দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে নিঃশর্ত মুক্তি দিয়ে পছন্দের হাসপাতালে চিকিৎসার সুযোগ দিলে নির্বাচিত ছয় জন প্রার্থীর শপথ নেওয়ার বিষয়টি ভেবে দেখবে বিএনপি। আর বিএনপির ওই ছয় নির্বাচিত প্রার্থী শপথ নিয়ে সংসদে যোগ দিলে খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তি ও চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর বিষয়টি ভেবে দেখবে সরকার।
দুই পক্ষের এমন অনড় অবস্থানের মধ্য দিয়ে এগোচ্ছে রাজনীতি। পর্দার অন্তরালে চলছে নানা আলোচনা, দর কষাকষি! এ ক্ষেত্রে সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে সরকার। তাদের হাতে রয়েছে পর্যাপ্ত সময়। কিন্তু বিএনপির হাতে সময় মাত্র ১৩ দিন। এই সময়ের মধ্যেই যা কিছু করার, তা-ই করতে হবে বিএনপিকে। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ৩০ এপ্রিলের মধ্যেই নিতে হবে দলটিকে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যেহেতু ৩০ এপ্রিলের মধ্যে বিএনপির ছয়জন নির্বাচিত প্রার্থীকে শপথ নিতে হবে, সেহেতু চাপটা বিএনপির ওপরই বেশি। কারণ, এই সময়ের মধ্যে শপথ না নিলে তাদের সংসদ সদস্য পদ বাতিল হয়ে যাবে। তখন দর-কষাকষির সুযোগটাও হাতছাড়া হয়ে যাবে তাদের। কোনো প্রকার সমঝোতার প্রস্তাবে আর সায় দেবে না সরকার।
সূত্রমতে, এমন পরিস্থিতিতে চলতি এপ্রিল মাসের শুরু থেকেই ভেতরে ভেতরে মুভমেন্ট শুরু করে বিএনপি। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের সঙ্গে যোগাযোগেরও চেষ্টা করে দলটির শীর্ষ নেতারা। নানা দিক থেকে মুভমেন্ট অব্যাহত রাখে তারা। খালেদা জিয়ার নিঃশর্ত মুক্তির শর্তে শপথ নিয়ে সংসদে যাওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ দেখায় বিএনপি।
কিন্তু জামিন বা নিঃশর্ত মুক্তি নয়, বড়জোর প্যারোলে মুক্তির বিষয়টি ভেবে দেখার আশ্বাস দেয় সরকার। অর্থাৎ বিএনপির ছয় বিজয়ী প্রার্থী শপথ নিয়ে সংসদে গেলে প্যারোলে মুক্ত হয়ে চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার সুযোগ পাবেন দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।
সূত্রমতে, খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে এবং তার জীবন রক্ষায় সরকারের দেওয়া এ প্রস্তাব প্রথম দিকে ইতিবাচক হিসেবে নেয় বিএনপি। বিষয়টি নিয়ে দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটিতে আলোচনা করার সিদ্ধান্ত নেন দলটির শীর্ষ নেতারা।
সম্প্রতি খালেদা জিয়ার সঙ্গে তার স্বজনরা দেখা করতে গেলে প্যারোলের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। প্যারোলের ব্যাপারে স্বজনরা তাকে রাজি করানোর চেষ্টাও করেন। কিন্তু খালেদা জিয়া তার স্বজনদের সাফ জানিয়ে দেন প্যারোলে মুক্তি তিনি চান না।
এরপর গত রোববার (১৪ এপ্রিল) পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে দেখা করতে গেলে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান ও গয়েশ্বরচন্দ্র রায়কেও খালেদা জিয়া সাফ জানিয়ে দেন, প্যারোল নিতে রাজি নন তিনি। বিএনপির ছয়জন সংসদ সদস্যও শপথ নেবেন না।
অবশ্য নজরুল ইসলাম খান সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্যারোল নিয়ে ম্যাডাম কিছু বলেননি। জামিন পাওয়ার ন্যায্য অধিকার তার আছে, প্যারোল চাইবেন কেন? আর শপথ নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। ম্যাডামের মামলা ও শারীরিক অবস্থা নিয়ে কথা হয়েছে।’
এদিকে খালেদা জিয়ার নিঃশর্ত মুক্তির শর্তে শপথ নিতে আগ্রহী বিএনপির ছয়জন বিজয়ী প্রার্থী সোমবার (১৫ এপ্রিল) গুলশানে দলের চেয়ারপাসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে বৈঠক করেন। শপথ নেওয়ার ব্যাপারে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে তাদের আগ্রহের কথা জানান। মির্জা ফখরুলও তাদের জানিয়ে দেন খালেদা জিয়ার সিদ্ধান্তের বিষয়টি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একদিকে খালেদা জিয়ার মুক্তি, অন্যদিকে বিজয়ী ছয় জনের শপথ নিয়ে এই মুহূর্তে দম আটকানো পরিস্থিতে রয়েছে বিএনপি। আইনি প্রক্রিয়ায় খালেদা জিয়ার মুক্তি সম্ভব নয়—এমন বাস্তবতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হওয়ার পরও গত ১৪ মাসে কার্যকর কর্মসূচি দিতে পারেনি বিএনপি। আগামী ১৩ দিনে বড় কিছু করে ফেলবে—এমনটি ভাবার কোনো কারণও দেখছেন না কেউ। প্যারোলে মুক্তির সর্বশেষ সুযোগটাও নিতে রাজি নন খালেদা জিয়া।
অবশ্য বিএনপির মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের অনেকেই মনে করেন, আইনি প্রক্রিয়া বা রাজপথের আন্দোলনে খালেদা জিয়াকে মুক্ত করা সম্ভব নয়। বরং প্যারোলে মুক্তি খালেদা জিয়ার দেশের বাইরে এবং শপথ নিয়ে নির্বাচিত ছয়জন সংসদে গেলেই ভাল করবে। দলটির শুভাকাঙ্ক্ষীরাও মনে করেন দলটিকে বাঁচাতে হলে যেকোনো মূল্যে, যেকোনো শর্তে খালেদা জিয়ার মুক্তি প্রয়োজন। সে জন্য যতটুকু ছাড় দেওয়া দরকার, ততটুকু ছাড় দিতে হবে বিএনপিকে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘শপথ, প্যারোল—এগুলো আলোচনার কোনো বিষয়-ই নয়। আমাদের দাবি একটাই, খালেদা জিয়াকে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে হবে। মুক্ত হওয়ার পর তিনিই সব ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন। আর ১৩/১৪ দিনের হিসাব করে আমরা রাজনীতি করি না।’ কোনো টাইমফ্রেম তাদের রাজনীতিতে নেই বলেও তিনি মন্তব্য করেন।