কক্সবাজার ও বান্দরবার জেলার সাথে পাশ্ববর্তী দেশ মায়ানমারের প্রায় ২৭১ কিলোমিটার সীমান্ত পথ রয়েছে। কক্সবাজার জেলার সাথে মিয়ানমারের জল সীমান্ত রয়েছে ৫৪ কিলোমিটার। সীমান্ত পথ অতিক্রম করে মায়ানমার থেকে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর অনুপ্রবেশ ঘটছে। এই অবস্থায় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর অবৈধ অনুপ্রবেশ করার জন্য প্রায় ২৭১ কিলোমিটার স্থল সীমান্ত পথে কাঁটা তারের বেড়া নির্মাণ করা দরকার। এছাড়াও বিজিবিসহ আইন-শৃংখলা বাহিনীর নিয়মিত টহলের জন্য বেড়া সংলগ্ন রাস্তা নির্মাণ করা জরুরী। প্রয়োজন বিজিবি সদস্য এবং বিওপির সংখ্যা বৃদ্ধি করা। জলসীমান্ত পথে টহলের জন্য কোস্টগার্ডেরও সংখ্যা বাড়ানো দরকার। রাজধানীতে গতকাল মঙ্গলবার থেকে শুরু হওয়া জেলা প্রশাসক সম্মেলন উপলক্ষে ‘স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত’ এইসব সুপারিশ পাঠিয়েছেন কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মো: আলী হোসেন।
তার পাঠানো সুপারিশমালায় বলা হয়, নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে সহায়তার জন্য যেসকল দেশী-বিদেশী এনজিও এবং আন্তর্জাতিক সংগঠন কাজ করছে তাদের কর্মকান্ডের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য একটি দক্ষ ও সক্রিয় মনিটরিং কমিটি গঠন করা দরকার। শরনার্থী শিবিরগুলোতে অবস্থানরত নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত শরণার্থীদের অবাধে চলাচল নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় আনা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে শরণার্থীরা একটি মাত্র প্রবেশ ও বহির্গমন পথে স্থানীয় প্রশাসন আরআরআরসি এবং সংশ্লিষ্ট আইন-শৃংখলা বাহিনীর সংশ্লিষ্টতায় চেকপোষ্ট স্থাপনের মাধ্যমে শরণার্থীদের চলাচলের রেকর্ড নথিবদ্ধ করা এবং প্রহরার ব্যবস্থা গ্রহন করা যেতে পারে। শরণার্থীদের পাস/পরিচয়পত্র প্রবর্তন করা যেতে পারে। যার মাধ্যমে তাদের জন্য প্রবেশ ও বহির্গমন নিয়ন্ত্রিত হবে।
সম্মেলনের উদ্দেশ্যে কক্সবাজার ত্যাগ করার পূর্বে জেলা প্রশাসক মো: আলী হোসেন সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘সীমান্ত পথ অতিক্রম করে সুযোগ পেলেই রোহিঙ্গারা অনুপ্রবেশ করছে। এই অবৈধ অনুপ্রবেশ রোধ করার জন্য স্থল সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করা দরকার।’
প্রসঙ্গত, গত ১৩ মে রাত ২টায় টেকনাফ উপজেলার নয়াপাড়া শরনার্থী ক্যাম্পের অভ্যন্তরে অবস্থিত আনসার ব্যারাকে হামলা চালিয়ে সন্ত্রাসীরা ২টি এসএমজি, ৫টি চাইনিজ রাইফেল, ৪টি শর্টগান ও ৬৭০ রাউন্ড গুলি লুট করে নিয়ে যায়। এই ঘটনার সাথে রোহিঙ্গা জঙ্গি সংগঠন রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের (আরএসও) সম্পৃক্তার তথ্য-প্রমাণ পেয়েছে পুলিশ। ইতোমধ্যে গ্রেপ্তারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে উঠে এসেছে, আরএসও’র কয়েকজন সদস্য, নয়াপাড়া শরনার্থী শিবিরের নিবন্ধনকৃত কিছু রোহিঙ্গা নাগরিক ও স্থানীয় কিছু সন্ত্রাসী এই ঘটনা ঘটায়। আরএসও’র ৫ সদস্য কাঠের নৌকা যোগে মিয়ানমার থেকে নাফ নদী হয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী ও স্থানীয়দের সংগঠিত করে। পরে এই হামলা চালায়। ঘটনার পর লুট করা অস্ত্র নিয়ে যাওয়া হয় মিয়ানমারের একটি গোপন আস্তানায়।
হামলার ঘটনার পর পুলিশের একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছিল, রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও) মূলত অস্ত্র সংগ্রহের জন্য এই হামলার ঘটনা ঘটিয়েছে। লুন্ঠিত অস্ত্রগুলো যে বর্তমানে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নেইÑসে বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছে পুলিশ।
সূত্র জানিয়েছে, সীমান্তপথ ব্যবহার করে কক্সবাজার জেলায় এ পর্যন্ত অনুপ্রবেশ করা প্রায় ৩ লক্ষের মতো অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী অবৈধ মানবপাচার, ইয়াবার অনুপ্রবেশ এবং বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকান্ডের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত থেকে জেলার আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি ও সামাজিক স্থিতিশীলতার মারাত্মক অবনতি ঘটাচ্ছে। উখিয়া উপজেলার কুতুপালং ও টেকনাফের নয়াপাড়া শরণার্থী শিবিরে প্রায় ৩২ হাজার নিবন্ধিত শরণার্থী রয়েছে। নিবন্ধিত শরণার্থী শিবিরের পাশে ৫০ হাজার থেকে ৬০ হাজার শরণার্থী বসবাস করছে। এসব শরণার্থী শিবিরের চারপাশে নিরাপত্তা বেস্টনি না থাকায় শরণার্থীরা অবাধে চলাচলের সুযোগ পেয়ে থাকে। ফলে তারা অবৈধ মানবপাচার, মাদক পরিবহণ ও বেচাকেনা, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাইসহ ক্রমাগতভাবে নানা অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িয়ে যাচ্ছে। এসব শিবিরের শরণার্থীদের অবাধে চলাচল নিয়ন্ত্রণ ও অবৈধ অনুপ্রবেশ প্রতিরোধের লক্ষ্যে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহন করা আবশ্যক।
এদিকে সম্মেলনের বিষয়ে জানতে চাইলে কক্সবাজারের ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করা অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোহাম্মদ আনোয়ারুল নাসের বলেন, ‘সম্মেলনে জেলা প্রশাসক সীমান্তে কাঁটাতারে বেড়া নির্মাণ, রাস্তা নির্মাণ, বিজিবি ও কোস্টগার্ডের সংখ্যাবৃদ্ধিসহ নানা বিষয়ে আলোচনা ও সুপারিশ উপস্থাপন করবেন। তবে আলোচনার এক নম্বর এজেন্ডা হচ্ছে কক্সবাজার সদর ও টেকনাফ উপজেলায় সুপেয় পানির সংকট নিরসন। এছাড়াও মহেশখালীর বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্প এবং অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে স্থানীয় জনসাধারণকে কর্মসংস্থানের আওতায় আনা ও স্থানীয় শিক্ষিত তরুণ সমাজকে বিভিন্ন প্রকল্পে কর্মসংস্থান ও দক্ষ মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষে ওই এলাকায় একটি টেকনিক্যাল স্কুল/ইন্সটিটিউট স্থাপন করার সুপারিশও উপস্থাপন করা হবে।’