উখিয়া উপজেলার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্প যেন অপরাধীদের স্বর্গরাজ্য। সন্ত্রাস, মানব পাচার, মাদক ব্যবসা, অস্ত্র ব্যবসা, জঙ্গি তৎপরতা এখানে অনেকটা অবাধেই চলে। সূত্র জানায় কুতুপালং ক্যাম্প পরিণত হয়েছে মাদক পাচারের অন্যতম প্রধান কেন্দ্রে। প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার ইয়াবা এখানে মজুদ করার পর দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হয়। মানব পাচার ও অবৈধ অস্ত্র ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছে ক্যাম্পে সংঘবদ্ধ চক্র। বিভিন্ন স্থান থেকে লোকজনকে অপহরণ করে এনে ক্যাম্পে রেখে মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনাও ঘটছে। সম্প্রতি এই ক্যাম্প থেকেই উদ্ধার হয়েছে জিম্মি হিসেবে আটক একাধিক ব্যক্তি। গত ৪ বছরে ক্যাম্পে খুন হয়েছে ৮ জন। কুতুপালং ক্যাম্পে সরকারিভাবে তালিকাভুক্ত শরণার্থীর সংখ্যা ১৩ হাজার ১৭৬। অথচ এই ক্যাম্পে তালিকাবহির্ভূত প্রায় ৮০ হাজার রোহিঙ্গা অবৈধভাবে অবস্থান করছে। তালিকাভুক্ত রোহিঙ্গাদের জন্য নির্ধারিত ক্যাম্পের পাশেই আছে অনিবন্ধিত রোহিঙ্গাদের বস্তি। সেখানে ১০ হাজার ঝুপড়ি ঘরে বাস করছে ৮০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা। সরেজমিন ঘুরে জানা যায়, এই বস্তি নিয়ন্ত্রণ করছে ৪৮ জনের একটি সিন্ডিকেট। এদের মধ্যে অনেকে জঙ্গি তৎপরতায় জড়িত। ক্যাম্পে ৮ হাজার পরিবারের কাছ থেকে প্রতি মাসে ২০০ টাকা করে ভাড়া (চাঁদা) আদায় করছে এই সিন্ডিকেট। প্রতিমাসে আদায় চাঁদার বাইরেও নানা অজুহাতে টাকা আদায় করা হয়। রোহিঙ্গাদের অভিযোগ, সিন্ডিকেটকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে পুলিশ ও ক্যাম্পের কর্মকর্তারা। এদের বিরুদ্ধে কথা বললে চালানো হয় নির্যাতন। ক্যাম্পের অনেকে জানায়, অবৈধ বস্তি নিয়ন্ত্রণ করছে ৪৮ জনের কমিটি অর্থাৎ সিন্ডিকেট। কারা এই কমিটি তৈরি করেছে সাধারণ রোহিঙ্গারা কিছুই জানে না। কমিটির চেয়ারম্যান আবু সিদ্দিক, ভাইস চেয়ারম্যান সিরাজুল মোস্তফা এবং সাধারণ সম্পাদক রাকিবুল ইসলাম। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন ব্লক ভিত্তিক। তার মধ্যে রয়েছেন ডি-ব্লকের মোহাম্মদ জিয়া, এ-১ ব্লকের আবদুস শুক্কুর, আবদুল হাফেজ, এ-২ ব্লকে মান্নান, বি-ব্লকে মোহাম্মদ নুর, বি-১ ব্লকে আমিন, তাহের, বি-২ ব্লকে মোহাম্মদ আলম, নুরুল ইসলাম, শফিক, বি-৩ ব্লকের আবু তৈয়ুব, নুর হোসেন, জকরিয়া, আমির হামজা। ডি-ব্লকে দায়িত্বে রয়েছেন রফিক, ডি-১ ব্লকে আবু জাফর, আবদুল্লাহ, জাফর, ডি-২ ব্লকে মনিরুজ্জামান, আবদুল মাজেদ, ডি-৩ ব্লকে মোহাম্মদ হোসেন ওরফে কালা বদা, সৈয়দুল আমিন ডাইলু, মজিদ, ডি-৪ ব্লকে রুহুল আমিন, মোহাম্মদ সালাম, শমশু, আবদুস সালাম, ডি-ব্লকে মোহাম্মদ আলী, নুরুল আমিন ও কালু। সি-১ ব্লকে দায়িত্বে রয়েছেন মৌলভী রফিক, মোহাম্মদ আলম, সি-২ ব্লকে মোস্তফা কামাল, উলা মিয়া, ই-১ ব্লকে আবুল কালাম, হাবিব, নুর আলম, ই-২ ব্লকের আলী হোসেন, সলিম, মৌলভী জামাল, মোহাম্মদ বাসের, ফরিদ এবং আবু সৈয়দ। ক্যাম্পের একাধিক সূত্র জানায়, ক্যাম্প নিয়ন্ত্রণকারী চক্রের মূল নেতৃত্বে আছেন আবু সিদ্দিক, সিরাজুল মোস্তফা, রাকিবুল ইসলাম ও মোহাম্মদ জিয়া। এই ৪ জন রোহিঙ্গা জঙ্গি সংগঠন আরএসওর সঙ্গে জড়িত। তারা ৮ হাজার রোহিঙ্গা পরিবার থেকে ২০০ টাকা করে প্রতি মাসে ১৬ লাখ টাকা চাঁদা আদায় করে। এই টাকার ভাগ পাচ্ছে ক্যাম্পের দায়িত্বরত পুলিশও। এর আগে বিভিন্ন অভিযোগে পুলিশের এক এসআই ও ৩ কনস্টেবলের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। অবৈধভাবে বসবাসরত রোহিঙ্গারা ক্যাম্প থেকে বের হয়ে জেলার বিভিন্ন স্থান ঘুরতে পারলেও স্থানীয়রা সহজে প্রবেশ করতে পারে না রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। স্থানীয় লোকজন ও সাংবাদিকরা প্রবেশ করতে চাইলে বাধা দেয় সংঘবদ্ধ চক্র। সূত্র জানায়, ক্যাম্পে ব্লক-৩ ও ব্লক-৪ এর পাহাড় রোহিঙ্গা জঙ্গিদের আস্তানা হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। রোহিঙ্গা জঙ্গি ছিদ্দিক, মৌলভী মনজুর ও আবু তৈয়ব দীর্ঘদিন ধরে ওই আস্তানায় জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে।
উখিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও রোহিঙ্গা প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী জানান, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আদায় অর্থের বেশির ভাগ ব্যয় হচ্ছে জঙ্গি তৎপরতায়। ক্যাম্পের সংঘবদ্ধ চক্রকে সহযোগিতা করছে বিদেশি কয়েকটি সংস্থা। এরাই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত করছে। জঙ্গিদের সহযোগিতা দিচ্ছে মুসলিম এইড, ইসলামিক রিলিফ, ইমাম মুসলিম ও সমন্বিত মানবিক উদ্যোগসহ কয়েকটি সংস্থা। শরণার্থী ক্যাম্পের ইনচার্জ মোহাম্মদুল হক বলেন, ক্যাম্পের বাইরে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা ঝুপড়ি ঘর তুলে অবৈধভাবে বসবাস করছে। এখানে নানা অপরাধ সংঘটিত হলেও আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। কক্সবাজারের পুলিশ সুপার শ্যামল কুমার নাথ জানান, উখিয়া ও টেকনাফে দুটি রোহিঙ্গা ক্যাম্প সীমান্তের কাছাকাছি হওয়ায় সহজে রোহিঙ্গারা অনুপ্রবেশ করে এখানে বসতি স্থাপন করছে। তারা নানা অপরাধ করেছে। তাই রোহিঙ্গাদের অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার চিন্তা-ভাবনা করছে সরকার। রোহিঙ্গা জরিপের কাজ শুরু হয়েছে। তিনি আরও বলেন, ক্যাম্পে বস্তি থেকে কারা অর্থ আদায় করছে তা খতিয়ে দেখা হবে। এতে পুলিশের কেউ জড়িত থাকলে ছাড় দেওয়া হবে না।