প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ সৃষ্টি বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণের ছোট্ট শহর টেকনাফ। ছয়টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা নিয়ে গঠিত। নাফ নদীর অপূর্ব দৃশ্যের রূপ প্রকৃতির লীলাভূমি টেকনাফ। পাখির কলকাকলিতে নাফ নদী দিয়ে সকালবেলার সূর্যোদয় আর বিশাল বিস্তৃত সমুদ্রের ঢেউয়ের সুরেলা গর্জনে সন্ধ্যাবেলার সূর্যাস্তের অপূর্ব দৃশ্য যে কাউকে মুগ্ধ করে।
নদী ও সমুদ্রের সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্তের এমন নয়নাভিরাম মনোরম দৃশ্য বিশ্বের অন্য কোথাও আর দেখা যায় না তেমনভাবে। চারদিকে সবুজের মেলা আর মেলা। যেদিকে চোখ যায় সেদিকে দেখা যায় দিগন্তব্যাপী সবুজের নয়ন ভোলানো সমারোহ। দিগন্ত প্রসারিত মাঠের মাঝে মাঝে ছোট ছোট গ্রাম ও বাড়িগুলো পটে আঁকা ছবির মতোই সুন্দর। প্রকৃতির যেন এক রঙ্গশালা।
টেকনাফে রয়েছে অমর প্রেমের চিরসাক্ষী ঐতিহাসিক মাথিনের কূপ। পাষাণ ধীরাজের জন্য চৌদ্দ বছর বয়সী মাথিনের আত্মত্যাগের করুণ ইতিহাস। যে মাথিন অসম প্রেমকে অমর করতে নিজের জীবন বিসর্জন দিয়ে রচনা করে গেছেন অমর প্রেমকাব্য। পর্যটন মৌসুমে প্রেয়সী মানুষের পদভারে মুখরিত হয় এই ঐতিহাসিক মাথিনের কূপ। টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়নের অদূরে দেখা মিলবে ‘কুদুমগুহা’।
এই অজানা গুহার সৃষ্টি সম্পর্কে মানুষের এখনো নেই কোনো ধারণা। কুদুমগুহায় রয়েছে বিলুপ্ত প্রজাতির বানর। টেকনাফে রয়েছে বিশাল বিস্তৃত পাহাড় বেষ্টিত বন্যপ্রাণির অভয়ারণ্য। রয়েছে পর্যটনের অন্যতম দর্শনীয় স্থান টেকনাফ ন্যাচার পার্ক। যেখানে রয়েছে মায়া হরিণ, অজগর, চিতা, বাঘ, হাতি, হনুমান ও হরেক রকম বানরসহ বিভিন্ন প্রজাতির পশু-পাখি।
পর্যটন মৌসুমে এ স্পটটি পর্যটকদের পদভারে মুখরিত হয়। তাছাড়া রয়েছে দেশের সর্ববৃহৎ গর্জন গাছের (মাদার ট্রি নামেও পরিচিত) সারি সারি বাগান ও পাহাড়ি প্রবহমান ঝরনা। এমন নয়নাভিরাম দৃশ্য পর্যটকদের প্রতিনিয়ত আকৃষ্ট করে চলছে। রয়েছে নেটং পাহাড় যেটি আবার দেবতার পাহাড় নামেও পরিচিত। নেটং পাহাড়ে রয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ব্রিটিশ সৈন্যদের তৈরি করা বাঙ্কার ও বিভিন্ন পুরাকৃীর্তি নিদর্শন। যার চূড়ায় উঠলে দেখা মিলবে নাফ নদীর সৌন্দর্যের অপরূপ দর্শন। দেখা মিলবে বাংলাদেশের অন্যতম বাণিজ্যিক বন্দর টেকনাফ সহল বন্দরের পাশে ঘেঁষা নয়ন ভোলানো পর্যটন স্পট জইল্যার দ্বীপ।
পূর্ব দিকে একটু তাকালে দেখা যাবে আরাকান পাহাড়ের সঙ্গে মেঘের মিলনের দৃশ্য। একটু উঁকি দিলে দেখা যাবে সীমানা বেষ্টিত আরাকান নগরীর পদধ্বনি। আরও দেখা মিলবে নদী নাফের বুক দিয়ে প্রবালদ্বীপ সেন্ট মার্টিনগামী পর্যটকবাহী জাহাজ ও মিয়ানমার থেকে টেকনাফ সহল বন্দরে আসা পণ্যবাহী জাহাজের প্রতিনিয়ত আনাগোনা।
টেকনাফ শহর থেকে ২-৩ কিলোমিটার পশ্চিমে রয়েছে বিশাল সমুদ্র সৈকত। সৌন্দর্যের দিক দিয়ে ইনানী, হিমছড়ি ও কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত থেকে কোনো অংশে কম নয় এই দুই সৈকত। বিশেষ দিনে এই সৈকতে স্থানীয় ও দেশি-বিদেশি পর্যটকদের ঢল নামে। অন্যদিকে টেকনাফ থেকে প্রায় আট মাইল দক্ষিণে রয়েছে বিশ্বের মানচিত্রে স্থান করে নেওয়া সাগরঘেরা পর্যটন দ্বীপ সেন্ট মার্টিন।
যেটিকে আবার স্থানীয় ভাষায় জিঞ্জিরা বা নারিকেলের দ্বীপও বলা হয়। আর সেন্ট মার্টিন মূলত জিঞ্জিরা, দক্ষিণপাড়া, গলাছিরা ও চেরাদিয়া নিয়ে গঠিত। বিশেষ করে পর্যটন মৌসুম ও বিশেষ দিবসে এই দ্বীপে দেশি-বিদেশি ভ্রমণপিপাসুদের আনাগোনা চোখে পড়ার মতো।
বিভিন্ন ভূ-তাত্ত্বিকদের মতে দ্বীপটির বয়স প্রায় বিশ লাখ বছর। দ্বীপে রয়েছে প্রবাল, মুক্তা, সামুদ্রিক কাছিম, সামুদ্রিক কাঁকড়া ও বিচিত্র রকমের মাছ। দ্বীপে পাওয়া গেছে জীবন্ত পাথরের সন্ধান। যখন টেকনাফ দিয়ে পর্যটকবাহী জাহাজ সেন্ট মার্টিনের উদ্দেশে পাড়ি জমায় তখন জাহাজের পেছনে পেছনে ঢেউয়ের তালে তালে ঝাঁকবাঁধা সবুজ গাঙচিলের মাছ শিকারের দৃশ্য পর্যটকদের মনকে করে তোলে উতলা।
টেকনাফে রয়েছে শাহপরীর দ্বীপ। যেটি আজ সাগরের ঢেউয়ের থাবায় ক্ষত-বিক্ষত হয়ে বাংলাদেশের মানচিত্র থেকে মুছে যাওয়ার পথে। তবে এক সময় এই পরীরদ্বীপের সৌন্দর্য মানুষকে হাতছানি দিয়ে ডাকত। নদী-সাগর বিধৌত প্রাকৃতিক রূপ-বৈচিত্র্যে শোভিত এমন স্থান বাংলাদেশের আর কোথাও নেই। যদি টেকনাফের দর্শনীয় স্থানগুলোকে আধুনিকায়নের ছোঁয়ায় আনা যায় তবে টেকনাফ হতে পারে বাংলাদেশের তথা বিশ্বের পর্যটন শিল্পের আকর্ষণীয় স্বর্গ।