:
কলকাতায় যখন ছিলাম, একদিন কলকাতা টিভির একটি অনুষ্ঠানে আমাকে ডাকা হয়েছিল। অনুষ্ঠানে আমাকে নিয়ে কবি লেখক এবং সাধারণ পাঠকদের কিছু সদ্য সংগ্রহ করা মন্তব্য ছিল। প্রথম মন্তব্যটি নবনীতা দেব সেন-এর। নবনীতার আমি অনুরক্ত। বিশেষ করে তাঁর রসবোধের। অসাধারণ তাঁর রসবোধ। কিছুদিন আগে দিল্লিতে একটি নারীবাদী অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে দুজনই একসঙ্গে কলকাতায় ফিরছি। আমাদের সেই ফেরাটি যেমন জ্ঞানে মানে সমৃদ্ধ ছিল, তেমনি রসে ছিল টইটম্বুর। সময় উড়ে গেছে পলকে। সেই নবনীতা, যিনি অনেকবারই বলেছেন আমার লেখা তাঁর ভালো লাগে, বিশেষ করে পুরুষতন্ত্রের সমালোচনা করে যেগুলো লেখা। মনে আছে মাত্র ক’দিন আগে তেমনই একটি লেখা আমি নিজেই পড়ে শুনিয়েছিলাম, আমার বাড়িতে বসেই তিনি সেটির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিলেন, সেই নবনীতা দেখলাম কলকাতা টিভিতে আমার সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলছেন, ‘তসলিমার সঙ্গে আমাদের পার্থক্য হল, আমরাই পুরুষতন্ত্রের বিরোধী, ও তা নয়। মানে আমরা সিস্টেমের সমালোচনা করি, কিন্তু তসলিমার ব্যাপারটা ভিন্ন, ও তা করে না, ও পুরুষতন্ত্রবিরোধী নয়, ও হল পুরুষবিদ্বেষী।’ এই মন্তব্য শুনে আমি অনেকক্ষণ বাকরুদ্ধ বসে ছিলাম। এই যে দু’দশক ধরে নারীর অধিকারের পক্ষে লিখছি, এ কারণে নিজের দেশ থেকেও যুগ পার হয়ে গেল নির্বাসিত, আর ক’জন নমস্য নারীবাদী বুদ্ধিজীবীর কাছ থেকে কি না আজ এই প্রতিদান পেলাম! আমার জীবন নিয়ে তিনি কী রসিকতাই না করলেন!
আমি বিশ্বাস করি না যে নবনীতা দেব সেন আমার কোনও বই পড়েননি। কোনও বই বা কোনও লেখা না পড়ে মন্তব্য করার লোক যে সমাজে নেই, তা নয়। কিন্তু তাদের কাতারে আমি তাকে ফেলবো কেন! তিনি দায়িত্ববান মানুষ। নিজে যখন বক্তব্য পেশ করছেন, নিশ্চয়ই দায়িত্বজ্ঞানহীনের মতো তা করেননি। আমি জানি তারাই এই ধরণের মন্তব্য করে যারা আমার লেখা পড়েনি অথবা পড়লেও বোঝেনি। বাংলাদেশেও লোকে করেছে, পশ্চিমবঙ্গেও করে। কিন্তু নবনীতা দেবসেন-এর মাপের কোনও লেখকের কাছ থেকে এমন অপবাদ আমার জোটেনি কোনওদিন। এ অনেকটা চরিত্রহননের মতো। আমি আমার মানববাদী আদর্শ আর নীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল না থাকি যদি, সত্য বলার সততাকে যদি খুইয়ে ফেলি, আমি নিজেই বলবো চরিত্র বলে কিছু নেই আমার। কিন্তু আমি যা নই, আমাকে যদি বলা হয় আমি তা, তবে তা চরিত্রহনন ছাড়া আর কী! আমার সংজ্ঞায় চরিত্রহীনতার সঙ্গে যৌনতার কোনও সম্পর্ক নেই, সম্পর্ক আছে শঠতা, নীচতা, অসততা, মিথ্যে প্রতারণা, ছলনা, চাতুরির সঙ্গে।
ইটিভির পরম্পরায় নবনীতা দেব সেন এবং আমাকে নিয়ে দুটো অনুষ্ঠান করা হয়েছিল। আরও অনেক কবি সাহিত্যিক শিল্পী যাদের ডাকা হয়েছিল পরম্পরায়, তাদের অনুষ্ঠান প্রচার হয়ে গেছে। কিন্তু কী এক রহস্যময় কারণে নবনীতা-তসলিমা জুটির দুটি অনুষ্ঠানের একটিও, আজও প্রচার হয়নি।
ওখানে আমি আবার জানতে ইচ্ছুক ছিলাম নবনীতা দেব সেন-এর মতো ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষের স্বামীর পদবী ধারণ করার কারণ। ‘সই’ নামে তার নারীলেখক সংগঠনে আর যে নারী লেখকেরই যোগ দেওয়ার অধিকার আছে, আমার কেন নেই, এ নিয়েও জানতে চেয়েছিলাম। দুটো অনুষ্ঠানই বেশ বিদগ্ধ নারীবাদী অনুষ্ঠান ছিল। কিন্তু বেছে বেছে নারীবাদের ওপরই কাঁচি চালানোর প্রবণতা আজকাল প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের।
অনেককাল যাবৎ ধর্ম ও পুরুষতন্ত্রের সমালোচনা করে লিখছি, বলছি। কারণ মানবাধিকারে বিশ্বাসী আমি। যেহেতু মানবাধিকারে বিশ্বাসী, সেহেতু নারীর অধিকারে বিশ্বাসী। আমার কাছে মানব বলতে নারী-পুরুষ উভয়ে। নারী যেহেতু সমাজে নারী হওয়ার কারণে নিগৃহীত হচ্ছে, নিষ্পেষিত হচ্ছে, যেহেতু নারীর স্বাধীনতা এবং সমানাধিকার পাওয়ার বিরুদ্ধে নানারকম পুরুষতান্ত্রিক ষড়যন্ত্র বিরাজমান, তাই এসব নারীবিরোধী নিয়মনীতি আর কুটিল জটিল ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদ করি। করি বলেই কেউ আমাকে নারীবাদী বলে, কেউ বলে মানববাদী। আর মূর্খরা নিশ্চিন্তে বলে যায় যে আমি নাকি পুরুষবিদ্বেষী।