কক্সবাজার রিপোর্ট : কক্সবাজার জেলায় লবণের মূল্য কমে এসেছে অর্ধেকে। ব্যাপক দরপতনে হতাশ হয়ে পড়েছেন জেলার লবণ চাষীরা। হঠাৎ লবণের দরপতনের কারণ হিসেবে সিন্ডিকেটধারীদের অপতৎপরতাকে দায়ী করছেন জেলার লবণ চাষীরা। কুতুবদিয়ায় অর্ধেকে নেমেছে লবণের দাম ঃ কুতুবদিয়া থেকে আমাদের কুতুবদিয়া প্রতিনিধি এম.এ মান্নান জানিয়েছেন, কুতুবদিয়ায় হঠাৎ অর্ধেকে নেমে গেছে লবণের দাম। ফলে দিশেহারা এখন চাষিরা। চলতি লবণ উৎপাদন মৌসুমে গত দু‘সপ্তাহ ধরে রেকর্ড দামে নতুন লবন মাঠে বেচা-কেনা হতো। উপজেলার প্রতিটি লবণ মাঠে মণ প্রতি ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। গত শুক্রবার (ফেব্রুয়ারি) হঠাৎ লবণ ব্যবসায়িরা মাঠে লবণের দাম ১২০ থেকে ১৫০ টাকায় নামিয়ে আনেন। উত্তর ধুরুং বাঁকখালী গ্রামের মো. সেলিম জানান, মাঠে লবণের দাম দেড়‘শ টাকা মণ। চট্টগ্রাম ও নারায়নগঞ্জে মিলগুলোতে দাম পড়ে যাওয়ায় এমনটি বলে লবণ ব্যবসায়িরা তাদের জানিয়েছে। যে কারণে চাষিদের হঠাৎ মাথায় যেনো বাজ পড়েছে। ধুরুং সতরুদ্দীন এলাকার বিশিষ্ট কালু কোম্পানীর একটি ৫ হাজার মণ ধারনক্ষমতা সম্পন্ন একটি কার্গো বোটে নারায়নগঞ্জে লবণ মিলে সরবরাহ দিতে গেলে সেখানে মিল মালিকরা মণপ্রতি ২৫০/৩০০ টাকায় নেন। অথচ এর আগে যার দাম ছিল ৬/৭‘শ টাকা। এতে লবন ব্যবসায়ি শাহাজাহানের অন্তত: ৫/৬ লক্ষ টাকা লোকসান হয়েছে বলে জানা গেছে। একই ভাবে ফয়জানি পাড়ার লবণ ব্যবসায়ি ফরিদ‘র ১২০০ মণ ধারণক্ষমতা সম্পন্ন একটি বোট কয়েকদিন আগে চট্টগ্রামে লবণ নিয়ে গেলে শুক্রবার মণপ্রতি মাত্র ২৫০ টাকায় মিলমালিকদের সরবরাহ দিতে হয় বলে জানা গেছে। উভয় বোটের ব্যবসায়িরা ফিরে এসে লবনের দাম পড়ে যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করলে মাঠেও এর মারাত্মক প্রভাব পড়ে। মাঠে লবণের দাম ১৫০ টাকা হলেও চাষিরা পাবে ১১০ টাকা বা ১২০ টাকা। কোন কোন মাঠে ব্যবসায়িরা পরিবহন,শ্রমিক,কয়্যাল সহ ৩০/৪০ টাকা কমিশন (দালালি) বাবদ কর্তন করে থাকে। ঘন কুয়াশায় লবণ উঠতে বিলম্ব হওয়ায় সরবরাহে ভাটা ছিল। যে কারণে চাহিদা থাকলেও লবণ উৎপাদন ব্যহত হয়। মাত্র ক‘দিন ধরে অধিকাংশ মাঠে প্রচুর লবন ওঠা শুরু হতেই হঠাৎ এই আচমকা দর পতন। এতে লবণ ব্যবসায়িদের সাময়িক লোকসান হলেও চাষিরা পড়বে আরো বিপাকে। এমন আশংকা বিশিষ্ট লবণ চাষিদের। সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি মহেশখালীর লবণচাষীরা ঃ মহেশখালী থেকে আমাদের স্টাফ রিপোর্টার জয়নাল আবেদীন জানিয়েছেন, দেশের অন্যতম লবণ উৎপাদন এলাকা কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলা। খুচরা বাজারে লবণের ন্যায্য মূল্য থাকলেও লবণ চাষীরা একটি বিশেষ সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে। ঐ সিন্ডিকেটের অপতৎপরতার কারণে এলাকার হাজার হাজার লবণ চাষীরা ন্যায্য মূল্য পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ঐ চক্রের কারণে গত এক সপ্তাহে প্রতিমণ লবণের দাম কমেছে ২০০-২৫০ টাকা পর্যন্ত। এতে করে প্রান্তিক চাষীরা দারুণ ক্ষতির মূখে পড়বে বলে আশংকা করা হচ্ছে। বড় মহেশখালী এলাকার লবণ চাষী ও ব্যবসায়ী আলহাজ্ব নুরুল আলম জানান, গত সপ্তাহে মন প্রতি লবণ বিক্রি হয়েছে ৪০০-৪৫০ টাকা বর্তমানে তা বিক্রি হচ্ছে ২০০ টাকা। বড় মহেশখালীর লবণ চাষী ও ব্যবসায়ী নুরুল আমিন ও মৌলভী
আতাউর রহমান জানান, বর্তমানে খুচরা বাজারে প্রতিমন লবণ বিক্রি হচ্ছে ১২শ টাকা, অথচ মিল মালিকরা সিন্ডিকেট করে চাষীদের দাম দিচ্ছে মাত্র ২০০ টাকা। হোয়ানকের ভাঙ্গারখালের লবন চাষী ও ব্যবসায়ী আনচারুল করিম, শাহাদত, ফজল করিম ও দিদারুল আলম জানান, বর্গা চাষীদের পলিথিন, সেচ, সরঞ্চাম সহ মজুরি মিলিয়ে প্রতি কানিতে খরচ পড়ে প্রায় ৮০ হাজার টাকা। আর এ পরিমান জমি থেকে সর্বোচ্চ লবন উৎপাদন হয় ২৫০-৩০০ মন। নোয়াঘোনার লবণচাষী সুমন ও দেলোয়ার হোসেন জানান, বিদেশ থেকে লবন আমদানী বন্ধ ও উৎপাদনের শুরু থেকে গত সপ্তাহ পর্যন্ত লবণের বাজার স্থিতিশীল থাকায় প্রান্তিক চাষীরা লাভের মুখ দেখছিল। লবন মিল মালিকদের সিন্ডিকেটের কারণে বর্তমানে লবনের দাম পড়ে যাওয়ায় চাষীরা আবারো হতাশায় ভূগছেন। চট্টগ্রাম, ইসলামপুর সহ দেশের অন্যান্য এলাকার মিল মালিকরা সিন্ডিকেট করে চাষীদের ঠকানোর জন্য লবনের দাম কমিয়েছে। এই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে দাবী জানিয়েছে এ এলাকার হাজার হাজার লবণ চাষী। লবণের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত না হলে চাষীদের নিয়ে বৃহত্তর আন্দোলনের হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করেছেন মহেশখালী লবণ উৎপাদন ও ব্যবসায়ী সমিতি। এ ব্যাপারে মহেশখালী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আলহাজ্ব আনোয়ার পাশা চৌং জানান, লবণ উৎপাদন শুরুতে লবনের ন্যায্য মূল্য পেয়ে চাষীরা খুশি এবং এ অঞ্চলের উৎপাদিত লবণ দিয়ে দেশের চাহিদা মিটিয়েও উদ্বৃত্ত থাকে। তাই এ শিল্পকে বাচিয়ে রাখার জন্য বর্তমান সরকার কাজ করে যাচ্ছে এবং একটি মহল সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষণœœ করার জন্য অপচেষ্টা চালাচ্ছে। এ ব্যাপারে মহেশখালী-কুতুবদিয়ার সংসদ সদস্য আশেক উল্লাহ রফিক বলেন, জননেত্রী শেখ হাসিনা সরকার উন্নয়নের সরকার। এ সরকার প্রান্তিক চাষীদের পাশেই রয়েছে ও লবণের ন্যায্য মুল্য নিশ্চিতের জন্য সরকার নির্দেশনাও দিয়েছে এবং বিদেশ থেকে লবন আমদানী বন্ধ করেছে। যে সিন্ডিকেট চাষীদের ঠকানোর চেষ্টা করছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হবে এবং তাদের দাবী আদায়ের জন্য চাষীদের সোচ্ছার হতে হবে। লবণের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করে প্রান্তিক লবণ চাষীদের মুখে হাসি ফুটাবে বর্তমান সরকার, এমনটাই আশা করছে এ এলাকার হাজার হাজার লবণ চাষী। পেকুয়ায় লবনের দরপতনে অর্থনীতিতে স্থবিরতা ঃ আমাদের পেকুয়া প্রতিনিধি নাজিম উদ্দিন জানিয়েছেন, পেকুয়ায় লবনের মূল্যের হঠাৎ পতন হয়েছে। পরিশোধন লবণের দাম সারা দেশে অপরিবর্তিত থাকলেও হঠাৎ মাঠে উৎপাদিত কাঁচা লবণের দরের পতন হয়েছে। এতে করে স্থানীয় অর্থনীতিতে ফের স্থবিরতা বিরাজ করছে। গত ১৫দিন ধরে দরপতনের আধিক্য পরিলক্ষিত হচ্ছে। চলতি উৎপাদন মৌসুমের শুরুতে কাঁচা লবণের আকাশছোঁয়া দাম হয়। প্রতিমণ লবণ মাঠে বিক্রি হয়েছে প্রায় ৪শত টাকা। সে হিসেবে প্রতিকেজি লবণ ১০ টাকা মূল্যে বিক্রি হয়েছে। আগের ওই মূল্য হঠাৎ হ্রাস পেয়েছে। ১৫ দিনের ব্যবধানে পেকুয়ায় লবণের মূল্যের ব্যাপক ধ্বস নেমেছে। ৪শত টাকার লবণ এখন বিক্রি হচ্ছে মাত্র ১শত ৫০টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১শত ৭০টাকায়। হঠাৎ মূল্য পতন হওয়ায় পেকুয়াসহ উপকুলের স্থানীয় অর্থনীতিতে এর নীতিবাচক প্রভাব পড়ছে। বিশেষ করে হঠাৎ লবনের দাম নি¤েœর দিকে ধাবিত হওয়ায় উপকুলের অর্থনীতির বিশাল অংশ ঝিমিয়ে পড়তে শুরু করেছে। লবণ পেকুয়াসহ উপকুলের সাদা স্বর্ণ। এখানকার অর্থনীতি লবণ শিল্পের উপর নির্ভরশীল। হাজার হাজার মানুষ লবণ উৎপাদন করে জীবিকা অন্বেষণে ব্যস্ত। লবণ উপকুলের অর্থনীতির অন্যতম প্রাণ ভোমরা। বিশাল অঞ্চলে দারিদ্র-বিমোচন ও অর্থনীতির সূচক প্রসারের জন্য লবণ উপকুলের অন্যতম অর্থকরী সম্পদ। লবণের হঠাৎ দুরাবস্থা সৃষ্টি হওয়ায় উপকূলের মানুষের জীবিকা ও দৈনন্দিন আয়ে ব্যাপকভাবে ভাটা পড়েছে। জানাগেছে, দেশে এখনো বিদেশ থেকে লবণ আমদানি স্থগিত রয়েছে। এরপরেও হঠাৎ দাম পড়ে যাওয়ায় কারন না জেনে হতাশ হয়েছেন উৎপাদনকারী লবণ চাষীরা। গতকাল রবিবার দুপুরে পেকুয়া উপজেলার উজানটিয়া ও মগনামা ইউনিয়নে পরিদর্শন করতে গিয়ে লবণ চাষীদের সাথে কথা হয়েছে। এসময় চাষীরা জানিয়েছেন বর্তমান কাঁচা লবনের দাম দেওয়া হচ্ছে ১শত ৫০টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১শত ৭০টাকা। এরমধ্যে সার্ভিস চার্জ বাবদ প্রতি মণে ২০ থেকে ২৫টাকা খরচ কর্তন হচ্ছে চাষীদের। চাষীরা জানিয়েছেন, লবণের দাম পড়ে যাওয়ায় তারা অনেকে লবণ বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছেন। এদিকে দেশে পরিশোধনযোগ্য লবণের দাম অপরিবর্তিত রয়েছে। বাজারে বিভিন্ন কোম্পানির মোড়কজাতকৃত লবণ প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ২৫ থেকে ৩৫টাকায়। বাজারজাতকৃত লবণের দাম অপরিবর্তিত। কিন্তু কাঁচা লবণ হঠাৎ দরপতনে নি¤েœর দিকে চলে যাওয়ায় বাজার স্থিতিশীলতায় ব্যাপক তারতম্য পরিলক্ষিত হয়েছে। জানাগেছে, বর্তমান সময়ে তিন মাস অতিবাহিত হয়েছে। তবে চাষীরা এখনো কাংখিত লবণ মাঠ থেকে উৎপাদন করতে সক্ষম হয়নি। এরমধ্যে উপকুলের অনেক জায়গায় এখনো চাষীরা মাঠে লবণ দেখেননি। বিপুল অংশে মাঠ প্রস্তুতি শেষ হয়েছে। ফাল্গুনের মাঝামাঝি সময় থেকে বৈশাখের মাঝামাঝি সময় হচ্ছে লবণ উৎপাদনের পিক মৌসুম। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন (বিসিক) সুত্রে জানা গেছে, এপর্যন্ত গড়ে ১শত মণ পলিথিনজাত কাঁচা লবণ প্রতিকানি জমিতে উৎপাদন হয়েছে। অর্থনীতির অন্যতম চালিকা শক্তি লবণে কক্সবাজার জেলা, চট্টগ্রাম জেলার আংশিকসহ বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ৭০হাজার একর জমিতে লবণ উৎপাদন হচ্ছে। এখাতে প্রায় লক্ষাধিক মানুষ জড়িত। লবণ দেশজ উৎপাদন ও জিডিপিতে অর্থনীতির উচ্চতর সুচক তৈরিতে কাজ করছে। সুত্র জানিয়েছে, বছরে দেশে প্রায় ১৮লাখ মেট্রিক টন লবণের চাহিদা রয়েছে। চাহিদা মেঠানোর জন্য দেশেই উৎপাদিত লবণই সক্ষম। এরমধ্যে বিদেশ থেকে লবণ আমদানি হলে নিশ্চিত মার খাবে দেশীয় উৎপাদন ব্যবস্থা। সেক্ষেত্রে প্রচুর দেশীয় মুদ্রা চলে যাবে বিদেশে। লবণ আমদানি স্থগিত থাকলে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হবে। এব্যাপারে বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, লবণ এখন সম্ভবনাময় একটি কৃষি খাত। যা অর্থনীতির নতুন ভাষায় লবণকে সাদা সোনা আখ্যায়িত করা হয়েছে।