একইভাবে হারিয়ে গেছে পরিবেশের বন্ধু সোনা ব্যাঙও। ধানে আসা অনেক পোকা খেয়ে ফেলতো সোনা ব্যাঙ। এখন সোনা ব্যাঙ বিলুপ্ত হওয়ার পর দেখা গেছে অনেক জায়গায় ধান হয়নি। এসব প্রাণি এখন বিলুপ্ত হওয়ার পর নতুন করে বিলুপ্তির পথে রয়েছে আরো কয়েকটি প্রাণি। এরমধ্যে রয়েছে পুরুষ হাতি ও প্যাঁচা।
প্রাণিবিদরা জানান, একটি প্যাঁচা দিনে ৪/৫টি ইদুর খায়। একটি ইঁদুর প্রতিদিন প্রায় ২শটি ধানের শীষ কেটে ফেলে। ইঁদুরের উৎপাত থেকে রক্ষা পেতে প্যাঁচার বিশাল ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু প্যাঁচা বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। একইভাবে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে বনাঞ্চলের সর্ববৃহৎ প্রাণি হাতি। এরআগে সাদা হাতিও বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
হাতির বিলুপ্তি প্রসঙ্গে টেকনাফের বন্য প্রাণি অভয়ারণ্যের সহকারি বন সংরক্ষক মো: রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন- ‘বণ্যপ্রাণি নিয়ে এখন আন্তর্জাতিক ব্যবসা হচ্ছে। এক শ্রেণীর বিকৃত মানসিকতার মানুষ নিজেদের আভিজাত্য জাহির করতে বন্যপ্রাণি শিকার করে ঘরে চামড়া ঝুলিয়ে প্রদর্শন করে। স্থানীয় কিছু দূর্বৃত্ত অর্থের লোভে জ্যান্ত হাতিকে হত্যা করে দাঁত কেটে পাচার করে দেয়। বিশেষ করে পুরুষ হাতি হত্যা করা হচ্ছে। দাঁত থাকাই কাল হয়েছে পুরুষ হাতির জন্য। তিনি জানান, কিছুদিন আগে মাছুয়াখালী ও রইক্ষ্যংয়ে হাতি হত্যা করে দাঁত পাচার করেছে দুর্বৃত্তরা। হত্যা করা হাতির দাঁত উদ্ধার করা হয়েছে মিয়ানমারে। আন্তর্জাতিক তদন্ত সংস্থা ইন্টারপোল ওই দাঁত উদ্ধার করে।’
বাংলাদেশে বণ্যপ্রাণির সুরক্ষায় বন বিভাগের সাথে ইন্টারপোল সমন্বিতভাবে কাজ করছে বলে তিনি জানান।
বনবিভাগ সূত্রে জানা গেছে, কক্সবাজার ও আশেপাশের বনাঞ্চলে গত ১০ বছরে ৬২টি হাতি হত্যা করা হয়েছে। এরমধ্যে শুধুমাত্র গত ১ বছরে হত্যা করা হয় ১৫টি হাতি।
কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মোঃ আলী কবির বন ধ্বংসের কথা স্বীকার করে বলেন, দিন দিন বনজ সম্পদ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। জনবল সংকটের কারণে বন রক্ষা করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারপরও আমরা চেষ্টা করছি বনজ সম্পদ রক্ষার জন্য।
জানা যায়, কক্সবাজার জেলায় মোট বনাঞ্চলের পরিমাণ (অবশ্য বনবিভাগের হিসাব মতে) ৯৬৬৬৯ দশমিক ৭৫ হেক্টর। এরমধ্যে কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের আওতাভূক্ত ৪৪১৭৪ দশমিক ৯১ হেক্টর বনের মধ্যে ৩৬৬০২ দশমিক ০৫ হেক্টর সংরক্ষিত বনভুমি ও ৭৫৭২ দশমিক ৮৬ হেক্টর রক্ষিত বনভুমি। কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগের বনভূমির পরিমাণ ৩৫,০০৬ দশমিক ৪৯ হেক্টর। এর মধ্যে সংরক্ষিত বনভূমির পরিমাণ ২৯,১৮৪ দশমিক ২৭ হেক্টর, রক্ষিত বনভূমির পরিমাণ ৫,৭৯৫ দশমিক ৬৪ হেক্টর ও অর্পিত বনভূমির পরিমাণ ২৬ দশমিক ৫৮ হেক্টর। এছাড়াও কক্সবাজার জেলার উপকূলীয় এলাকায় সৃজিত বন ভূমির পরিমাণ ১৩৯১১ দশমিক ৬৭ হেক্টর ও জেলার মহেশখালী পাহাড়ে সৃজিত বনভূমির পরিমাণ ৩৫৭৬ দশমিক ৬৮ হেক্টর। কক্সবাজার জেলার এসব বনাঞ্চলে প্রায় ৬০০ প্রজাতির পাখি দেখা যায়। বিশ্বব্যাপী বিলুপ্তপ্রায় চামচ-ঠুঁটো-বাটান পাখি দেখা যায় সোনাদিয়ায়। দেশের আর কোথাও এই পাখির দেখা মেলে না। বর্তমানে টেকনাফের বণ্যপ্রাণি অভয়ারণ্যে ১৯৮ প্রজাতির অমেরুদন্ডী, ৪৮ প্রজাতির মাছ, ২৭ প্রজাতির উভচর, ৫৪ প্রজাতির সরিসৃপ, ২৪৩ প্রজাতির পাখি এবং ৪৩ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণি রয়েছে। বন্য প্রাণির মধ্যে এশিয়ান হাতি, মায়া হরিণ, মেছো বাঘ, গন্ধ গোকুল, সজারু, শিয়াল, বন্য শুকর, বানর, হনুমান, ধনেশ পাখি, বড় আকারের ধূসর কাঠ ঠোকরাসহ নানা প্রজাতির বন্যপ্রাণি রয়েছে। অথচ জেলার অন্য বনাঞ্চলে এসব প্রাণির অধিকাংশই হারিয়ে গেছে।