মাত্র কয়েক মাস হলো দুদকের দায়িত্ব নিয়েছেন। নতুন কাজ নিয়ে আপনার অভিজ্ঞতা কী?
ইকবাল মাহমুদ : অভিজ্ঞতা যে খুব সুখকর, তা নয়। কারণ, আমি খুব আহত হয়েছি এ কারণে যে আমরা এখানে যারা কাজ করি, তারা এখানকার আইন ও বিধি ঠিকমতো প্রতিপালন করিনি। উদাহরণস্বরূপ আমি যদি বলি, আমাদের এখানে অনুসন্ধানের জন্য ৬০ কার্যদিবস এবং তদন্তের জন্য ১২০ কার্যদিবস নির্ধারণ করা আছে। আমার সবচেয়ে দুঃখের কারণ এখানে যে আমরা মানুষকে হয়রানি করেছি। আমি স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছি, কোনো অনুসন্ধানই ৬০ দিনে শেষ হয়নি। কেন শেষ হয়নি, তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। দুদকের অনুসন্ধান এমন কঠিন কোনো অনুসন্ধান নয়। এগুলো হচ্ছে সব কাগজপত্রের বিষয়। যেহেতু আমি বাইরে থেকে এসেছি, সে কারণে এসব বিষয়ে আমি খোঁজখবর নিচ্ছি। আপনারা দেখেছেনও আমি কিছু অ্যাকশন নিয়েছি। আমি আশা করি এবং বিশ্বাস করি যে এখন থেকে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই কাজ শেষ হবে। এবং মানুষের হয়রানি কমবে।
আপনি দায়িত্ব নিলেন ১৪ মার্চ। আমরা দেখলাম যে মার্চের শেষ দিক থেকে হঠাৎ করেই গ্রেপ্তার অভিযান শুরু হয়েছে। এ ধরনের অভিযান কিন্তু আমরা ওয়ান-ইলেভেন ছাড়া অন্য কোনো সময় দেখিনি।
ইকবাল মাহমুদ : আমার মনে হয় এটাকে অভিযান বলা ঠিক হবে না। সত্যি বলতে কি, অনুসন্ধান-তদন্ত এসব ঠিকমতো না হওয়ার বিষয়গুলো নিয়ে আমি যখন নজর দেওয়া শুরু করলাম তখন অনেককে আমি কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছি। আমার ধারণা, এর কারণেই গ্রেপ্তার শুরু করেছেন কর্মকর্তারা। যখন শোকজ গেছে তখন নড়েচড়ে বসছেন আমাদের লোকজন। তাঁরাই তৎপর হয়েছেন। আমি আসলে বিশেষ কোনো নির্দেশনা দিইনি।
তাঁরাই গ্রেপ্তার শুরু করেছেন?
ইকবাল মাহমুদ : গ্রেপ্তার একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। কর্মকর্তারা যদি মনে করেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি পালাতে পারেন, তাহলে অবশ্যই গ্রেপ্তার করতে পারেন।
অভিযোগ উঠেছে, যে গ্রেপ্তার অভিযান চলছে সেখানে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা বাইরে রয়ে যাচ্ছেন?
ইকবাল মাহমুদ : আসলে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা বাইরে রয়ে যাওয়ার বিষয়টি ভালোভাবে বুঝিনি। আপনারা অনেকেই বলেন বা আমিও পত্রিকান্তরে লেখা দেখেছি, ছোট ইঁদুর ধরা পড়েছে, বড় ইঁদুর ধরা পড়েনি। আপনারা জানেন যে বিজ্ঞ আদালত যদি কাউকে জামিন দেন, তাঁকে তো আমরা ধরতে পারি না। এ রকম পরিস্থিতির কারণেই হয়তো অনেক বড়কে ধরা যায় না।
এটা কি তাহলে আদালতের নির্দেশনার কারণে?
ইকবাল মাহমুদ : অবশ্যই কোনো না কোনো কারণে ধরা যাচ্ছে না। কিন্তু আপনারা জেনে খুশি হবেন, যাঁদের কথা আপনারা বলছেন, তাঁদের সবারই দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছি। আমার মনে হয় এ সংখ্যা প্রায় দুই থেকে আড়াই শ হবে।
দুদকের মামলায় সাজার হার তুলনামূলকভাবে অনেক কম। বিচারিক আদালতে সাজা পাওয়া অনেকের সাজা উচ্চ আদালতে আরও কমে যাচ্ছে। বিষয়টি আপনার নজরে এসেছে কি?
ইকবাল মাহমুদ : কমিশনের প্রথম সভাতেই আমি এটা লক্ষ করেছি যে ৫৩ শতাংশ মামলায় কনভিকশন হচ্ছে না। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
দুদকের মামলা তো নথিপত্র ও কাগজপত্রের প্রমাণনির্ভর। প্রমাণ পেয়েই তো আপনারা মামলা করছেন। তাহলে তাঁরা বের হয়ে যাচ্ছেন কীভাবে?
ইকবাল মাহমুদ : সেখানেই তো প্রশ্ন। আমি কেন মামলা করলাম? তাহলে তো আমি মানুষকে হয়রানি করেছি। এটাকে আমার ব্যক্তিগত দায় মনে হয়। আপনারা শুনলে অবাক হবেন যে দুদকের মামলায় এফআরটির (ফাইনাল রিপোর্ট ট্রু) মানে হচ্ছে ঘটনা সত্যি কিন্তু প্রমাণ নেই। আরে ভাই, তাহলে আমি মামলা কেন করব? আসলে আমাদের সিস্টেমের দুর্বলতা আছে। আমরা সেই দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছি। আমরা আশা করছি সময়ের ব্যাপ্ত পরিসরে এটি ঠিক হবে।
সাম্প্রতিক সময়ে বিসমিল্লাহ গ্রুপ কেলেঙ্কারি, রেলওয়ের দুর্নীতি মামলাসহ বেশ কিছু মামলার অভিযোগপত্র আদালত থেকে পর্যবেক্ষণসহ ফেরত এসেছে। নতুন করে তদন্তের নির্দেশনা দিয়েছেন আদালত। অভিযোগ রয়েছে, অনুসন্ধান ও যথাযথ তদন্ত না হওয়ার পেছনে তদন্তের দুর্বলতার পাশাপাশি অন্য কারণও রয়েছে।
ইকবাল মাহমুদ : আসলে এটা তো সত্যি যে আমরাও মানুষ। আমাদের ভুল হয়। ভুল দুই রকমে হয়। একটা উদ্দেশ্যমূলক, আরেকটি উদ্দেশ্যমূলক নয়। আমি আমার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বলে দিয়েছি উদ্দেশ্যমূলকভাবে ভুল করলে ক্ষমা নেই। দুদকের তদন্তের বিষয়ে যে প্রশ্ন উঠেছে সে প্রসঙ্গে বলি, তদন্তে কিছু দুর্বলতা আছে। আমাদের কর্মকর্তাদেরও দুর্বলতা আছে। তবে কিছু ভুল দুর্বলতার কারণে হতে পারে। কিছু হতে পারে উদ্দেশ্যমূলক। এগুলো আমরা দেখছি। কর্মকর্তাদের দক্ষতা বাড়াতে প্রশিক্ষণ শুরু করেছি।
সাম্প্রতিক সময়ে অপরাধের ধরন পাল্টেছে। সাইবার ক্রাইমের মাধ্যমে দুর্নীতি হচ্ছে। এসব দুর্নীতির অনুসন্ধান তদন্তে আপনার প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা সে পর্যায়ে নেই বলে অনেকে মনে করেন।
ইকবাল মাহমুদ : আপনি ঠিকই বলেছেন। আমরা কিছু কর্মকর্তা বাছাই করে তাঁদের সাইবার ক্রাইমের ওপর প্রশিক্ষণ দেব। আমরা সাইবার ক্রাইমের ওপর একটা টিম করব। এ বিষয়ে উন্নয়ন–সহযোগী দুটি প্রতিষ্ঠান সহায়তা দিতে রাজি হয়েছে।
কেউ যদি হয়রানির শিকার হচ্ছেন বলে মনে করেন, তাঁরা কোথায় যাবেন, কার কাছে যাবেন?
ইকবাল মাহমুদ : তাঁরা আমার কাছে আসবেন, কমিশনের কাছে আসবেন। কমিশনের দরজা খোলা। আপনি নিশ্চিত থাকুন কমিশনে যদি আপনি মেইল দেন, চিঠি দেন, রিপ্লাই পাবেন। এতটুকু নিশ্চয়তা আছে।
আলোচিত কিছু ঘটনা ও মামলা নিয়ে কমিশন কিছু সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে বলে আমরা জেনেছি।
ইকবাল মাহমুদ : আদালতের নির্দেশে আমরা কিছু মামলার পুনঃতদন্ত করছি। এ ছাড়া কিছু অনুসন্ধান ও তদন্ত সম্পর্কে নানা ধরনের কথা রয়েছে এবং আমাদের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে যে এফআরটি ঠিক হয়নি। সেগুলোর নতুন করে অনুসন্ধান ও তদন্ত হবে। তবে এটা সত্য যে আমরা র্যাডিক্যাল কোনো সিদ্ধান্ত নেব না, যাতে ব্যবসার কোনো ক্ষতি হয়। আমরা আসলে স্পিরিট অব দ্য ল দেখব।
গত বছর বেসিক ব্যাংকের জালিয়াতির ঘটনায় ৫৬টা মামলা করেছিল কমিশন। কিন্তু ওই জালিয়াতির ঘটনায় আরও ৭০টির মতো কোম্পানি জড়িত ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। ওই অনুসন্ধানের অবস্থা কী?
ইকবাল মাহমুদ : ওই বিষয়ে অনুসন্ধান চলছে। শিগগিরই আরও কয়েকটি মামলা হবে। শুধু বেসিক ব্যাংক নয়, অনেক ব্যাংক যেমন: সোনালী, জনতা, অগ্রণী—এসব ব্যাংক নিয়ে আমরা বিব্রত। আমাদের আস্থার সংকট এখানেই হয়েছে। সঠিকভাবে এ কাজগুলো করতে পারিনি। এখন সেগুলো নিয়ে ভালোভাবে আমরা কাজ করব। অপরাধীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ব্যাংক খাতের দুর্নীতি নিয়ে কথাটা যখন উঠল তখন বেসিক ব্যাংক নিয়ে আরেকটি প্রশ্ন। বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন, খোদ অর্থমন্ত্রী ও গভর্নর সবাই ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চুকেই জালিয়াতির মূল হোতা বলে চিহ্নিত করেছেন। কিন্তু তাঁর নাম দুদকের কোনো মামলায় আসেনি। নতুন অনুসন্ধানে বা তদন্তে তাঁকে মামলার সঙ্গে যুক্ত করা হবে কি না?
ইকবাল মাহমুদ : অনুসন্ধান কর্মকর্তাদের এসব জনশ্রুতির কথা বলা হয়েছে। আমরা তাঁদের বলেছি ঘটনার গভীরে যেতে। কিন্তু আপনি শুনলে আশ্চর্য হবেন, যে ৫৬টা মামলা হয়েছে সেই মামলায় আপনারা যাঁর কথা বলছেন, এ পর্যন্ত কোনো একজন আসামি তাঁর নাম বলেনি।
বেসিক ব্যাংকের জালিয়াতির ঘটনার অনুসন্ধানে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদকে আসামি না করার বিষয়ে সংসদীয় কমিটি দুদককে কমিটির বৈঠকে ডেকেছিল। যদিও দুদক সেখানে যায়নি। তখন এ প্রশ্ন উঠেছে, দুদককে কি সংসদ ডাকতে পারে? দুদকের জবাবদিহি কার কাছে।
ইকবাল মাহমুদ : দুদক একটি সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান। এটার জবাবদিহি আসলে ওভাবে নেই। তবে এই কমিশন মনে করে জবাবদিহির জায়গা থাকা প্রয়োজন। আইন অনুসারে আমরা প্রতিবছর মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে প্রতিবেদন জমা দিই। সে হিসেবে রাষ্ট্রপতির কাছে জবাবদিহি আছে। রাষ্ট্রপতি সে প্রতিবেদন সংসদের কাছে পাঠাবেন। সংসদে সেটি আলোচিত হবে। সংসদ নির্দেশনা দেবে। সেই নির্দেশনা মহামান্য রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে আসবে। আমরা সে অনুযায়ী কাজ করব।
তাহলে আসল জবাবদিহি কার কাছে?
ইকবাল মাহমুদ : আসল জবাবদিহি নিজের কাছেই, নিজের বিবেকের কাছে। কমিশনের আমরা তিনজন একসঙ্গে বসেছি। বলেছি যে আসলে নিজেদের কাছেই নিজেদের জবাবদিহি করতে হবে। আপনার বিবেক যদি বলে যে এটা সত্য, তাহলে সত্য। মোদ্দা কথা হলো, ইন দ্য লং রান জনগণের কাছে আমাদের জবাবদিহি। এই যে আপনার সঙ্গে আমি কথা বলছি, নানা প্রশ্নের জবাব দিচ্ছি, আপনি মানুষের কাছে তুলে ধরবেন, এটাও জবাবদিহি।
শোনা যায়, কমিশনের ওপর নানা ধরনের চাপ থাকে। সেসব চাপ এড়িয়ে কাজ করা কঠিন। এটা কতটা সত্যি?
ইকবাল মাহমুদ : আসলে কথাটা ঠিক না। আপনি যদি চাপ অনুভব করেন তাহলেই চাপ, অনুভব না করলে চাপ না। আমি কোনো চাপ অনুভব করিনি। এখন যদি কেউ আমাকে রিকোয়েস্ট করেন আর আমি শুনলাম না, তাহলেই তো শেষ।
তার মানে সব নিজের ওপর?
ইকবাল মাহমুদ : হ্যাঁ, নিজের ওপর। আপনি যদি চাপকে চাপ মনে করেন তাহলে আপনার এই চেয়ারে থাকা উচিত না। আমি থাকতে চাই না। এখানে আমি খোলা মনে কাজ করছি। সরকার বা সিভিল সোসাইটি বা সংবাদপত্র কেউ কোনো চাপ দেয়নি। আমি মনে করি, আমি যদি পরিষ্কার থাকি, যদি কোনো দুর্নীতি না করি তাহলে কোনো চাপ আসবে না।
আপনাকে ধন্যবাদ।