এইচ এম এরশাদের ঘোষণার পাল্টায় রওশন এরশাদকে জাতীয় পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন ঘোষণা করে দলের মহাসচিবের পদ খুইয়েছেন জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু, তার জায়গায় ফিরেছেন চেয়ারম্যানের দীর্ঘদিনের আস’াভাজন এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার।
জাতীয় পার্টিতে আবারও ভাঙনের গুঞ্জনের মধ্যে গতকাল মঙ্গলবার বনানীতে এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে ভাই জিএম কাদেরকে পাশে নিয়ে এরশাদ এ ঘোষণা দেন।
তিনি আবারও বলেন, নেতাকর্মীদের সম্মতিতে পরবর্তীতে দলের দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত করার জন্যই জিএম কাদেরকে কো-চেয়ারম্যান করা হয়েছে। দলীয় গঠনতন্ত্রে ওই পদ না থাকলেও আগামী সম্মেলনে বিষয়টির সুরাহা করে ফেলা হবে। খবর বিডিনিউজের।
গত কয়েক বছরে নানা নাটকীয়তার জন্ম দেওয়া সাবেক সামরিক শাসক এরশাদ রোববার নিজের জেলা রংপুরে সংবাদ সম্মেলন করে ভাই জি এম কাদেরকে দলের কো-চেয়ারম্যান ও উত্তরসূরি ঘোষণা করেন।
এরপর সোমবার রাতে ঢাকায় পার্টির সরকার সমর্থক সাংসদ ও সভাপতিমণ্ডলীর নেতাদের একাংশের ‘যৌথ সভা’ থেকে এরশাদের সিদ্ধান্তকে ‘গঠনতন্ত্রবহির্ভূত’ ঘোষণা হয়। সে সঙ্গে এরশাদের স্ত্রী বিরোধীদলীয় নেতা রওশনকে দলের ‘ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন’ করা হয়েছে বলে জানান পার্টির মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু।
এর মধ্য দিয়ে ১৯৮৬ সালে যাত্রা শুরু করা এই দলটিতে নতুন করে ভাঙনের গুঞ্জন শুরু হয়। পাঁচদিনের সফর সংক্ষেপ করে ঢাকায় চলে আসেন এরশাদ, হাজির হন সংবাদ সম্মেলনে।
বাবলুকে মহাসচিব পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়ার ঘোষণা দিয়ে পার্টি চেয়ারম্যান বলেন, দলের কাউন্সিল আয়োজনে বাবলু ব্যর্থ হয়েছেন।
“বাবলুকে মহাসচিব পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে দলের স্বার্থে।”
এরপর দীর্ঘদিনের আস’াভাজন রুহুল আমিন হাওলাদারকে মহাসচিবের দায়িত্বে ফিরিয়ে আনার ঘোষণা দেন এরশাদ।
“রুহুল আমিন হাওলাদার আমার মহাসচিব ছিলেন ১৪ বছর। আজ থেকে মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করবেন রুহুল আমিন হাওলাদার।”
বিএনপিবিহীন দশম সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির অংশগ্রহণের বিপক্ষে ছিলেন এরশাদ। হাওলাদারও সেই পক্ষ নেন।
অন্যদিকে রওশনের নেতৃত্বে পার্টির আরেকটি অংশ নির্বাচনে থাকার পক্ষে অবস’ান নেয়। বাবলু ছিলেন সেই পক্ষে।
বর্জন করেও আইনের মারপ্যাঁচে সেই ভোটে জিতে সংসদ সদস্য হয়েছেন এরশাদ; পেয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূতের পদ। আর বিএনপির বর্জনে রওশন হয়েছেন বিরোধী দলীয় নেতা।
ভোট নিয়ে সেই মতদ্বন্দ্বের জেরে ২০১৪ সালের এপ্রিলে জাতীয় পার্টির মহাসচিবের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় হাওলাদারকে। নতুন মহাসচিব হন রওশনঘনিষ্ঠ বাবলু।
জাতীয় পার্টির নেতাদের সরকারে থাকা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে দুই পক্ষের পাল্টাপাল্টি বক্তব্যের মধ্যেই এরশাদ বলেছিলেন, রওশনই তার কাণ্ডারি।
মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলনে এরশাদ বলেন, “দুজন নেতা আমার এবং আমার স্ত্রী রওশন এরশাদের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টির চেষ্টা করছেন। আমাদের মধ্যে কোনো বিভেদ নেই, থাকতে পারে না।”
আগের রাতে সভাপতিমণ্ডলির কথিত যে বৈঠক থেকে রওশনকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ঘোষণা করা হয়েছে- সেই সভা রওশন ডাকেননি বলেও দাবি করেন এরশাদ।
“আমার স্ত্রী রওশন এরশাদ প্রেসিডিয়াম মেম্বার। প্রেসিডিয়িাম মিটিং ডাকার এখতিয়ার একমাত্র আমার। আমি এখনও চেয়ারম্যান আছি। সিদ্ধান্ত কেবল আমিই দিতে পারি।”
এরশাদ বলেন, পার্টির দিকটি তিনিই দেখেন; রওশন দেখেন ‘পার্লামেন্টারি বডি’।
“আমাদের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব নাই, দ্বন্দ্ব ছিলও না। গতকাল যা হয়েছে তা প্রেসিডিয়াম মিটিং ছিল না। রওশন কোনো মিটিং ডাকে নাই।”
তিনি প্রশ্ন করেন- রওশনকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করার যে ঘোষণা এসেছে, ‘তা দেওয়ার বাবলু কে?’
এরশাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ :
জাতীয় পার্টিতে নতুন কো চেয়ারম্যান নিয়োগ ও মহাসচিব পরিবর্তনের যে সিদ্ধান্ত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ দিয়েছেন, তা প্রত্যাখ্যানের কথা জানিয়েছে পার্টির সংসদীয় দল।
জাতীয় সংসদের নবম অধিবেশন সামনে রেখে মঙ্গলবার জাতীয় সংসদ ভবনে জাতীয় পার্টির সংসদীয় দলের বৈঠকের পর বিরোধীদলীয় প্রধান হুইপ তাজুল ইসলাম চৌধুরী সাংবাদিকদের এ কথা জানান।
তিনি বলেন, “এ পর্যন্ত যা হয়েছে, চেয়ারম্যান যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, দলের প্রতিটি সদস্য তার বিরোধিতা করেছেন। আমরা তা মেনে নিতে পারিনি। প্রেসিডিয়াম ও সংসদীয় দলের বৈঠকে আলোচনা করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে বলা হয়েছে।
“চেয়ারম্যানও বলেছেন, বিরোধীদলীয় নেতার সঙ্গে আলোচনা করেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।”
মহাসচিবের পদ হারানো জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু, প্রেসিডিয়াম সদস্য আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও মুজিবুল হক চুন্নুসহ রওশন এরশাদপনি’ কয়েকজন সাংসদ এ সময় তাজুলের পাশে ছিলেন।
শীর্ষ পর্যায়ে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে পাল্টাপাল্টি ঘোষণার মধ্যেই বিরোধীদলীয় নেতা রওশনের সভাপতিত্বে জাতীয় পার্টির সংসদীয় দলের এই বৈঠক হয়, যাতে এরশাদও উপসি’ত ছিলেন।
রুহুল আমিন হাওলাদারসহ জাতীয় পার্টির ৪০ জন সংসদ সদস্যের সবাই ছিলেন বৈঠকে।
এই বৈঠক শুরুর দুই ঘণ্টা আগে এক ‘জরুরি’ সংবাদ সম্মেলনে এরশাদ বাবলুকে ‘অব্যাহতি’ দিয়ে হাওলাদারকে মহাসচিব করার ঘোষণা দেন।
তার আগে গত রোববার নিজের জেলা রংপুরে সংবাদ সম্মেলন করে ভাই জি এম কাদেরকে দলের কো-চেয়ারম্যান ও উত্তরসূরি ঘোষণা করেন এরশাদ।
এর মধ্য দিয়ে ১৯৮৬ সালে যাত্রা শুরু করা এই দলটিতে নতুন করে ভাঙনের গুঞ্জন শুরু হয়। অবশ্য ভাঙনের আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে মঙ্গলবার দুপুরে নিজের কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এরশাদ বলেন, ‘অসম্ভব’, জাতীয় পার্টি ‘বিভাজিত হবে না’।
“দেয়ার ইজ নো সঙ্কট ইন জাতীয় পার্টি। আমি যতক্ষণ বেঁচে আছি ততক্ষণ কোনো সঙ্কট নোই। নো ওয়ান কুড ব্রেক ইট,” জোর গলায় বলেন এরশাদ।
দলীয় কোনো ফোরামে আলোচনা ছাড়াই মহাসচিবের পদে রদবদলের ঘোষণা গণতান্ত্রিক কি না-এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে সাবেক এই সামরিক শাসক বলেন, জাতীয় পার্টির ‘সর্বময় ক্ষমতার’ অধিকারী তিনি এবং দল থেকেই তাকে এ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
“আমি এই দলের চেয়ারম্যান। দলে নতুন পদ সৃষ্টি এবং তাতে কাউকে মনোনয়ন দেওয়ার এখতিয়ার আমার আছে। ব্যারিস্টার আনিসকে একবার অ্যাক্টিং চেয়ারম্যান করেছিলাম প্রেসিডিয়ামে আলোচনা না করেই। বাবলুকে যখন মহাসচিব করেছিলাম, তা প্রেসিডিয়ামে আলোচনা হয়নি। দলের গঠনতন্ত্রে বিশেষ উপদেষ্টা নামে কোনো পদ ছিল না। আমি সেই পদ সৃষ্টি করে ববি হাজ্জাজকে এর জন্য মনোনীত করেছিলাম। তখন তো প্রেসিডিয়ামে আলোচনার কথা ওঠেনি।”
রুহুল আমিন হাওলাদারকে মহাসচিব ঘোষণা করে এরশাদ বলেন, “চেয়ারম্যানের ক্ষমতাবলে আমি হাওলাদারকে সরিয়ে বাবলুকে মহাসচিব করেছিলাম। আজ বাবলুকে সরিয়ে হাওলাদারকে মহাসচিব হিসেবে মনোনীত করলাম। আমার সেই এখতিয়ার আছে।”
‘মৃত্যু পর্যন্ত’ অটল থাকবেন এরশাদ :
নতুন কো চেয়ারম্যান নিয়োগ ও মহাসচিব পরিবর্তন নিয়ে জাতীয় পার্টিতে বিদ্রোহের মুখে চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বলেছেন, তিনি সিদ্ধান্ত থেকে সরবেন না। সংসদীয় দলের বৈঠকের পর জাতীয় সংসদ ভবন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “আমার সিদ্ধান্ত অটুট থাকবে। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আমি অটল থাকব।”
ওই বৈঠক শেষে জিয়াউদ্দিন বাবলু, প্রেসিডিয়াম সদস্য আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও মুজিবুল হক চুন্নুকে নিয়ে বেরিয়ে এসে বিরোধী দলীয় প্রধান হুইপ তাজুল ইসলাম চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, পার্টির সংসদীয় দল চেয়ারম্যানের সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করেছে।
“জাতীয় পার্টির কো চেয়ারম্যান ঘোষণা, মহাসচিব পদে নতুন একজনকে দায়িত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্ত আমরা মেনে নিতে পারিনি। এটা পরিবর্তন করতে হবে।”
এ বিষয়গুলো নিয়ে প্রেসিডিয়াম ও সংসদীয় দলের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে চেয়ারম্যানকে অনুরোধ করা হয়েছে বলে জানান তাজুল।
“দলকে রক্ষা করতে হলে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। চেয়ারম্যানের সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের জন্য বলেছি আমরা। কো-চেয়ারম্যান ও নতুন মহাসচিবের বিষয়গুলো আমরা মেনে নিইনি; প্রত্যাখ্যান করেছি। এ বিষয়ে সংসদীয় দলের বৈঠকে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে।
অবশ্য বিকালে এরশাদের সঙ্গে সংসদ ভবন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় সাংবাদিকদের সামনে এসে সুর সামান্য পাল্টে ফেলেন তাজুল।
পার্টি চেয়ারম্যান কথা বলার আগেই তাজুল বলতে শুরু করেন, “আমরা স্যারের বক্তব্যের সঙ্গে একমত নই। তবে প্রত্যাখ্যান করেছি- এ কথা বলিনি।
“স্যারের উপর আমরা দায়িত্ব দিয়েছি, ম্যাডামের সঙ্গে আলোচনা করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে।”
এরপর তাজুল পিছিয়ে গেলে এরশাদ এগিয়ে আসেন। সাংবাদিকরা জানতে চান, তিনি সিদ্ধান্ত বদলাবেন কি-না। এক বাক্যে অটল থাকার কথা জানিয়ে গাড়িতে উঠে চলে যান এরশাদ।