নতুন কমিটি গঠন নিয়ে দলে কোনো সংকট রয়েছে বলে মির্জা ফখরুল মনে করেন না। তিনি সমকালকে বলেছেন, যে কোনো বড় রাজনৈতিক দলে নেতৃত্ব নিয়ে প্রতিযোগিতা থাকা স্বাভাবিক। দলের চেয়ারপারসনের ওপর কাউন্সিলরদের অর্পিত দায়িত্ব অনুযায়ী নতুন কমিটি গঠনের কাজ করছেন তিনি। খালেদা জিয়া তার দীর্ঘ রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক অভিজ্ঞতার আলোকে দলের যোগ্য, ত্যাগী ও প্রবীণ-নবীনদের সমন্বয়ে নতুন কমিটি উপহার দেবেন।
সূত্র জানায়, লন্ডন থেকে বড় ছেলে ও দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদে তার পছন্দের নেতাদের দেখতে চান। তাদের অনেককে ওইসব পদ দেওয়ার পক্ষে নন খালেদা জিয়া। আবার কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদ দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবও পছন্দের কিছু নেতাকে দিতে চান। পূর্ণাঙ্গ মহাসচিব হলে দল পরিচালনায় সাংগঠনিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে তার অনুসারী নেতাদের বসাতে চেষ্টা করছেন তিনি। মির্জা ফখরুলের পছন্দের লোকদের গুরুত্বপূর্ণ পদ দেওয়া ঠেকাতে মরিয়া তার বিরোধী স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বরপন্থিরা। এ লক্ষ্যে জাতীয় নির্বাহী কমিটি গঠনের আগে মহাসচিব পদের ঘোষণা করার বিপক্ষে অবস্থান নেন তারা। গয়েশ্বরপন্থিদের আশঙ্কা, মির্জা ফখরুল আগে পূর্ণাঙ্গ মহাসচিব হয়ে গেলে কমিটিতে তার পছন্দের বেশি সংখ্যক নেতাকে পদায়ন করবেন। এতে ফখরুলের প্রভাব বেড়ে যাবে, ফলে কোণঠাসা হয়ে পড়তে পারেন গয়েশ্বরপন্থিরা।
বিএনপির একজন নেতা সমকালকে বলেন, বিগত কাউন্সিলে মহাসচিব পদে আগে ঘোষণার পর নির্বাহী কমিটি গঠন করা হয়েছিল। এবার মির্জা ফখরুলকে ঠেকাতে গিয়ে মহাসচিব পদে ঘোষণা দেরি হচ্ছে। জানা গেছে, মহাসচিবের পদসহ পূর্ণাঙ্গ কমিটি একসঙ্গে ঘোষণা দিতে খালেদা জিয়ার ওপর চাপ তৈরি করেছেন তার বিরোধীরা।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন সমকালকে বলেন, তাড়াহুড়ার কিছু নেই। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব অনুযায়ী শিগগির যোগ্য ও ত্যাগীদের মাধ্যমে নতুন কমিটি ঘোষণা দেবেন।
সূত্র জানায়, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে পূর্ণাঙ্গ মহাসচিব করার বিষয়টি প্রায় নিশ্চিত। ইতিমধ্যে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও লন্ডনে অবস্থানরত সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান এ ব্যাপারে তার অনাপত্তি জানিয়েছেন। দলের কাউন্সিলের রুদ্ধদ্বার অধিবেশনেও সকল মহলে মির্জা ফখরুলের গ্রহণযোগ্যতা, দীর্ঘ কারাভোগসহ ত্যাগী ভূমিকা মূল্যায়ন করে পূর্ণাঙ্গ মহাসচিব করতে দলের চেয়ারপারসনের কাছে দাবি জানিয়েছেন বেশ কয়েকজন কাউন্সিলর। এরপরও থেমে নেই মির্জা ফখরুলের বিরোধীরা। বিশেষ করে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের নেতৃত্বাধীন বলয়টি স্থায়ী কমিটির প্রবীণ সদস্য তরিকুল ইসলামকে মহাসচিব করতে নানামুখী লবিং চালিয়ে যাচ্ছে।
সূত্র জানায়, স্থায়ী কমিটির সদস্য পদ নিয়েও দলের ভেতরে গ্রুপিং-লবিং চলছে। বর্তমান প্রভাবশালী সদস্যরা নতুন করে স্থায়ী কমিটি করার ক্ষেত্রে গভীরভাবে হিসাব-নিকাশ করতে দলের চেয়ারপারসনকে পরামর্শ দিচ্ছেন। কেউ কেউ ওয়ান-ইলেভেনের সময়ের ভূমিকা মাথায় রেখে স্থায়ী কমিটির সদস্য করার পরামর্শ দিচ্ছেন। কেউ বিগত আন্দোলনে ভূমিকা মূল্যায়নের কথা বলছেন।
সূত্র জানায়, বর্তমানে বিএনপির ১৯ সদস্যের স্থায়ী কমিটির ৩টি পদ শূন্য রয়েছে। সাবেক মহাসচিব অ্যাডভোকেট খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন, ড. আরএ গণির মৃত্যু এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসি হওয়ায় এ পদগুলো শূন্য হয়। দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর পূর্র্ণাঙ্গ মহাসচিব হলে পদাধিকার বলে স্থায়ী কমিটির সদস্য হবেন তিনি। এরপর পদ শূন্য থাকবে আর দুটি। এ দুটি পদের জন্য কমপক্ষে একডজন নেতা তদবির করছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন_ ভাইস চেয়ারম্যান এম মোরশেদ খান, আবদুল্লাহ আল নোমান, সাদেক হোসেন খোকা, মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, সেলিমা রহমান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ড. ওসমান ফারুক, আবদুল আউয়াল মিন্টু, অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন, অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদিন, যুগ্ম মহাসচিব মোহাম্মদ শাহজাহান, সালাহউদ্দিন আহমেদ প্রমুখ।
সূত্র জানায়, চট্টগ্রামে তিনজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা স্থায়ী কমিটির সদস্য হতে চাওয়ায় কিছুটা বেকায়দায় পড়েছেন খালেদা জিয়া। সাম্প্রতিক সময়ে দলের পক্ষে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যোগাযোগে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করায় আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীকে স্থায়ী কমিটির সদস্য করতে চান হাইকমান্ড। চট্টগ্রাম অঞ্চলের অপর সিনিয়র রাজনীতিবিদ ও দলের ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমানও স্থায়ী কমিটির সদস্য হতে আগ্রহী। বিগত কাউন্সিলে তার চেয়ে জুনিয়র তিন নেতা মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ও নজরুল ইসলাম খানকে স্থায়ী কমিটির সদস্য করায় মনোক্ষুণ্ন হন তিনি। এদিকে বর্তমানে দলের দ্বিতীয় ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এম মোরশেদ খানও স্থায়ী কমিটির সদস্য হতে আগ্রহী। দলের অপর ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকাও বিগত কাউন্সিলে স্থায়ী কমিটির সদস্য না হওয়ায় ক্ষুব্ধ। এবার তাকেও স্থায়ী কমিটিতে আনা না হলে তিনিও রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় হয়ে যেতে পারেন।
স্থায়ী কমিটির ২ জন সদস্য শামসুল ইসলাম ও বেগম সারোয়ারী রহমান দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ হয়ে নিষ্ক্রিয় রয়েছেন। খালেদা জিয়া দলের প্রতি অবদানের কথা স্মরণ করে স্থায়ী কমিটিতে তাদের রেখে দিতে পারেন। তবে দলের ভেতর নিষ্ক্রিয়দের কম গুরুত্বের পদে রাখার ব্যাপারে চাপ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে শেষ পর্যন্ত তাদের দলের উপদেষ্টা কমিটিতে নেওয়া হলে আরও দুটি পদ শূন্য হতে পারে।
সূত্র জানায়, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব পদ পেতে দলের তিন নেতা জোর লবিং চালাচ্ছেন। এ পদে দলের বর্তমান যুগ্ম মহাসচিব মোহাম্মদ শাহজাহান, সালাহউদ্দিন আহমেদ ও রুহুল কবির রিজভীর নাম আলোচনায় রয়েছে। তাদের মধ্য থেকেই একজনকে এই পদে রেখে অন্য দু’জনকে স্থায়ী কমিটির সদস্য অথবা ভাইস চেয়ারম্যান করা হতে পারে। দলের যুগ্ম মহাসচিব, সাংগঠনিক সম্পাদক ও দপ্তর সম্পাদক পদের জন্য বেশ কয়েকজন সাবেক ছাত্রদল নেতা লবিং চালাচ্ছেন।