কক্সবাজার জেলায় মাধ্যমিক, কলেজ ও মাদ্রাসার দুই শতাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার নেই। এসব প্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার নির্মাণের কোন উদ্যোগও নেই। যার কারণে যথাযোগ্য মর্যাদায় অমর একুশের দিন শিক্ষার্থীরা ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনে ভোগান্তির শিকার হচ্ছে। এসব স্কুলের শিক্ষার্থীরা কলাগাছ, স্কুলের বেঞ্চ বা বাশঁ দিয়ে প্রতীকি শহীদ মিনার তৈরী করে শহীদদের শ্রদ্ধা জানিয়ে আসছে। অনেকে অনেক দূরে গিয়ে শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানাচ্ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধান ও ব্যবস্থাপনা কমিটির অনিহা এবং সরকারের সংশ্লিষ্ঠ দপ্তরের নিরবতার কারণে প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার নির্মাণ করা সম্ভব হচ্ছেনা বলে সংশ্লিষ্ঠদের সাথে কথা বলে জানা গেছে। অথচ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার স্থাপনে শিক্ষা অধিদপ্তরের নির্দেশনা রয়েছে।
সূত্রে জানা গেছে, কক্সবাজার জেলায় মাধ্যমিক, কলেজ ও মাদ্রাসার মধ্যে হাতে গোনা কয়েকটি ছাড়া অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভাষা শহীদদের স্মরণে কোন শহীদ মিনার নেই। ফলে এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীরা ৫২’র ভাষা আন্দোলন ও ৭১’র মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃৃত ইতিহাস জানা, লালন ও পালন থেকে বঞ্চিত থেকে যাচ্ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ভাষা নিয়ে শিক্ষার্থীদের শ্রেণী পাঠদান করা হলেও সে ভাষার জন্য শহীদদের মর্যাদা রক্ষায় তাদেরকে উদ্বুদ্ধ করতে কোনো শহীদ মিনার নির্মাণ বা তা রক্ষণাবেক্ষণ করতে দেখা যাচ্ছে না। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার থাকলেও তা ভেঙ্গে আর কখনো পুনরায় বানানো হয়নি। ফলে যেসব প্রতিষ্ঠানে রয়েছে সেগুলোও এখন প্রায় জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে।
খোদ কক্সবাজার জেলা শহরের কক্সবাজার পৌরসভা পরিচালিত কক্সবাজার পৌর প্রিপ্যারেটরী উচ্চ বিদ্যালয়, সৈকত বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, আমেনা খাতুন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, সাহিত্যিকা উচ্চ বিদ্যালয়, বাহারছড়া উচ্চ বিদ্যালয়, টিএমসি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, কলাতলী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়সহ সিংহভাগ বিদ্যালয়ে এখনো শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়নি। জানতে চাইলে পৌর প্রিপ্যারেটরী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নুরুল ইসলাম বলেন, ‘নানা কারণে এতোদিন শহীদ মিনার নির্মিত হয়নি। তবে সম্প্রতি দরপত্র আহবান করা হয়েছে। দ্রুত শহীদ মিনার হয়ে যাবে।’ সৈকত বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক সমর কান্তি নাথ বলেন, ‘জায়গা না থাকায় শহীদ মিনার স্থাপন করা যাচ্ছে না।’ সাহিত্যিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ইকবাল হোসাইন বলেন, ‘আমরা পার্শ্ববর্তী সিটি কলেজে গিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করি।’
শুধু এসব বিদ্যালয় নয়, পুরো জেলায় দু’শতাধিক বিদ্যালয়ে শহীদ মিনার নেই বলে জানা গেছে।
কক্সবাজার জেলা শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা গেছে, জেলায় মাধ্যমিক, কলেজ ও মাদ্রাসা মিলে মোট ২৮৩ টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তৎমধ্যে মাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে ১৪০ টি, কলেজ ২০ টি ও মাদ্রাসা ১২৩ টি। এর মধ্যে শুধুমাত্র ২০ শতাংশ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শহীদ মিনার রয়েছে। ২০ টি কলেজের মধ্যে শহীদ মিনার রয়েছে ১১ টিতে। এছাড়া হাতে গোনা মাত্র কয়েকটি মাদ্রাসায় শহীদ মিনার থাকলেও সিংহভাগ মাদ্রাসা শহীদ মিনার বিহীন। যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার রয়েছে সেগুলোও বছরে মাত্র একদিন সাজানো হয়। এছাড়া পুরো বছর থাকে অযতেœ, অবহেলায় ও আবর্জনার স্তূপে পরিপূর্ণ।
জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস থেকে এ বিষয়ে গুরুত্বারোপ করে শহীদ মিনার নির্মাণের জন্য সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শহীদ মিনারের অবস্থা জানতে চেয়ে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারের কাছে চিঠি প্রেরণ করলেও এখনো কোন জবাব মিলেনি। উপজেলা শিক্ষা অফিসারের দায়িত্বহীনতা ও সংশ্লিষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও পরিচালনা কমিটি শহীদ মিনার নির্মাণের বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ায় সর্বমহলে চরম ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। শুধু তাই নয় মহান ভাষা আন্দোলনের দীর্ঘ ৬৪ বছর অতিবাহিত হলেও শহীদ মিনারহীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোর শিক্ষক এবং পরিচালনা পর্ষদের একঘেয়েমী আচরনে শিক্ষার্থীরা ক্রমশ: ভাষা দিবসের মর্যাদার ব্যাপারে চেতনাহীন হয়ে পড়ছে।
এ প্রসঙ্গে কক্সবাজার সদর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার মো: সেলিম উদ্দীন জানান, সদরে মোট শিক্ষা প্রতিষ্টান রয়েছে ৬২ টি। তৎমধ্যে কলেজ ৪ টি, মাধ্যমিক বিদ্যালয় ২৮ টি ও মাদ্রাসা ৩০ টি। শহীদ মিনার রয়েছে মাত্র ১৪ টি শিক্ষা প্রতিষ্টানে। যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার নেই সেগুলোতে দ্রুত নির্মাণের জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
রামু উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার মোহাম্মদ তৈয়ব জানান, রামুতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে ২৭ টি। তৎমধ্যে মাধ্যমিক বিদ্যালয় ১৫ টি, মাদ্রাসা ১১ টি, ও কলেজ ১ টি। এসবের মধ্যে হাতে গোনা কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার রয়েছে। তবে নির্দিষ্ট করে কয়টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শহীদ মিনারহীন তার জানা নেই বলে জানান তিনি।
মহেশখালী উপজেলা শিক্ষা অফিসার মো: ফজলুল করিম জানান, মহেশখালী উপজেলায় মোট শিক্ষা প্রতিষ্টান রয়েছে ৩৭ টি। তৎমধ্যে মাধ্যমিক বিদ্যালয় ১৪ টি, মাদ্রাসা ১৯ টি ও কলেজ ৪ টি। এসবের মধ্যে ১৫ টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার রয়েছে। অন্য গুলোতে শহীদ মিনার নির্মাণের জন্য উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বলে জানান।
কুতুবদিয়া উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার মো: রজব আলী জানান, কুতুবদিয়া উপজেলায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে ১৯টি। তৎমধ্যে মাধ্যমিক বিদ্যালয় ০৯ টি, মাদ্রাসা ০৯ টি ও কলেজ ০১টি। শহীদ মিনার রয়েছে শুধুমাত্র কুতুবদিয়া আর্দশ উচ্চ বিদ্যালয়ে।
চকরিয়া উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার রতন বিশ্বাস জানান, চকরিয়া উপজেলায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে ৬৪ টি। তৎমধ্যে মাধ্যমিক বিদ্যালয় ৩৪ টি, মাদ্রসা ২৬ টি ও কলেজ ৪ টি। এসবের মধ্যে ৫৬টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার রয়েছে। যে কয়টিতে নেই সেখানেও নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
পেকুয়া উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার মাহফুজুর রহমান জানান, পেকুয়ায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে ২১ টি। এরমধ্যে মাধ্যমিক বিদ্যালয় ১০ টি, মাদ্রাসা ১০ টি ও কলেজ ১ টি। শুধুমাত্র কলেজটি ছাড়া অন্য কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার আছে কিনা তার জানা নেই বলে জানান।
উখিয়া উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার মো: রাইহানুল ইসলাম মিয়া জানান, উখিয়ায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে ২৪ টি। তৎমধ্যে মাধ্যমিক বিদ্যালয় ১৩ টি, মাদ্রাসা ৮ টি ও কলেজ ৩ টি। প্রায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার রয়েছে দাবী করলেও নির্দিষ্ট কয়টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার রয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘শহীদ মিনারের খবর রেখে আমার লাভ কি।’ শহীদ মিনার আছে কি নাই সেটা তদারকি করা আমার কাজ নয় বলে ফোন কেটে দেন তিনি।
টেকনাফ উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার মোঃ নুরুল আবছার জানান, টেকনাফে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রয়েছে ২৯ টি। তৎমধ্যে মাধ্যমিক বিদ্যালয় ১৭ টি, কলেজ ২ টি ও মাদ্রাসা ১০ টি। এরমধ্যে সকল মাধ্যমিক ও কলেজ গুলোতে শহীদ মিনার রয়েছে। হাতে গোনা কয়েকটি ছাড়া বাকি মাদ্রাসা গুলোতেও শহীদ মিনার রয়েছে বলে জানান তিনি।
এ প্রসঙ্গে কক্সবাজার জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার মোঃ জসিম উদ্দিন জানান, যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার নেই সেই সব প্রতিষ্ঠানকে দ্রুত শহীদ মিনার নির্মানের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ এবং যে সব প্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার রয়েছে সেসব প্রতিষ্ঠানকে শহীদ মিনার পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করনের জন্য চিঠি প্রদান করা হয়েছে। একই চিঠিতে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারকে শহীদ মিনারবিহীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তালিকা প্রেরণ করতে বলা হয়েছে।
তিনি আরো জানান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার নির্মাণের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের মানসিকতার পরিবর্তন অনেক বেশি জরুরি। কারণ প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ঠরা সরকারী বরাদ্ধের দিকে চেয়ে থাকে। যদিও প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানের পক্ষে নিজেদের আয় দিয়ে শহীদ মিনার নির্মাণ করা সম্ভব। কিন্তু এ রকম মনোভাব বা মানসিকতা খুব কমই দেখা যায়। সরকারী বরাদ্ধ না আসলে শিক্ষা অফিসেরও কিছুই করার থাকেনা। তারপরও মন্ত্রণালয়ে প্রতিবারের ন্যায় এবারও বরাদ্ধের প্রস্তাব পাঠানো হবে। যদি বরাদ্ধ আসে তাহলে প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার নির্মাণ করা হবে। তবে প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে শহীদ দিবস যথাযোগ্য মর্যাদায় পালনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।