বাংলাদেশ, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় ব্যাপক অভিযানের পর সমুদ্রপথে মানব পাচার সাম্প্রতিক সময়ে বন্ধ হলেও এখন পাচারকারী চক্র ফের সক্রিয় হয়ে উঠেছে। সংঘবদ্ধ চক্র আদম পাচারের জন্য নতুন রুট তৈরি করছে বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।
আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কড়া নজরদারির কারণে বাংলাদেশের উপকূল থেকে সাগরপথে কয়েক মাসে কোনো মানব পাচার হয়নি।
তবে মিয়ানমারের আকিয়াব উপকূল থেকে সরাসরি মালয়েশিয়া উপকূলের উদ্দেশে কয়েকটি মানব চালান এরই মধ্যে পাঠানো হয়েছে। যারা পাচার হয়েছেন তাদের সবাই রোহিঙ্গা মুসলমান।
মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের অন্য দেশে পাচার করতে সে দেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা পাচারকারীদের সহযোগিতা করছে এমন অভিযোগ রয়েছে। এর ফলে মিয়ানমারের উপকূল থেকে মানব পাচারে সংঘবদ্ধ চক্র বেশি উৎসাহিত হচ্ছে।
এ প্রেক্ষাপটে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও শনিবার পালিত হলো বিশ্ব মানব পাচার প্রতিরোধ দিবস।
আইন প্রয়োগকারী সংস্থার তথ্য মতে,সমুদ্রপথে অবৈধভাবে মালয়েশিয়ায় মানব পাচারের সঙ্গে কক্সবাজার জেলার তিন শতাধিক দালাল সক্রিয় ছিল। তাদের নিয়ন্ত্রণ করতেন প্রভাবশালী ২০ ব্যক্তি। যাদের অধিকাংশ এখন আত্মগোপনে আছেন। প্রভাবশালী সাত পাচারকারী আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে।
এরপর সক্রিয় পাচারকারীরা আত্মগোপনে চলে যায়। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশ অবস্থান করছে মিয়ানমার ও মালয়েশিয়ায়। সেখানে বসেই সংঘবদ্ধ এই চক্র ফের সক্রিয় হয়ে উঠেছে।
সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থার তালিকাভুক্ত পাচারকারীদের মধ্যে রয়েছে টেকনাফ উপজেলার সাবরাং ইউনিয়নের শাহপরীর দ্বীপ ডাঙ্গারপাড়ার মো. ফিরোজ ও তার ভাই হেলাল উদ্দিন, মাঝিরপাড়ার ছৈয়দ উল্লাহ, আবুল কালাম, দক্ষিণপাড়ার মো. কাসেম, হাকিম মাঝি, মিস্ত্রিপাড়ার মো. সেলিম ওরফে লম্বা সেলিম, বাজারপাড়ার মো. ইউনুছ, মো. ইসমাইল, সাবরাং কচুবুনিয়ার আবদুল হামিদ, মো. ইসলাম বাগু, মো. আবদুল্লাহ, ঝিমা কাসিম, কাটাবনিয়ার মনির উল্লাহ, সাবরাং কুয়াংছড়িপাড়ার এজাহার মিয়া মাঝি ও চকবাজারের হেফজু মাঝি। তারা সবাই আত্মগোপনে আছে।
কক্সবাজারের শীর্ষ মানব পাচারকারী উখিয়ার রেজিয়া আকতার রেবি ওরফে ম্যাডামকে গত বছর জানুয়ারিতে গ্রেফতার করে স্থানীয় গোয়েন্দা পুলিশ। মানব পাচারের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে অর্ধডজন মামলা হয়েছে। আলোচিত রেবি ম্যাডাম জামিনে মুক্ত হয়ে এখন পলাতক।
ম্যাডাম হিসেবে পরিচিত শীর্ষ এই মানব পাচারকারী রেজিয়া আকতার রেবি উখিয়া টেকনাফ উপকূলের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে কয়েক বছর ধরে মানব পাচার করে আসছে। মানব পাচার মামলায় এর আগে তার স্বামী নুরুল কবিরকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তাকে গ্রেফতারের পর রেজিয়া আকতার রেবির দুটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে সন্ধান পাওয়া গেছে দেড় কোটি টাকা।
সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মানব পাচারকারীদের একটি তালিকা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছে পাঠিয়েছে। সে তালিকায় আছে বিভিন্ন জেলার পাচারকারীদের নাম। তাদের অনেকে এখন বিভিন্ন মামলায় আসামি হয়ে পলাতক। কেউ জামিনে মুক্ত।
এদিকে, কক্সবাজার উপকূলে মানব পাচারে ব্যবহার হতো শতাধিক নৌঘাট। এসব এখন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কড়া নজরদারিতে আছে।
অতীতে উখিয়া উপজেলার রেজু মোহনা, হিমছড়ি, সোনারপাড়া, টেকনাফ উপজেলার বাহারছড়া, সাবরাং, শাহপরীর দ্বীপ হয়ে সাগরপথে বেশি মানব পাচার হয়েছে। বর্তমানে এসব পয়েন্টে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার রয়েছে তল্লাশি চৌকি।
কক্সবাজার জেলায় ৩ বছরে মানব পাচার আইনে ৩০৬টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে ১৫৩১ জনকে। আটক হয়েছে ৪৭৭ পাচারকারী ও দালাল।
কক্সবাজার আদালত সূত্র জানায়, এ পর্যন্ত ২টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। বাকি মামলা বিচারাধীন।
কক্সবাজার আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর মমতাজ আহমদ জানান, মামলায় যারা আসামি হয়েছে তারা বেশির ভাগই বহনকারী। পাচারে জড়িত শীর্ষ ব্যক্তি ও গডফাদাররা এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে গেছে।
পুলিশ সুপার শ্যামল কুমার নাথ জানান, কক্সবাজারের সমুদ্র উপকূল দিয়ে মানব পাচার এখন বন্ধ হয়ে গেছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কড়া নজরদারির কারণে এই সাফল্য এসেছে। সরকারের শীর্ষ মহল থেকেও মাঠ পর্যায়ে এ বিষয়ে বিশেষ নজর রাখা হয়েছে।
জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) তথ্যের বরাত দিয়ে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ২০১৫ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে ৩ লাখ নারী ও শিশু ভারতে পাচার হয়েছে।
সেভ দ্য চিলড্রেনের বরাত দিয়ে তারা জানায়, ২০১৫ সাল পর্যন্ত গত পাঁচ বছরে প্রায় ৫ লাখ নারী পাচার হয়েছে। জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) তথ্য অনুযায়ী গত বছরের জুন পর্যন্ত তিন বছরে সাগরপথে পা?চার হয়েছে দেড় লাখ মানুষ।
পুলিশ সদর দপ্তরের হিসাবে চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে পাচারের শিকার হয়েছেন ৩৯৯ জন। উদ্ধার হয়েছেন ২৫৯ জন। আটক হয়েছে ৬৭৭ জন সন্দেহভাজন পাচারকারী। মামলা হয়েছে ৩৭৩টি। গত এপ্রিলে সাজা হয়েছে মাত্র তিনজনের।
পাচারের শিকার ব্যক্তিদের আইনি সহায়তা দিয়ে থাকে বেসরকারি সংস্থা ‘অনির্বাণ সারভাইভর ভয়েস’। এর সমন্বয়ক আল আমিন নয়ন জানান, গত বছর মানব পাচার প্রতিরোধে যতটা কড়াকড়ি ছিল তা এখন অনেকটাই শিথিল। পাচারকারীরা আবার এর সুযোগ নিচ্ছে। সাগরপথ বন্ধ হলেও আকাশপথে পাচার বন্ধ হয়নি। বিচার প্রক্রিয়ায় ধীরগতির কারণে পাচারকারীরা সাজা পাচ্ছে না। জামিনে ছাড়া পেয়ে আবার একই অপরাধে নিজেদের সক্রিয় রাখছে।
মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন-২০১২ অনুযায়ী, মানব পাচারের বিচার বিশেষ ট্রাইব্যুনালে হওয়ার কথা। গত বছরের জুনে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জানিয়ে ছিলেন, সাত বিভাগে সাতটি ট্রাইব্যুনাল হবে, যা এক বছরেও হয়নি। পূর্ণাঙ্গ ট্রাইব্যুনাল গঠিত না হওয়ায় নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইব্যুনালে মানব পাচারের বিচার চলছে।
সূত্র : আবু তাহের চৌধূরী, দৈনিক সমকাল।