অবহেলায় প্রসূতি মৃত্যুর ঘটনায় দুই চিকিৎসকের বিরুদ্ধে মামলার প্রতিবাদে হঠাৎ করেই কর্মসূচিতে নেমেছেন চিকিৎসকরা। বন্ধ করে দিয়েছেন প্রাইভেট ক্লিনিক–ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সেবা। একই সাথে বন্ধ প্রাইভেট চেম্বারে রোগী দেখাও। গতকাল বুধবার বিকেলে ঘোষণা দিয়ে হুট করেই এ কর্মসূচি পালন শুরু করে চিকিৎসকদের সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন (বিএমএ)। অবশ্য, সরকারি হাসপাতাল কর্মসূচির বাইরে রাখা হয়েছে। তাছাড়া কেবল শহরেই এ কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে বিএমএ’র পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। তবে হঠাৎ এ কর্মসূচির কারণে গতকাল বিকেল থেকে অসংখ্য রোগী ও স্বজনদের দুর্ভোগে পড়তে হয়েছে। অনেকে একদিন আগেই সিরিয়াল নিয়ে রেখেছিলেন সন্ধ্যায় ডাক্তার দেখাবেন বলে। কেউবা সিরিয়াল নিয়েছেন সকালে। কিন্তু সন্ধ্যায় ডাক্তার দেখাতে এসেই জানতে পারলেন আজ সব চেম্বার বন্ধ। অগত্যা ফিরে যেতে হয়েছে দূর–দূরান্ত থেকে আসা স্বাস্থ্য সেবা প্রত্যাশী এসব মানুষকে। একইভাবে প্রাইভেট ক্লিনিকে ভর্তি করাতে গিয়ে স্বজনরা জানতে পারলেন এখানে নতুন করে রোগী ভর্তি বন্ধ। আর ক্লিনিকগুলোতে হচ্ছে না কোন অস্ত্রোপচার (অপারেশন)। অবশ্য জরুরি বিভাগ, জরুরি সেবা এবং ভর্তি থাকা রোগীদের চিকিৎসা সেবা চালু রাখার কথা জানিয়েছেন একাধিক প্রাইভেট ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ। এদিকে বিভিন্ন টেস্ট করাতে গিয়ে রোগী ও তাদের স্বজনরা দেখতে পান রোগ নির্ণয়ের (পরীক্ষা–নিরীক্ষার) ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো ফাঁকা। সেবা কার্যক্রম বন্ধ এখানেও। অথচ, অন্য সময়ে রাত–দিন এসব ক্লিনিক–ডায়াগনস্টিক সেন্টারে জন–মানুষের ভিড় লেগেই থাকে। হঠাৎ করে এমন ভোগান্তিতে পড়ে যারপরনাই ক্ষুব্ধ চিকিৎসা সেবা প্রত্যাশী সাধারণ মানুষ।
এর আগে অপারেশনের পর এক যুবকের শরীরে নিডল রেখে দেওয়ার ঘটনায় ডা. সুরমান আলীর বিরুদ্ধে মামলা হলে তখনই ধর্মঘট ডেকে বসেন চিকিৎসকরা। বন্ধ রাখেন সব ধরনের চিকিৎসা সেবা। আগাম কোন ঘোষণা না দিয়ে হঠাৎ এ ধরনের ধর্মঘট কর্মসূচির মাধ্যমে রোগী সাধারণকে জিম্মি করাকে অন্যায় ও অমানবিক বলছেন সাধারণ ও সচেতন মানুষ। তাঁরা বলছেন– এখানে সরকার তো কোন পক্ষ নয়। ভুক্তভোগী রোগীর স্বজনই মামলার বাদী। আর তো কোন পক্ষ নেই। তাহলে এ ধর্মঘট কার বিরুদ্ধে। নিশ্চয়ই সাধারণ রোগীদের বিরুদ্ধেই এ ধর্মঘট! তাছাড়া, যে কোন কারণে ডাক্তারের বিরুদ্ধে মামলা হলেই হুট করে চিকিৎসা সেবা বন্ধ রাখা কোন ভাবেই মানা যায় না।
মাকে নিয়ে সুদূর রাঙ্গুনিয়া থেকে এসেছেন মো. আনোয়ার। সিএসসিআর–এ ডাক্তার দেখাবেন বলে। গতকাল সন্ধ্যায় প্রাইভেট ক্লিনিকটির সামনেই কথা হয় মরিয়ম নগর এলাকার এই যুবকের সাথে। আনোয়ার জানালেন– মাকে ডাক্তার দেখাতে সকালেই ফোন করে সিরিয়াল নিয়ে রেখেছিলেন। সন্ধ্যা সাতটার পর চেম্বারে ডাক্তার দেখানোর কথা। কিন্তু এখানে এসে জানতে পারলেন আজ ডাক্তার বসবেন না। সব চেম্বার বন্ধ। এতদূর থেকে এসে ডাক্তার না দেখিয়ে ফিরে যেতে হচ্ছে বলে চরম ক্ষুব্ধ সিএনজি চালক আনোয়ার। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন– সিএনজি অটোরিক্সা চালাই। একবেলা সিএনজি চালানো বন্ধ রেখে মাকে ডাক্তারের কাছে এনেছি। কিন্তু এখন ফিরে যেতে হচ্ছে। আবার আসতে হবে। সেদিনও সিএনজি চালানো বন্ধ রাখতে হবে। ডাক্তাররা তাদের কর্মসূচির কথা আগে–ভাগে জানালে একবেলা সিএনজি চালানো বন্ধ রাখতে হতো না বলেও ক্ষোভ প্রকাশ করেন আনোয়ার।
রোগী সাধারণের দুর্ভোগের কথা স্বীকার করে বেসরকারি প্রাইভেট হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার সিএসসিআর’র চিফ অপারেটিং অফিসার ডা. সালাউদ্দিন বলেন, কর্মসূচির সিদ্ধান্তটি আমরা সন্ধ্যার আগ মুহূর্তে জানতে পেরেছি। দুপুরে জানলেও যে কোনভাবে রোগীদের বিষয়টি অবহিত করতে পারতাম। এখন অনেকেই এসে ফিরে যাচ্ছেন। কিন্তু আমাদের করার কিছু নেই।
সন্ধ্যায় সেভরন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে গিয়ে দেখা যায়, ডাক্তারের চেম্বারের সামনের চেয়ারগুলো খাঁ–খাঁ করছে। জন–মানুষ নেই। যারাই আসছেন নিরাপত্তা রক্ষীদের কথা শুনে আবার ফিরে যাচ্ছেন। বুঝতে পারছেন কিছু একটা হয়েছে। কিন্তু ধর্মঘটের নামে সাধারণ রোগীদের জিম্মি করা কেন, এ প্রশ্ন সেবা নিতে আসা অসংখ্য সাধারণ মানুষের। একাধিক ডাক্তারও এ ধরণের ধর্মঘট কর্মসূচিকে অনৈতিক বলছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সুপরিচিত এক চিকিৎসক বলেন, ‘এটি সম্পূর্ণ অমানবিক। কর্মসূচি পালনের আগে অন্তত একটি প্রেস কনফারেন্স করে দাবি পূরণে আল্টিমেটাম দেওয়া উচিত ছিল। হুট করে এভাবে সব কিছু বন্ধ রাখা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।’ বিদেশে কোথাও এমন ধর্মঘটের নজির নেই বলেও মন্তব্য করেন এই চিকিৎসক।
আর জন স্বাস্থ্য–দুর্ভোগের দিকটি বিবেচনায় নিয়ে কর্মসূচির বিষয়ে আগে ঘোষণা দেওয়া উচিত ছিল বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্য অধিকার রক্ষা কমিটির আহবায়ক ডা. মাহফুজুর রহমান। অন্যদিকে, এই ধর্মঘটকে সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে, সাধারণ রোগীদের বিরুদ্ধে ধর্মঘট বলে মনে করেন ইস্ট–ডেল্টা ইউনিভার্সিটির উপাচার্য প্রফেসর মু. সিকান্দার খান। তিনি বলেন, হুট করে চিকিৎসকরা এ ধরণের কর্মসূচি দিতে পারেন না। এই কর্মকাণ্ড সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে। এটি তাঁরা করতে পারেন না। আর তাঁরা যে এটি করতে পারেন না, তা তাদেরকে বুঝিয়ে দেওয়ার দায় সরকারের। প্রয়োজনে জোর করে হলেও চিকিৎসা সেবা কার্যক্রম চালু রাখতে সরকারকেই পদক্ষেপ নিতে হবে। চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে মামলা হলেই তারা ধর্মঘট ডেকে বসবেন। তাঁদের কর্মকাণ্ড দেখে মনে হয় তাঁরা নিজেদের সাধারণ সমাজের ঊর্ধ্বে বা আইনের ঊর্ধ্বে বলে মনে করেন। তাঁরা কি আইনের ঊর্ধ্বে? সাধারণ মানুষ আইনি প্রক্রিয়ায় বিচার চাইতে পারবে না? তাহলে সাধারণ মানুষ কোথায় যাবে, কোথায় প্রতিকার চাইবে। এ প্রশ্নও করেন এই শিক্ষাবিদ।
তবে সহকর্মী চিকিৎসকদের দাবির প্রেক্ষিতে জরুরি ভাবে কর্মসূচির সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে বলে দাবি করেছেন বিএমএ চট্টগ্রামের সভাপতি ডা. মুজিবুল হক খান। তিনি বলেন, ‘সাধারণ মানুষের দুর্ভোগের বিষয়টি আমরা বুঝতে পারছি। কিন্তু সেবা দিতে গিয়ে যদি আমরা আক্রান্ত হই। মিথ্যে অভিযোগে হুট করে মামলা এবং এর প্রেক্ষিতে গ্রেফতার করা হয়, তবে চিকিৎসকরা তো বসে থাকতে পারেন না। যেখানে জীবনের নিরাপত্তা নেই সেখানে একজন চিকিৎসক সেবা কি করে দিবেন আর চেম্বারও কিভাবে করবেন।’ বাধ্য হয়েই চিকিৎসকরা এমন কর্মসূচিতে নেমেছে বলে দাবি এ চিকিৎসক নেতার। এর সাথে যোগ করে সংগঠনের (বিএমএ) সাধারণ সম্পাদক ডা. মো. শরীফ বলেন, ‘আমরা সেবা দিতে গিয়ে আক্রান্ত হচ্ছি। চেম্বার ভাঙচুর করা হচ্ছে। ক্লিনিক ভাঙচুর করা হচ্ছে। চিকিৎসকের গায়ে হাত তোলা হচ্ছে।’ দুনিয়ার কোথাও একজন চিকিৎসকের গায়ে হাত তোলার নজির নেই দাবি করে ডা. মো. শরীফ বলেন– বাধ্য হয়েই চিকিৎসকরা সেবা বন্ধ রাখছেন। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মামলা প্রত্যাহার না হলে পরবর্তীতে আরো কঠোর কর্মসূচি ঘোষণার কথাও জানান এই চিকিৎসক নেতারা। তাঁরা জানান, বৃহস্পতিবার (আজ) বেলা এগারটায় সংগঠনের বৈঠকে পরবর্তী কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। এরপর কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।
অন্যদিকে, একটি সিস্টেমের অভাবের কারণেই এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে বলে দাবি করেছেন ডা. মাহফুজুর রহমান। এই প্রবীণ চিকিৎসকের মতে– এ ধরনের ঘটনা মোকাবেলায় বিএমডিসির তত্ত্বাবধানে একটি কমিটি গঠন করা যেতো। যেখানে চিকিৎসক–আইনজীবী ছাড়াও প্রশাসনের কর্মকর্তারাও থাকবেন। কোন চিকিৎসকের বিরুদ্ধে চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগ আসলে কমিটি প্রথমে তা তদন্ত করে রিপোর্ট দিবে। এর ভিত্তিতেই মামলা বা পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করা সম্ভব হতো। তাহলে কিন্তু এখনকার মতো হুট–হাট করে একজন ডাক্তারের বিরুদ্ধে মামলা হতো না। কিন্তু ওই ধরনের সিস্টেম তো আমাদের দেশে নেই। তাই বারবার এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে। কোন সিস্টেম না হলে ভবিষ্যতেও এ ধরনের পরিস্থিতিতে পড়তে হবে বলে মন্তব্য করেন ডা. মাহফুজুর রহমান।
উল্লেখ্য, গত ১০ জানুয়ারি বেসরকারি হাসপাতাল ‘সার্জিস্কোপে’ প্রসব পরবর্তী মারা যান মেহেরুন্নেসা রীমা (২৫) নামের এক গৃহবধূ। রীমা প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী নূরুল ইসলাম বিএসসি’র ছোট ভাইয়ের মেয়ে। চিকিৎসকের অবহেলায় রীমার মৃত্যু হয়েছে দাবি করে ওইদিন রাতে সার্জিস্কোপ হাসপাতাল ভাঙচুর করে নিহতের স্বজনেরা। এ ঘটনায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গাইনি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক শামীমা সিদ্দিকী রোজি ও তাঁর স্বামী মাহবুবুল আলমের বিরুদ্ধে গত মঙ্গলবার চট্টগ্রাম মহানগর হাকিম আদালতে মামলা করেন রীমার বাবা খায়রুল বাশার।
এ মামলাকে ‘হয়রানিমূলক’ মন্তব্য করে ‘মামলার প্রতিবাদে গতকাল বিকেল থেকে হঠাৎ করে সব বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে অপারেশনসহ সব ধরনের চিকিৎসা সেবা বন্ধ রাখেন চিকিৎসকরা। পাশাপাশি ব্যক্তিগত চেম্বারেও রোগী দেখা বন্ধ করে দিয়েছেন তারা। এতে হাজার–হাজার চিকিৎসা সেবা প্রত্যাশী রোগী–সাধারণকে দুর্ভোগে পড়তে হয়।