চান্দগাঁও থানার এক ছাত্রীকে তার বাসায় ধর্ষণ করেন এক প্রতিবেশী। ধর্ষক ধরাও পড়েন। কিন্তু এলাকার মানুষের সহায়তায় তাকে সরিয়ে ফেলা হয় এলাকা থেকে। পরে ওই ছাত্রীকে ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সাপোর্ট সেন্টারে ভর্তি করা হয়। ছাত্রীর পরিবারের সদস্যরা জানান, ধর্ষকদের পক্ষ থেকে এক লাখ টাকা থেকে শুরু করে আড়াই লাখ টাকা পর্যন্ত দিয়ে ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ার ও সমঝোতার চেষ্টা করা হয়। পরিবার রাজি না হওয়ায় চান্দগাঁও থানা পুলিশ সেই ধর্ষককে গ্রেফতার করতে বাধ্য হয়। কিন্তু সমঝোতার প্রস্তাব অব্যাহত থাকে। এক পর্যায়ে পুলিশও মধ্যস্থতা করার দায়িত্ব নিয়ে নেয় বলে অভিযোগ করেন ধর্ষিতার পরিবারের সদস্যরা।
ছাত্রীর অভিভাবকরা বলেন, প্রথম স্টেপ হিসেবে ধর্ষকের পরিবারের পক্ষ থেকে সমঝোতা প্রস্তাব দেওয়া হয়। তাতে রাজি না হওয়ায় দ্বিতীয় স্টেপ নেয় এলাকার লোকদের হাত করে ভয়ভীতি দেখানোর। সবশেষে পুলিশের মাধ্যমে সমঝোতার ব্যবস্থা করার চেষ্টা করে। ভিকটিম পরিবার স্বাভাবিক কারণেই দ্বিতীয় স্টেপে গিয়েই পিছিয়ে আসে। পরিবারের অন্য সদস্যদের যেন আর কোনও ক্ষতি না হয়, সে চেষ্টা অব্যাহত থাকে।
টঙ্গী এলাকায় এক স্কুলছাত্রী ধর্ষণের শিকার হলে এখানেও এলাকাবাসীর সহায়তায় ধর্ষকের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়। মেয়ে অন্তঃসত্ত্বা এবং এই মেয়ের ভবিষ্যত নেই— এসব কথা বলে পরিবারকে কোনও বিচার না চাইতে পরামর্শ দেন স্থানীয়রা। এই ছাত্রীর বাবা বলেন, আমার মেয়েকে যিনি নির্যাতন করেছেন, তার শাস্তি দাবি করেছি কিন্তু নিশ্চিত করতে পারিনি। সমাজে বাস করতে হয় এবং আমার সমাজের লোকজনই থানায় মামলা না করে মেয়ের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসেন। এসব ক্ষেত্রে পুলিশ কী ভূমিকা রেখেছে— জানতে চাইলে তিনি বলেন, ধর্ষক থানার মাধ্যমেও সমঝোতার প্রস্তাব পাঠান।
দেশের ওসিসিগুলোতে ছড়িয়ে আছে এমন হাজারো গল্প। এসব সত্য ঘটনা মানুষকে বিচার চাওয়া থেকে বিরত রাখে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সমঝোতা করে ফেলছেন অভিভাবকরা। কারণ তারা মনে করেন, ধর্ষণের শিকার নারীকে সমাজ মেনে নেবে না। ফলে সমাজ যেভাবে বলবে, সেভাবেই পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা (বিএমবিএস) বলছে, জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত বছরের প্রথম তিন মাসে দেশে ৬৬টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। যার মধ্যে ১৩ জন গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে আটজনকে। যদিও আইন ও সালিশ কেন্দ্র বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ১০৫ জন। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে তিনজনকে।
অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, পরিস্থিতি ক্রমে ভয়াবহ হয়ে উঠছে। গত মার্চে যে পরিমাণ ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে প্রতিটা ক্ষেত্রেই থানায় মামলা হলেও আসামিরা গ্রেফতার না হওয়ায় অপরাধীরা পার পেয়ে যাচ্ছেন। এতে একই আসামি বারবার একই অপরাধ করারও সম্ভাবনা তৈরি হয়। কিছু অপরাধীকে গ্রেফতারের পর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করলে পরিস্থিতির অনেক উন্নতি হবে।
ওসিসিতে আসা ভিকটিমদের ক্ষেত্রেও কেন ন্যায়বিচার নিশ্চিত হচ্ছে না—এমন প্রশ্নের জবাবে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নারী নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে মাল্টিসেক্টোরাল কর্মসূচির প্রকল্প পরিচালক আবুল হোসেন বলেন, প্রাথমিক পর্যায়ে অভিভাবকরা মামলায় আগ্রহী থাকলেও চিকিৎসা শেষে বাড়ি যাওয়ার পর পারিবারিক ও সামাজিক চাপে মামলা চালানোর ক্ষেত্রে পিছিয়ে যান। আমাদের কাছে সমঝোতার খবর আসে। টাকা-পয়সা নিয়ে মেয়ের সম্মানরক্ষার স্বার্থে আপস করতে অভিভাবকরা এগিয়ে এলে আমাদের কিছু করণীয় থাকে না।
অ্যাডভোকেটদ এলিনা খান বলেন, ধর্ষণ মামলা না করে ভিকটিমের সঙ্গে ধর্ষকের বিয়ে দেওয়া বা কোনও ধরনের আপস-রফায় যদি কোনও পুলিশ জড়িত থাকে, তাহলে একটি অভিযোগ করলেই ন্যয়বিচার পাওয়া সম্ভব—এই বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। ভিকটিম পরিবারকে সমাজে নানা লড়াই করে টিকে থাকতে হয়। এ লড়াইয়ে যদি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সাধারণ মানুষ পাশে থাকে, তবে ধর্ষকরা এ ধরনের আপসের চেষ্টা কোনওদিনই করতে চাইবেন না। এসব নিশ্চিত না করে তাকে আপস না করার পরামর্শ না দিলেও তিনি শুনবেন না বলে মনে করেন এই আইনজীবী।