টেকনাফে গ্রীষ্মের শুষ্ক মৌসুমের তীব্র তাপদাহ খরা ও অনাবৃষ্টির ফলে তিনটি পাহাড়ি ইউনিয়ন সহ উপজেলাজুডে চলছে বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট।পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় নদী, খাল, বিল পুকুর আর জলাশয়গুলো শুকিয়ে গিয়ে ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে অনেকগুলো টিউবওয়েল। এসব এলাকার লোকজনকে পানির জন্য প্রতিদিনই ‘যুদ্ধে’ করতে হচ্ছে। বাধ্য হয়ে তারা প্যলাস্টিকের ড্রাম, জার কলসে নিয়ে পানি সংগ্রহে ছুটে বেড়াচ্ছে গ্রাম থেকে গ্রামে ।
অন্যদিকে,বিশুদ্ধ পানির অভাবে এসব এলাকায় পানিবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়ে গিয়ে ডায়রিয়া সহ পেটের নানা পীড়ায় ভুগছে। ডায়রিয়া, জন্ডিসসহ পানিবাহিত নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে তারা হাসপাতালে ভর্তি করা হচ্ছে।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ আতাউর রহমান বলেন, প্রচণ্ড গরম পড়ায় উপজেলার কয়েকটি এলাকায় পানিবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়ে গেছে। আক্রান্তদের মধ্যে শিশুর সংখ্যাই বেশি।
বিশেষজ্ঞদের অভিমত , জলবায়ু পরিবর্তন, অব্যাহত বৃক্ষ নিধন ও পানির স্তর নিচে নামার কারণে বৃষ্টির পরিমাণ কমে গেছে। ফলে পানির উৎস শুকিয়ে যাওয়ায় নদী এবং খালগুলোর শুকিয়ে গেছে তাই খুব দ্রুত খালগুলো খননের উদ্যোগ নেয়া হলে শুকনো মৌসুমে পানির প্রবাহ বাড়বে। আবার এসব এলাকার মাটির নিচে পাথর ও বঙ্গোপসাগর সংলগ্ন হওয়ায় মিষ্টি পানির স্তর নিম্নমুখী। যার কারণে গ্রীষ্মের শুরু থেকেই পানির স্তর ক্রমেই নিচের দিকে ধাপিত হতে থাকে। সরকারী ভাবে পানির সংকট মেঠাতে দীর্ঘ মেয়াদী ওয়াটার প্লান্ট না নেওয়া পর্যন্ত এর সমাধান সম্ভব নয়।
অন্যদিকে, টেকনাফ পৌরএলাকার প্রতিদিন রেষ্টুরেন্ট, বেকারী, আবাসিক হোটেল ও বাসাবাড়িতে খাবার পানি সরবরাহ দিতে ২০/৩০ টি ভ্যানগাড়ী ব্যস্ত রয়েছে। এতে অর্ধলাখ মানুষের দূর্ভোগের পাশাপাশি অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় হচ্ছে ।
এমনও দেখা গেছে যে, পৌর এলাকার হত দরিদ্র নিম্ন আয়ের মানুষ অর্থের অভাবে বিশুদ্ধ পানি না পেয়ে বাধ্য হয়ে দূষিত পানি সংগ্রহ করে খাবার পানির অভাব পুরণ করেছে। পৌরকর্তৃপক্ষ কোটি কোটি টাকা বিভিন্ন প্রকল্পে খরচ করলেও পৌরএলাকার প্রধান সমস্যা খাবার পানির দূর্ভোগ থেকে পরিত্রান পেতে কোন পদক্ষেপ চোখে পড়ছে নাই।
সরেজমিনে ঘুরে এলাকাবাসীরা জানায়, দেখা গেছে, টেকনাফ উপজেলার পৌর এলাকার সাইড পাড়া, চৌধুরী পাড়া, উত্তর জালিয়া পাড়া, মধ্যম জালিয়া পাড়া, দক্ষিণ জালিয়া পাড়া, কুলাল পাড়া, কলেজ পাড়া, নাইট্যংপাড়া, কায়ুকখালীয়া,সদর ইউনিয়নের খানকার পাড়া, শিলবুনিয়া পাড়ায় বর্ষাও শীত মৌসুম শেষে গ্রীষ্মের শুরু থেকে পানির সংকট সৃষ্টি হয়। এতে শুষ্ক মৌসুমের ওই সব গ্রামে পানির সংকট দেখা দিয়েছে।দুই থেকে তিন কিলোমিটার দূরে গিয়েও খাবার পানি মিলছে না।
পানির অভাবে সেচ সংকটে ফেটে চৌচির হয়ে গেছে উপজেলার বেশ কয়েকটি ইউনিয়নের আবাদি জমি। বিপুল পরিমাণ জমির বোরো ধান একদিকে খরায় অন্যদিকে রোদের তাপে জ্বলে গেছে। আশপাশের খালগুলো শুকিয়ে পানির উৎস বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এখানকার ধানিজমিতে পানি সরবরাহ করা যাচ্ছে না। ফলে বিপুল পরিমাণে লোকসান গুনতে হবে এসব এলাকার কৃষকদের।কোনো কোনো এলাকায় বোরো ধান কাটা শুরু হলেও এবার ফলন তেমন ভাল হয়নি।
উপজেলার ইউনিয়নের হ্নীলা কৃষক মো. জাহাঙ্গীর আলম জানান, দুই কানি জমিতে বোরো ধান চাষ করেছেন তিনি। পানির অভাবে এখন তার স¤পূর্ণ ধান খরায় পুড়ে গেছে। এতে করে তার প্রায় লক্ষাধিক টাকার লোকসান হয়েছে।হোয়াইক্যং ইউনিয়নের সীমানাপাড়া গ্রামের খমিতা ত্রিপুরা (৫৫) জানায়, উপজেলার দুর্গম এলাকার অর্ধশতাধিক গ্রামে অর্ধলক্ষাধিক লোকের বসবাস।দীর্ঘ কয়েক যুগ ধরে তারা বসবাস করছেন পাহাড়ে, পাহাড়ি ঝরনা, ছড়া ও ঝিরি থেকে সংগৃহীত পানির ওপর নির্ভরশীল তারা । শুষ্ক মৌসুমে পাহাড়ের সব ঝরনা, ছড়া ও ঝিরি শুকিয়ে যায়। দীর্ঘদিন অনাবৃষ্টি ও পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় গ্রামে পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। পানির অভাবে এখন বেশ কয়েকটি গ্রামের বাসিন্দারা ভিটেবাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে।দাতা সংস্থা ও স্থানীয় উন্নয়ন সংস্থার প্রতিনিধিদল একাধিকবার এলাকা পরিদর্শন করে এবং পাহাড়ি এলাকায় পানি সরবরাহের আশ্বাস দেয়। কিন্তু এখনো তার বাস্তবায়ন হয়নি।
টেকনাফ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জাফর আহমদ ,পাহাড়ি দুর্গম এলাকায় পানীয়জলের সংকট বিষয়ে বলেন, সরকারি বরাদ্দ অপ্রতুল হওয়ায় সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলোতে পানি সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না।এলাকায় পানির বিষয়ে আমি ঊর্ধ্বতন প্রশাসনকে অবহিত করে করণীয় নির্ধারণ করবো। আর যেসব এলাকায় নলকূপ স্থাপন করা সম্ভব হচ্ছে না, সেখানে আইডিপি ও জিওবি প্রকল্পের আওতায় কিছু অগভীর নলকূপ বসানোর কাজ চলছে।