৬ ফেব্রুয়ারি, শনিবার, সকাল আনুমানিক আটটা। ঘটনাস্থল মিরপুরের কালশী এলাকা। হাঁটা রাস্তায় বেসরকারি সিটি ব্যাংকের এটিএম (অটোমেটেড টেলার মেশিন)। কাচঘেরা কোনো ঘর নেই। রাস্তার ওপর একটি দেয়ালে বসানো এটিএম। শুধু কার্ড প্রবেশ ও গ্রাহকের কার্ডের গোপন পিন নম্বর প্রবেশের অংশটুকু দৃশ্যমান। বাকিটুকু দেয়ালের অপর প্রান্তে।
একজন ভিনদেশির সঙ্গে একজন বাংলাদেশি। উভয়ের বয়স ৩৫ থেকে ৪০-এর মধ্যে। সাজপোশাকে নিপাট ভদ্রলোক। দুজনের পরনেই ছিল কালো রঙের জ্যাকেট। সাধারণভাবে দেখে তাঁদের সন্দেহের কোনো সুযোগ নেই।
দুজনই বুথের কাছে এলেন। বিদেশি লোকটি এগিয়ে গেলেন বুথে। তাঁকে আড়াল করে ঘিরে রেখেছেন সঙ্গে থাকা বাংলাদেশি। ফাঁকে বুথের নিরাপত্তাকর্মীর সঙ্গে টুকটাক কথাও বললেন বাংলাদেশি। সব মিলিয়ে সময় নেওয়া হয় দেড় মিনিট। স্বল্প এই সময়ের মধ্যে বিদেশিটি ওই বুথের কার্ড রিডারের অংশে স্কিমিং ডিভাইস বা গ্রাহকের কার্ডের ব্যক্তিগত গোপনীয় তথ্য চুরির যন্ত্রটি বসিয়ে দেন। এরপর চলে যান দুজনই।
ওই দিনই সন্ধ্যা ছয়টার দিকে ওই ব্যক্তিরা (বিদেশির সঙ্গে বাংলাদেশি) এসে ২০ সেকেন্ডের মধ্যে ডিভাইসটি খুলে নিয়ে যান। যন্ত্রটি বসানো ও খুলে নেওয়ার সময় বুথের পাশ দিয়ে সাধারণ মানুষের বেশ আনাগোনা ছিল।
বুথে স্থাপিত গোপন ক্যামেরায় ধারণ করা ভিডিও চিত্র থেকে এ তথ্য মিলেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে এসব তথ্য-প্রমাণ রয়েছে। যার ভিত্তিতে মামলা দায়েরের প্রস্তুতি নিচ্ছে সিটি ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। বাংলাদেশ ব্যাংকসহ একাধিক নির্ভরযোগ্য ও দায়িত্বশীল সূত্রের সঙ্গে কথা বলে জালিয়াতির এ ঘটনার ভিডিও চিত্রের সময় ও দিন-তারিখের এ বর্ণনা পাওয়া গেছে।
ভিডিও চিত্র পর্যালোচনাকারী বাংলাদেশ ব্যাংক ও সিটি ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তা জানান, ৬ ফেব্রুয়ারি সকাল আটটা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা—এই ১০ ঘণ্টায় কালশী বুথটিতে ৬৪টি কার্ডের লেনদেন হয়। যার মধ্যে ৩২টি সিটি ব্যাংকের নিজস্ব গ্রাহকের বাকি ৩২টি অন্যান্য ব্যাংকের কার্ড।
তথ্য চুরি করা কার্ডগুলোর মধ্যে সিটি ব্যাংকের তিনটি কার্ড ক্লোন করে তা দিয়ে ৮ ও ৯ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর উত্তরা, মিরপুরে একাধিক দফায় লেনদেন করে তিনজন গ্রাহকের হিসাব থেকে ৫০ হাজার, ২০ হাজার ও ২০ হাজার টাকা করে মোট ৯০ হাজার টাকা তুলে নেওয়া হয়। টাকা তোলার ক্ষেত্রে সিটি ব্যাংকের কোনো বুথ ব্যবহার করা হয়নি।
তবে পুরো ঘটনাটি জানাজানি হয় ১২ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার এসে। ওই দিন বেসরকারি ইস্টার্ন ব্যাংকের কার্ডধারী বেশ কিছু গ্রাহকের হিসাব থেকে গ্রাহকের অজান্তে টাকা তুলে নেওয়ার ঘটনা ঘটে। একাধিক গ্রাহক মুঠোফোনের খুদে বার্তা বা এসএমএসের মাধ্যমে টাকা তুলে নেওয়ার বিষয়টি টের পেয়ে ব্যাংকে অভিযোগ করেন। একসঙ্গে একাধিক গ্রাহকের কাছ থেকে এ ধরনের অভিযোগ পাওয়ার পর ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে নামে। আর তাতে জালিয়াতির এ ঘটনাটি বেরিয়ে আসে। ঘটনা তদন্তে নামে বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রাথমিক তদন্তে বাংলাদেশ ব্যাংক জানতে পারে, ইস্টার্ন, সিটি ও ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের (ইউসিবি) রাজধানীর ছয়টি বুথে স্কিমিং ডিভাইস বসিয়ে দুই শতাধিক কার্ড গ্রাহকের ব্যক্তিগত গোপন তথ্য চুরি করে জালিয়াতকারীরা।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই পদ্ধতিতে অর্থ জালিয়াতির বেশ কিছু ঘটনা আছে। তবে বাংলাদেশে এটাই প্রথম।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র শুভঙ্কর সাহা প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে আমাদের কাছে যে তথ্য এসেছে, তাতে ২০০ কার্ডের তথ্য চুরির প্রমাণ রয়েছে। এসব কার্ডধারীর সঙ্গে কথা বলে দ্রুত কার্ডগুলো নিষ্ক্রিয় করার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক নির্দেশ দেয়। সেই অনুযায়ী ব্যাংকগুলো ব্যবস্থাও গ্রহণ করেছে। ইতিমধ্যে অনেক কার্ড নিষ্ক্রিয় করে তার বিপরীতে গ্রাহকদের বিকল্প কার্ডও সরবরাহ করা হয়েছে।’
এ জালিয়াতির ঘটনায় শুক্রবার রাতেই বনানী থানায় মামলা করেছে ইউসিবি। মামলার এজাহারেও ওই ব্যাংকটি বলেছে, তাদের বনানী এলাকার এটিএম বুথে ৭ ফেব্রুয়ারি বেলা আনুমানিক পৌনে ১১টায় স্কিমিং ডিভাইস বসিয়ে গ্রাহকের কার্ডের তথ্য চুরি করা হয়। পরবর্তী সময়ে ১১ ফেব্রুয়ারিসহ একাধিক দিন ওই সব চুরি করা তথ্যের ভিত্তিতে কার্ড ক্লোন করে অন্য ব্যাংকের এটিএমে লেনদেন করা হয়। ইউসিবির ওই ঘটনার সঙ্গেও একজন বিদেশি জড়িত থাকার প্রমাণ রয়েছে ভিডিও চিত্রে। মামলার এজাহারেও সেই বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে।
মামলার এজাহারে ব্যাংকটি আরও বলেছে, তাদের বুথ থেকে চুরি করা তথ্যের ভিত্তিতে ক্লোন কার্ডের মাধ্যমে ১ লাখ ২৬ হাজার টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। চূড়ান্তভাবে টাকার অঙ্ক বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত যেসব ভিডিও চিত্র সংগ্রহ করা হয়েছে, তা পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে একাধিক বিদেশি এ ঘটনায় জড়িত রয়েছে। একজনের ছবির সঙ্গে অন্যজনের ছবি মিলছে না। তবে বিদেশির সঙ্গে দেশীয় লোকও রয়েছে। তাই এটি সংঘবদ্ধ একটি চক্রের কাজ বলে মনে করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এদিকে গতকাল রোববার বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে তিন ব্যাংক ও যেসব এটিএম বুথে বিশেষ যন্ত্র বসানো হয়েছিল, সেসব বুথ পরিদর্শন করা হয়। পাশাপাশি এ ধরনের ঘটনা রোধে ব্যাংকগুলোকে বেশ কিছু নির্দেশনাও দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এ ছাড়া প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকদের ক্ষতিপূরণের বিষয়েও কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে। এদিকে শুক্রবার জালিয়াতির ঘটনার পর গতকাল সপ্তাহের প্রথম কার্যদিবসে এ বিষয়ে লিখিত ব্যাখ্যা দিয়েছে ইস্টার্ন ব্যাংক। ব্যাংকটির জনসংযোগ বিভাগের প্রধান জিয়াউল করিম স্বাক্ষরিত ওই ব্যাখ্যায় বলা হয়, ব্যাংকটির গুলশান এলাকার দুটি বুথেও ‘স্কিমিং ডিভাইস’ বসিয়ে গ্রাহকের গোপন তথ্য চুরি করা হয়। এ ছাড়া ব্যাংকটির ২১ জন গ্রাহকের হিসাব থেকে টাকা তুলে নেওয়ার ঘটনা ঘটে। তবে এ ক্ষেত্রে ইস্টার্ন ব্যাংকের কোনো বুথ থেকে টাকা তোলার ঘটনা ঘটেনি।
ইস্টার্ন ব্যাংকও জানিয়েছে, যথাযথভাবে যাচাই-বাছাই শেষে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকদের টাকা ফেরত দেওয়া হবে।
এদিকে শুক্রবারের ওই ঘটনার পর থেকে বেশির ভাগ ব্যাংকেরই আন্তব্যাংক এটিএম লেনদেন বন্ধ রয়েছে। তবে নিজ নিজ ব্যাংকের এটিএম কার্ডে লেনদেনের ব্যবস্থাটি সচল রয়েছে। যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, আন্তব্যাংক এটিএম লেনদেন চালু রয়েছে।