চেহারা অবিকল ইলিশের মতো, আসলে ইলিশ নয়। ইলিশের মতো দেখতে এমন মাছের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ‘চন্দনা’ মাছ। এই মাছটিকে কেউ-কেউ ‘সার্ডিন’, ‘চাকোরি’, ‘কলোম্বো’ ও ‘ডটেড গিজার্ড শাড’ নামেও চেনেন। পহেলা বৈশাখে ইলিশের ব্যাপক চাহিদার গুণে-মানে ‘মাছের রাজার’ ধারে কাছে না থাকলেও এই মাছটিই এখন রাজধানীর বাজারজুড়ে ‘ইলিশ’ নামেই বিক্রি হচ্ছে।
মাছটি সমুদ্রে জেলেদের জালে ধরা পড়ে। এই মাছের গায়ের রং ইলিশের মতো সাদা হলেও পিঠ ইলিশের মতো সুরমা রংয়ের নয়। চোখ বড়। ইলিশের মতো ততটা চ্যাপ্টাও নয়। সাইজে এবং দেখতে অনেকটাই ইলিশের কাছাকাছি হওয়ার সুবাদে এর সুবিধা নিচ্ছেন মাছ ব্যবসায়ীরা। প্রতিবছরই এমনটি হয়। সামুদ্রিক ইলিশ বলে চালিয়ে দিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। কেউ-কেউ বলেন ‘ফুট্টা ইলিশ’। রাজধানীজুড়ে ইলিশের দামে বিক্রি হচ্ছে এই ‘চন্দনা’ বা ‘ফুইট্টা ইলিশ’। পহেলা বৈশাখে ‘পান্তা-ইলিশের’ তথাকথিত ঐতিহ্য ধরে রাখতে ক্রেতারা ভিনদেশি ভিন্ন জাতের এ সব মাছ কিনে প্রতিনিয়ত প্রতারিত হচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
পহেলা বৈশাখ উদযাপনে পান্তার সঙ্গে এক টুকরা ইলিশ নিশ্চিত করতে হন্যে হয়ে ঘুরছেন নগরবাসী। এ মার্কেট থেকে ওই মার্কেট। আবার কেউ যাচ্ছেন পদ্মার পাড়ে মাওয়া ঘাটে। অথবা আরিচা, পাটুরিয়া বা দৌলদিয়ায়। কেউ-কেউ খোঁজ নিচ্ছেন চাঁদপুর, পিরোজপুর, ভোলা বা বরিশালের মাছের আড়ৎগুলোয়। যাদের কাছে শখের তোলা কোটি টাকা, তারা টাকার দিকে নজর রাখছেন না। তারা খুঁজে বেড়াচ্ছেন মনের মতো তাজা, ভালো ও বড় সাইজের ইলিশ। হাতের নাগালে পেলেই হয়। কিনে নিচ্ছেন, দাম যতই হোক। আবার কেউ খুঁজে বেড়াচ্ছেন নিজের সাধ্যের মধ্যে ইলিশ। সাইজ তার যাই হোক। সাইজ বিষয় নয়। জাটকা, বাচ্চা একটা কিছু হলেই হলো। পহেলা বৈশাখের সকালে সবার সঙ্গে মিলেমিশে এক টুকরা ইলিশ দিয়ে এক প্লেট পান্তা খেতে পারলেই তারা খুশি। সব কিছু মিলিয়ে রাজধানীসহ সারাদেশে এখনই ইলিশের ব্যাপক চাহিদা।
বাংলাদেশের পদ্মার ইলিশের সুনাম জগৎজোড়া। এ দেশের ইলিশে ভারতের কলকাতায় জামাই ষষ্ঠীর খবর পুরনো। স্বাদের রূপালি ইলিশ নিয়ে রচিত হয়েছে যত কাব্য। সেই ইলিশ এখন সোনার হরিণ। পহেলা বৈশাখ এলেই ইলিশ নিয়ে মাতামাতি যেন আরও বেড়ে যায়। এক দিনের জন্য হলেও পান্তা ভাতে ইলিশ থাকা চাই। কিন্তু বাজারে ইলিশের অনুপস্থিতি ভাবিয়ে তুলছে সব স্তরের নাগরিকদের। পদ্মায় ইলিশ নেই, মেঘনার মোহনায় ইলিশ নেই, তেতুলিয়ায় ইলিশ নেই। কীর্তনখোলায়ও ইলিশ নেই। একই সঙ্গে বঙ্গোপসাগরেও ইলিশ নিখোঁজ। তাই অধরা ইলিশের দামও হয়ে উঠেছে অধরা। ইলিশের বাজারে তাই ক্রেতাদের নীরব দীর্ঘশ্বাস। এই সুযোগে তাজা, বাসী, ফ্রিজিংকরা, পচা, গলা ইলিশের পাশপাশি ইলিশের মতো দেখতে ‘চন্দনা’ মাছও ইলিশ বলে বিক্রি হচ্ছে রাজধানীর পাড়া মহল্লাসহ বাজারগুলোয়। মানুষও কিনছেন।
মৎস্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বাদে পার্থক্য থাকলেও ইলিশের ছোট আকারের একটি প্রজাতিই হচ্ছে এই ‘চন্দনা’। দেখতে হুবহু ইলিশের মতো এই মাছকে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় বলা হয় ‘ফুইট্টা ইলিশ’। এছাড়া রাজধানীর বাইরে সিলেট ও উত্তরাঞ্চলের মানুষ এই মাছকে ‘চন্দনা ইলিশ’ নামেই চেনেন।
বিদেশি মাছের অন্যতম আমদানিকারক কাওরানবাজারের দেলোয়ার হোসেন জানান, ‘চন্দনা’ এক ধরনের সামুদ্রিক মাছ। প্রতি কেজিতে ৬টি থেকে শুরু করে ১৬টি পর্যন্ত ওঠে এই মাছ। এই মাছ ভিয়েতনাম মধ্যপ্রাচ্য থেকে আমদানি করা হচ্ছে। তিনি বলেন, আমরা প্রতিকেজি ১০০ টাকা দরে এই মাছ সিলেট ও উত্তরবঙ্গে সরবরাহ করি। যা খুচরা পর্যায়ে বিক্রি হয় সর্বোচ্চ ১৮০টাকা দরে। তবে পহেলা বৈশাখের আগে এর দাম বাড়ে। পাশাপাশি মিয়ানমার থেকেও কিছু ইলিশ আমদানি হচ্ছে। খুচরা ব্যবসায়ীরা ইলিশের দামেই এই মাছ বিক্রি করছেন। তিনি বলেন, উৎপাদনকারী ওইসব দেশের মানুষ ইলিশের মতো দেখতে এসব মাছ খান না। তাই খুব কম দামে অর্থাৎ মাত্র ১ ডলার ৫ সেন্ট মূল্যে মাছগুলো আমদানি করা যায়।
কাস্টমস সূত্র জানায়, ইলিশের মতো দেখতে এই সামুদ্রিক মাছ নিয়ে ক্রেতারা বিভ্রান্ত বা প্রতারিত হলেও মাছগুলো আমদানি নিষিদ্ধ নয়। তবে ইলিশ এবং সার্ডিন-চাকোরির কাস্টমস ট্যারিফ ভিন্ন। ছোট আকারের ইলিশের ট্যারিফপ্রতি টনে ৭৫০ ডলার, সার্ডিনে ৪০০ ডলার। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন আমদানিকারক জানান, বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে মিয়ানমার থেকে বিপুল পরিমাণ ইলিশ আমদানি করা হয়েছে। এসব আমদানি করা ইলিশ চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে দেশের বিভিন্ন জেলায় চলে যাচ্ছে। চলতি সপ্তাহেই আমদানিকারকরা আরও ৪০ কন্টেইনার ইলিশের জন্য এলসি খুলেছেন বলে জানান তিনি।
এদিকে, দেশে এমনিতে এখন ইলিশের মৌসুম নয়। এরপর রয়েছে ইলিশ ধরতে সরকারি নিধোজ্ঞা। অথচ পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে ইলিশের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এই সুযোগে দামও উঠেছে হাজার টাকার ওপরে। আর ঝুড়ি ভরা ইলিশের নামে চন্দনা নিয়ে পাড়ায়পাড়ায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন মাছবিক্রেতা।
পশ্চিম বাংলার তিস্তায়ও ইলিশের মতো দেখতে একটি মাছ পাওয়া গেছে। এই মাছটি ইলিশের মতো দেখতে হলেও সেটি ইলিশ নয়। মৎস্য বিভাগের কর্মকর্তাদের দাবি, ওই মাছ ইলিশ নয় ‘টেনিওয়ালোসা’ গোত্রের ‘টোলি’ মাছ। একই গোত্রভুক্ত ইলিশ। ওপারের ভোজনরসিক বাঙালি মহলে এই মাছ নিয়েও চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে। অর্থাৎ ইলিশ নয়, ইলিশের মতো দেখতে মাছ পেয়েই নাকি তারা আনন্দে আটখানা হয়ে উঠেছেন।
সরেজমিনে সোমবার সকালে রাজধানীর শাহজাহানপুর ও মালিবাগে দেখা যায়, রাস্তায় রাস্তায় বিক্রি হচ্ছে জাটকার (ছোট ইলিশ) মতো দেখতে একধরনের মাছ। বিক্রির ফাঁকে ফাঁকে বিক্রেতা পাতিল থেকে বের করে ধুয়ে মাছগুলো আবার পাতিলে ভরছেন। কাছে গিয়ে পরিচয় জানতে চাইলে বলেন, আমরা কিশোরগঞ্জ থেকে এসেছেন। কয়েক দিন ধরে তারা শহরের অলিগলিতে ঘুরে-ঘুরে এসব মাছ বিক্রি করছেন। কী মাছ জানতে চাইলে বলেন, সমুদ্রের ‘চন্দনা’ ইলিশ। পরিষ্কার করে ধোয়ার পর মাছগুলো দেখতে ছোট জাটকার মতো চকচক করছে। জাটকা ভেবেই লোকজন কিনছেন বলে জানালেন ওই বিক্রেতারা।
মাছ বিক্রি দেখতে মাছওয়ালাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা স্থানীয় একজন বললেন, দুদিন আগে গ্রাম থেকে তিনি ৬০০ থেকে ৭০০ গ্রাম ওজনের চারটি মাছ ১০০ টাকায় কিনেছেন। স্বাদ ভালোই। যাদের ইলিশ কেনার সামর্থ্য নেই, তারাই মূলত ইলিশের স্বাদ নিতে অপেক্ষাকৃত কম দামে এই চন্দা ইলিশ কিনছেন।
উল্লেখ্য, গত ২০০৯-১০ অর্থবছরে ৩ লাখ ৬০ হাজার টন ইলিশ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে উৎপাদন হয়েছে ২ লাখ ৮৬ হাজার টন। ২০১০-১১ অর্থবছরে ৩ লাখ ৪০ হাজার টন ইলিশ উৎপাদন হয়। গত অর্থবছরে ৩ লাখ ৪০হাজার টনের বেশি ইলিশ উৎপাদন হয়েছে বলে সরকারিভাবে দাবি করা হয়।