বিনিয়োগ ও অর্থনীতিতে ‘গতি আনতে’ ব্যাংক খাতের তহবিল ব্যয় কমানোর উদ্যোগ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর অংশ হিসেবে রেপো ও রিভার্স রেপোর সুদ হার কমিয়ে চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের (জানুয়ারি-জুন) মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হয়েছে। সেই সঙ্গে আগামী ছয় মাসে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির প্রত্যাশাও আগের তুলনায় কমিয়ে এনেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এই মুদ্রানীতি ঘোষণা করে গভর্নর আতিউর রহমান বৃহস্পতিবার এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘উৎপাদন ও মূল্য পরিসি’তির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে আমরা সংযত কিন’ সমর্থনমূলক মুদ্রানীতির ভঙ্গি দিয়ে যাচ্ছি। এবারে আমরা নীতি সুদ হারগুলো কমিয়েছি।”
ব্যাংকগুলো যখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধার করে, তখন তার সুদহার ঠিক হয় রেপোর মাধ্যমে। মুদ্রানীতিতে রেপোর হার ৫০ বেসিস পয়েন্ট কমিয়ে ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ করা হয়েছে।
রিভার্স রেপোর মাধ্যমে বাংকগুলো তাদের উদ্বৃত্ত অর্থ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা রাখে। এক্ষেত্রেও সুদহার ৫০ বেসিস পয়েন্ট কমিয়ে ৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ করা হয়েছে।
২০১৩ সাল থেকে রেপোর সুদ হার ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ এবং রিভার্স রেপোর সুদ হার ৫ দশমিক ২৫ শতাংশ ছিল।
রেপো বা রিভার্স রেপোর মাধ্যমে সাধারণত এক দিনের জন্য ধার করা বা জমা রাখা হয়। একে বলা হয় ব্যাংকিং খাতের নীতি উপাদান (পলিসি টুলস)। এর সুদ হারকে বলা হয় নীতি সুদ হার (পলিসি রেট)। এর মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজারে তারল্য ও বিনিয়োগ নিয়ন্ত্রণ করে।
রেপোর সুদ কমলে ব্যাংকগুলো কম খরচে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে তহবিল পাবে। তাতে তারা কম সুদে ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীদের ঋণ দিতে পারবে।
অন্যদিকে রিভার্স রেপোর সুদ হার কমানোর অর্থ হলো, ব্যাংকগুলোকে চাপ দেওয়া, যাতে তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে টাকা ফেলে রেখে মুনাফা না তুলে ব্যবসা ও উদ্যোগে বিনিয়োগ বাড়ায়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সম্মেলন কক্ষে মুদ্রানীতি ঘোষণা অনুষ্ঠানে গভর্নর বলেন, বর্তমানে আন্তঃব্যাংক লেনদেনে কলমানি সুদ হার ৩-৪ শতাংশ, মূল্যস্ফীতি এবং অন্যান্য সুদ হারও কম। এ পরিসি’তিতে রেপো বেশি থাকলে ‘বৈপরিত্য’ দেখা দিতে পারে বলেই নীতি সুদ হার কমানো হয়েছে।
তবে শেষ পর্যন্ত এ উদ্যোগের উদ্দেশ্য যে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বাড়িয়ে বিনিয়োগে গতি আনা, তা স্পষ্ট হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ বিরূপাক্ষ পালের কথায়।
‘অর্থনীতির গতির জন্য এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। গত তিন বছর ধরে রেপো ও রিভার্স রেপো রেট একই ছিল। এখন ব্যাংকের কস্ট অব ফান্ড কমানোর জন্য রেট কমানো হলো।’
এবার মুদ্রানীতিতে আগামী ছয় মাসে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ, যা আগের ছয় মাসের তুলনায় কম।
গত মুদ্রানীতিতে পুরো অর্থবছরের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি ধরেছিল ১৫ শতাংশ। তবে নভেম্বরের হিসেব পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ।
এ বিষয়ে গভর্নর বলেন, ‘ঋণের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ নির্ধারণ করা মানে এই না যে বাজারে ঋণের চাহিদা বেশি থাকলে আমরা আটকে রাখব। যে কোনো চাহিদা পূরণের প্রস্তুতি আমাদের আছে। আমরা শুধু বাস্তবতার সাথে চলার কথা বলছি। প্রয়োজনে মাঝপথেও এই নীতি পরিবর্তনের সুযোগ থাকবে।’
দেশের অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক ইতিবাচক হলেও বিনিয়োগে খরা চলছে বেশ কয়েক বছর ধরে। ব্যাংকাররা বলছেন, বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ চাহিদা না থাকায় ঋণ বিতরণ খুব বেশি এগোচ্ছে না। এক লাখ কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগযোগ্য তহবিল ব্যাংকগুলোতে পড়ে আছে।
অন্যদিকে শিল্পোদ্যোক্তারা বলছেন, দুই অংকের সুদে ঋণ নিয়ে ব্যবসায় টিকে থাকা কঠিন, বিনিয়োগ বাড়ানোও সম্ভব না।
একটি ব্যাংক যে আমানত সংগ্রহ করে তার সর্বোচ্চ ৮১ শতাংশ ঋণ দিতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, গত ২৭ আগস্ট পর্যন্ত ঋণ-আমানত অনুপাত ছিল ৬৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ। অর্থাৎ, ১০০ টাকা আমানতের মধ্যে ৬৮ দশমিক ৭৫ টাকা ব্যাংক বিনিয়োগ করতে পেরেছে।
এ বিষয়ে ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর চৌধুরী বলেন, ‘ব্যাংক খাতে এই মুহূর্তে অনেক তারল্য আছে এটা ঠিক। প্রায় এক লাখ ২০ হাজার কোটি টাকার তারল্য রয়েছে। এর মধ্যে ৯৪ ভাগই বিভিন্ন সুদবাহী সিকিউরিটিজে বিনিয়োগ করা। আর মাত্র ৩ হাজার ৭০০ কোটি টাকা, যেটা সিআরআরের অতিরিক্ত, সেটি অলস তারল্য।’
তবে ব্যাংকগুলো ‘ভালো বিনিয়োগের’ সুযোগ পেলে এতো টাকা যে সিকিউরিটিজে বিনিয়োগ করতো না, তা ডেপুটি গভর্নরও স্বীকার করেন।
‘আমরা আশা করছি, আগামী ছয় মাসে বিনিয়োগ বাড়বে,’ বলেন তিনি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই মুদ্রানীতিকে ‘ইতিবাচক’ বললেও বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরিতে আরও বেশি গুরুত্ব দিতে বলেছেন মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস’াপনা পরিচালক আনিস এ খান।
তিনি বলেন, ‘নীতি সুদ হার কমলে তার প্রভাব পুরো ব্যাংক খাতে পড়বে। এতে কস্ট অব ফান্ড কমবে। তবে তার চেয়ে বেশি দরকার বিনিয়োগ পরিবেশ।
‘এখন ব্যাংক খাতে অনেক তারল্য আছে। বিনিয়োগ পরিবেশ তৈরি হলেই উদ্যোক্তারা আসবেন, অন্য উপায়ে তাদের আনা যাবে না।’
মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি কম ধরা হলেও দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি গত অর্থবছরের চেয়ে বেশি হবে বলে আশা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
সরকারি কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধি, কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, রপ্তানি আয় ও প্রবাসী আয়ে ইতিবাচক ধারা অব্যাহত থাকায় অভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়ছে এবং জিডিপি প্রবৃদ্ধি গতিশীল হচ্ছে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক আশা করছে, চলতি অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ৬ দশমিক ৮ থেকে ৬ দশমিক ৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হতে পারে। আর রাজনৈতিক সি’তিশীলতা বজায় থাকলে অর্থবছর শেষে তা ৭ শতাংশও স্পর্শ করতে পারে।
এ অর্থবছরে মূল্যস্ফীতির হার ৬ দশমিক ১ শতাংশের মধ্যে বেঁধে রাখা সম্ভব হবে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আশা করছে।
এ অর্থবছরের বাজেটে সরকার ৭ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের পাশাপাশি মূল্যস্ফীতির হার ৬ দশমিক ২ শতাংশের মধ্যে রাখার প্রত্যাশার কথা বলেছে।
মুদ্রানীতির এই প্রত্যাশার পক্ষে যুক্তি দিয়ে বিরূপাক্ষ পাল বলেন, ‘গত অর্থবছরেও বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি এই ১৩/১৪ শতাংশ ছিল। তাতে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছে। কারণ কোয়ালিটি ক্রেডিট (মানসম্পন্ন ঋণ) গেছে, প্রোডাক্টিভ সেক্টরে গেছে। এবার আশা করছি, এই ঋণ প্রবৃদ্ধিতে সরকারের লক্ষ্য অনুযায়ী জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হবে।’
আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমে যাওয়ায় সরকারের পক্ষে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সহজ হলেও এ বিষয়ে আরও সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন গভর্নর।
তিনি বলেন, ‘ডিসেম্বর শেষে খাদ্য ও জ্বালানি বহির্ভূত মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ, যা মূল্যস্ফীতিকে ঊর্ধ্বমুখি চাপে রেখেছে।’
দেশের বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয় করার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের অবস’ান সম্পর্কে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে গভর্নর বলেন, ‘এটি রাজস্ব নীতির বিষয়, যা সম্পূর্ণ সরকারের ওপর নির্ভর করে।
‘তবে আমরা বলব, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমায় আমরা যা আমদানি করছি সেগুলো কম দামে পাচ্ছি, আনতে খরচও কম হচ্ছে। তার প্রভাব আমাদের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে পড়ছে।’