এ যেন মাদকের দুষ্টচক্র। মদ, গাঁজা, হেরোইন, ফেনসিডিল, ইয়াবা। একটির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা গেলে বাড়ে অন্যটি। সংশ্লিষ্টদের কড়াকড়ি ও অভিযানে একটি মাদকের পাচার ও ব্যবহার কমে আসলে আবির্ভূত হয় নতুন একটি। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্র বলছে, এই মুুহূর্তে দেশে ব্যবহারের দিক দিয়ে শীর্ষস্থানে আছে ইয়াবা। পাচার ও ব্যবসা বন্ধে নানামুখী উদ্যোগ নেয়া হলেও আকারে ছোট এবং বহনে সুবিধা থাকায় এটিকে বন্ধ করা যাচ্ছে না।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অপারেশন ও গোয়েন্দা অধিশাখার পরিচালক সৈয়দ তৌফিক উদ্দিন আহমেদ বলেন, আশির দশকে হেরোইনের ব্যবহার বেশি ছিল। ১৯৯৫ সালের পর থেকে বছর খানেক আগ পর্যন্ত রাজত্বটা ছিল ফেনসিডিলের। বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ প্রচেষ্টায় সীমান্তবর্তী অর্ধশতাধিক ভারতীয় অবৈধ ফেনসিডিল কারখানা বন্ধ করে দেয়ার পর ফেনসিডিলের ব্যবহার কমতে শুরু করেছে। প্রায় এক দশক ধরে ব্যাপকহারে বাড়ছে ইয়াবা। গত বছরের শেষ নাগাদ ইয়াবা ব্যবহারকারীর সংখ্যা শীর্ষে পৌঁছে। ইয়াবা পাচার বন্ধে মিয়ানমারের সহায়তার প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেলেও ফল পাওয়া যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন তিনি।
রাজধানীর ফার্মগেট মোড়ে কথা হয় আবদুল জব্বার নামে এক ভবঘুরে ইয়াবাসেবীর সঙ্গে। সে বলে, স্কুলে ফার্স্টবয় ছিলাম। বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে সিগারেট ধরি। ২০০০ সালে কলেজ জীবনে ধরি হেরোইন। পরিবারের উদ্যোগে চিকিৎসায় কিছুদিন ভাল ছিলাম। পরে ফেনসিডিলে আসক্ত হই। এখন ‘বাবা’ (ইয়াবা) খাই।
কেন্দ্রীয় মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের আবাসিক মনোরোগ চিকিৎসক ডা. মো. মাহবুবুল হাসান মানবজমিনকে বলেন, নিরাময় কেন্দ্রগুলোতে এখন ইয়াবাসেবীর সংখ্যা দিন বাড়ছে। ইয়াবা আসক্তদের শারীরিক ও মানসিকভাবে আক্রান্ত করে স্বাভাবিক জীবন ধ্বংস করছে। অনেকে মৃত্যুর দিকেও এগিয়ে যাচ্ছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশে ২০০৩ সালে রাজধানীর নিকুঞ্জের একটি বাসা থেকে প্রথম ইয়াবা আটক হয়। তখনও উচ্চবিত্তের গণ্ডি পেরিয়ে ইয়াবার নাম সাধারণের গোচরে আসেনি। এর অন্তত চার বছর পর মিয়ানমার থেকে সীমান্ত পথে এদেশে ইয়াবার চালান আসতে থাকে। মিয়ানমারের দুর্গম ও প্রত্যন্ত এলাকায় স্থাপিত বহু কারখানা থেকে স্থল ও সাগর পথ পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে কোটি কোটি ইয়াবা ট্যাবলেট আসছে।
মিয়ারনমারে প্রতিটি ইয়াবা ট্যাবলেট বাংলাদেশি টাকায় পাওয়া যায় ৪০ থেকে ৬০ টাকায়। সীমান্ত পার হলেও দাম বাড়ছে দ্বিগুণ। চট্টগ্রামে দাম দাঁড়াচ্ছে ১২০ থেকে ১৬০। ঢাকায় পৌঁছাতে পারলেই প্রতিটি ইয়াবা ট্যাবলেটের দাম হয়ে যাচ্ছে ৩৫০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত। অতি লাভের আশায় প্রায় আড়াই লাখ মাদক ব্যবসায়ী অভিনব কায়দায় বহন করছে ইয়াবা। ইয়াবার আকার ছোট হওয়ায় কনডমে মুড়িয়ে যৌনাঙ্গে, পায়ুপথে, চামড়া কেটে শরীরে ভেতরে লুকিয়ে, পশুর শরীরে ঢুকিয়ে, মাছ, শাকসবজি, বই, জুতা, ক্রিকেট ব্যাটের মধ্যে লুকিয়ে নানা অভিনব কায়দায় মিয়ানমার থেকে ও দেশের ভেতরে ইয়াবা পাচার করা হচ্ছে। মাদকাক্তদের কাছে দিন দিন বাড়ছে ইয়াবার চাহিদা। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সরবরাহ। আর সরবরাহ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে উদ্ধার বাড়লেও তা একেবারে নগণ্য বলে জানা গেছে। জানা যায়, ২০০৭ সালে বাংলাদেশে ৩৬ হাজার ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার হয়েছে। পরের বছরও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ইয়াবা উদ্ধার হয়েছে। এরপর ইয়াবার সরবরাহ বাড়ায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সঙ্গে বাংলাদেশ পুলিশ, বিজিবি, র্যাব, কোস্টগার্ড, শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগ ইয়াবা উদ্ধারে তাদের তৎপতা জোরদার করে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরসহ ওই ছয় সংস্থা ২০০৯ সালে ১ লাখ ২৯ হাজার ৬৪৪টি ট্যাবলেট ইয়াবা উদ্ধার করে। পরের বছরেই উদ্ধার বাড়ে প্রায় সাতগুণ। ২০১০ সালে উদ্ধার হওয়া ইয়ার পরিমাণ ছিল ৮ লাখ ১২ হাজার ৭১৬টি। এভাবে ক্রমবর্ধমান হারে ২০১১ সালে ১০ লাখ ৭৬ হাজার ১১৫টি, ২০১২ সালে ১৯ লাখ ৫১ হাজার ৩৯২, ২০১৩ সালে ২৮ লাখ ২১ হাজার ৫২৮টি ইয়াবা ট্যাবলেট ও পাঁচ কেজি অ্যাম্ফিটামিন পাউডার এবং ২০১৪ সালে ৬৫ লাখ ১২ হাজার ৬৮৯টি ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার হয়েছে। এর তিনগুণ বেড়ে সর্বশেষ ২০১৫ সালে উদ্ধার হয়েছে এক কোটি ৯৫ লাখ ৪৪ হাজার ১৭৫টি ইয়াবা ট্যাবলেট। অপর দিকে ২০০৯ সাল থেকে একই সময়ে হেরোইন সেবীর সংখ্যা কমায় কমেছে উদ্ধারের সংখ্যাও। ২০০৯ সালে ১৫৯ কেজি ৭৮৩ গ্রাম, ২০১০ সালে ১৮৮ কেজি ১৮৬ গ্রাম, ২০১১ সালে ৮ কেজি, ২০১২ সালে ১২৪ কেজি ৯২ গ্রাম, ২০১৩ সালে ১২৩ কেজি ৭২৯ গ্রাম, ২০১৪ সালে ৮৪ কেজি এবং সর্বশেষ ২০১৫ সালে ৭৮ কেজি ৩ গ্রাম হেরোইন উদ্ধার করেছে ওই ছয়টি সংস্থা। একইভাবে ফেনসিডিল সেবীদের অনেকে ইয়াবার দিকে ঝুঁকে পড়ায় চাহিদা, সরবরাহ ও উদ্ধার কমেছে এই মাদকটিরও। ২০০৯ সালে ১১ লাখ ১৭ হাজার ৩৫৪ বোতল, ২০১০ সালে ৯ লাখ ৬১ হাজার ২৬০ বোতল, ২০১১ সালে ৯ লাখ ৪৩ হাজার, ১৩, ২০১২ সালে ১২ লাখ ৯১ হাজার ৭৮, ২০১৩ সালে ৯ লাখ ৮৭ হাজার ৭৬, ২০১৪ সালে ৩০ হাজার ৮১৮ এবং সর্বশেষ ২০১৫ সালে ৩০ হাজার ৪২৯ বোতল ফেনসিডিল উদ্ধার হয়েছে। মাদকসেবী ও বিক্রেতার সংখ্যা ধারাবাহিকভাবে বাড়লেও কমছে হেরোইন, ফেনসিডিল, গাঁজসহ অধিকাংশ মাদকের ব্যবহার। আর ক্রাসমান এসব মাদকের স্থান দখল করছে ইয়াবা। এ দিকে অতীতে হেরোইন, ফেনসিডিল, মদ উদ্ধারের ঘটনায় বাংলাদেশে মামালা ও আসামি গ্রেপ্তারের সংখ্যাও বেশি ছিল। সর্বশেষ গত বছর একমাত্র গাঁজা ছাড়া ইয়াবা উদ্ধারের ঘটনায় সবচেয়ে বেশি মামলা ও আসামি গ্রেপ্তার হয়েছে। গত বছর হেরোইন উদ্ধারের ঘটনায় সারা দেশে ৫৩০টি মামলায় ও ৪১৩ জন আসামি হয়। ফেনসিডিল উদ্ধারের ঘটনায় ৫৩৮টি মামলায় আসামি হয়েছে ৬৫৫ জন। ইয়াবা উদ্ধারের ঘটনায় গত বছর ১ হাজার ৩০৪টি মামলা দায়ের এবং তাতে এক হাজার ৪৮২ জনকে আসামি করা হয়েছে। একইভাবে গত কয়েক বছরে সারা দেশে বেড়েছে মাদক মামলাও। গত বছর সারা দেশে মাদকের ঘটনায় অর্ধলক্ষাধিক মামলা দায়ের এবং তাতে প্রায় ৭০ হাজার মাদকসেবী ও ব্যবসায়ীকে আসামি করা হয়। মরণ নেশা ইয়াবা দেশের যুব সমাজকে ধ্বংস করে পরিবার, সমাজ ও দেশকে কলুষিত করছে। নিয়ে যাচ্ছে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। অবণতি হচ্ছে আইনশৃঙ্খলার। ইয়াবাসেবী ঐশির হাতেই তার পিতামাতাসহ পুরো পরিবার খুন হলো।