উপকূলীয় এলাকায় জলদস্যুদের উপদ্রবে উদ্বিগ্ন গোয়েন্দারা। প্রতিবছর শত কোটি টাকার চাঁদাবাজি ছাড়াও প্রায়ই তাদের হাতে অপহরণের পর খুন হচ্ছেন নিরীহ জেলেরা। গোয়েন্দাদের মতে, উপকূলীয় এলাকায় জন-জীবন বিপন্নকারী এসব জলদস্যুকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে যাচ্ছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় থাকা কিছু স্থানীয় গডফাদার। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির স্থানীয় নেতা ও সংসদ সদস্যরা এ সব জলদস্যুকে আশ্রয়-প্রশয় দেন বলে গোয়েন্দাদের কাছে তথ্য রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সূত্রমতে, জলদস্যুদের উপদ্রব ও তাদের পৃষ্ঠপোষকদের ব্যাপারে আইনগত ব্যবস্থা নিতে এরইমধ্যে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। জলদস্যু দমনে র্যাবের মহাপরিচালকের নেতৃত্বে গঠিত টাস্কফোর্স তাদের তৎপরতা অব্যাহতভাবে চালিয়ে যাচ্ছে বলেও জানান র্যাবের শীর্ষ কর্মকর্তারা।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, ফেনী ও নোয়াখালীর উপকূলীয় এলাকার সাধারণ জেলে ও কৃষিজীবী মানুষ প্রতিনিয়ত জলদস্যু ও ডাকাতদের হিংস্র থাবার শিকার হয়। এ সব জলদস্যু ও ডাকাতের হাতে রয়েছে একে-৪৭, একে-২২ রাইফেল, সিঙ্গেল ল্যান্সার, এলজি, বিদেশি পিস্তল, কাটা রাইফেল, দেশি-বিদেশি বন্দুক, পাইপগান, রামদা, কিরিচসহ বিভিন্ন ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র। জলদস্যু ও ডাকাতরা হামলা চালিয়ে নৌকা, ট্রলার ও চরাঞ্চলে কৃষকদের বাড়ি-ঘরে লুটপাট চালায়। তারা জেলে ও কৃষকদের অপহরণের পর মুক্তিপণ আদায় করে। মুক্তিপণ না পেলে হাত-পা বেঁধে সাগরে ফেলে দেয়। অনেক ক্ষেত্রে ট্রলার মালিক ও মাছের আড়তের মালিকের সঙ্গে যোগাযোগ করার পর দাবিকৃত মুক্তিপণ পেলে অপহৃতদের মুক্তি দিয়ে থাকে তারা। ২০১০ সাল থেকে এ পর্যন্ত বিগত পাঁচ বছরে জলদস্যুদের হাতে অন্তত ৪০০ জেলে ও কৃষক জীবন দিয়েছেন। ২০১৩ সালের ২৮ মার্চ চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপকূলীয় এলাকায় একটি ট্রলারের ৩০ জন জেলেকে হত্যা করে লাশ সাগরে ফেলে দেয় জলদস্যুরা। তখন জাহানারা নামের এক দস্যুরানীর নামও উঠে আসে আলোচনায়। অন্যান্য বাহিনীর একাধিক সদস্যকে আটক করা গেলেও জাহানারা বা তার কোনও সদস্যকে আজ পর্যন্ত আটক করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ইলিশ মৌসুম এলেই জলদস্যুদের দৌরাত্ম্য বেড়ে যায়। কক্সবাজার, বরিশাল, ভোলা, নোয়াখালী, চাঁদপুর, ফেনী ও চট্টগ্রাম সংলগ্ন উপকূলীয় এলাকায় ইলিশ ধরা ট্রলারগুলো থেকে জলদস্যুরা নিয়মিত চাঁদা আদায় করে। কেউ দিতে অস্বীকার করলেই চালানো হয় হামলা। কক্সবাজার থেকে সাতক্ষীরা পর্যন্ত ৭২০ কিলোমিটার উপকূলীয় এলাকার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে জলদস্যুদের একাধিক বাহিনী। এরইমধ্যে বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গোয়েন্দাদের দিয়ে প্রায় তিনশ’ জলদস্যু ও তাদের পৃষ্ঠপোষকদের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। পৃষ্ঠপোষকদের মধ্যে ফেনী-২ আসনের এমপি নিজাম উদ্দিন হাজারী ও ফেনী-৩ আসনের এমপি হাজী রহিম উল্লাহর নামও রয়েছে।
দেশীয় জলদস্যু ও ডাকাতদের পাশাপাশি প্রতিবেশী দেশগুলোর জলদস্যুরাও বাংলাদেশি জলসীমায় সক্রিয় রয়েছে। কোস্টগার্ডের দৃষ্টিতে তারা স্রেফ ‘মাছ চোর’। ভারত, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড ও ইন্দোনেশিয়ান ফিশিং বোটগুলো মাঝে মধ্যে বাংলাদেশের জলসীমায় ঢুকে মাছ ধরার চেষ্টা করে। সম্প্রতি বরগুনায় কোস্টগার্ড সদস্যরা ৩০ জন জেলেসহ একটি ভারতীয় ফিশিং বোট আটক করে। এর আগে সমুদ্র জলসীমা ও উপকূলীয় এলাকায় থাই ফিশিং বোটগুলোর উপদ্রব ছিল। তবে সম্প্রতি কোস্টগার্ড ও নৌবাহিনীর প্রতিরোধের মুখে থাই ফিশিং বোটের আনাগোনাও কমেছে।
কক্সবাজারের কুতুবদিয়া, সোনাদিয়া, মহেশখালী, চট্টগ্রামের মীরসরাই, বাঁশখালী, সন্দ্বীপ, ফেনীর সোনাগাজী, নোয়াখালীর চরজব্বর (সুবর্ণচর), হাতিয়া, কোম্পানীগঞ্জ, লক্ষ্মীপুরের রামগতি, ভোলার চরফ্যাশন, মনপুরা, পটুয়াখালীর দশমিনা, গলাচিপা, কলাপাড়া, রাঙাবালি, বামনা, বরগুনার, পাথরঘাটা ও আমতলী এলাকার উপকূলীয় এলাকায় জলদস্যুদের উৎপাত বেশি। এ ছাড়া বরিশাল, পিরোজপুর, সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাটের উপকূলীয় এলাকায় সুন্দরবনের বন ও জলদস্যুরা জেলেদের মাছ ধরা নিয়ন্ত্রণ করে। এসব উপকূলীয় এলাকায় বছরে শত কোটি টাকার চাঁদাবাজি হয়। চাঁদার এ টাকার ভাগ পৃষ্ঠপোষকরাও পেয়ে থাকেন বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
চট্টগ্রামের মীরসরাই এলাকার গোলাম রসুলের নেতৃত্বে রসুল্লা বাহিনীর সদস্যরা ২৫ কিলোমিটার উপকূলীয় এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে। এ ছাড়া সন্দ্বীপের উড়িরচর এলাকার ৫৩ জন জলদস্যু চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে। তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় রয়েছেন মীরসরাইর সাহেরখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নূরুল মোস্তফা, মীরসরাই উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন, সন্দ্বীপ পৌরসভার মেয়র জাফর উল্লাহ টিটু ও সন্দ্বীপ উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান মাঈন উদ্দিন মিশন।
কক্সবাজারের সোনাদিয়া উপকূলে জাম্বু ও নাগু বাহিনী, বিচ্ছু বাহিনী, ফিরোজ বাহিনী, মহেশখালীর মাতারবাড়ী উপকূলে শামসু বাহিনী, গোরকঘাটায় একরাম বাহিনী, ঘড়ি ভাঙায় সাব্বির বাহিনী, কুতুবদিয়া উপকূলে রমিজ বাহিনী, ইউনুছ বাহিনী, বাতেন বাহিনী, বাদল বাহিনী, দিদার বাহিনী, মজিদ ও জয়নাল বাহিনী, বাঁশখালী উপকূলে রবি বাহিনী, পেকুয়ার রাজাখালীর সেলিম ও রহিমা বাহিনীসহ অর্ধশত জলদস্যু এই এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে বলে গোয়েন্দারা জানান।