সরকার বাংলাদেশ নাগরিকত্ব আইন, ২০১৬ নামে একটি আইন পাস করার উদ্যোগ নিয়েছে। আইনটি পাস হলে বাংলাদেশে বৈবাহিক ও অন্যান্য সূত্রে বসবাসকারী মিয়ানমার ও পাকিস্তানের নাগরিকদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হবে।
প্রস্তাবিত নাগরিকত্ব আইনে বলা হয়েছে, প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারসহ সার্কভুক্ত দেশের নাগরিকেরা বৈবাহিক বা অন্য কোনো সূত্রে বাংলাদেশের নাগরিক হলে তাঁরা একসঙ্গে দুই দেশের নাগরিক অর্থাৎ দ্বৈত নাগরিক থাকতে পারবেন না। তাঁদের এক দেশের নাগরিকত্ব ত্যাগ করতে হবে।
একইভাবে বাংলাদেশের কোনো নাগরিকও মিয়ানমারসহ সার্কভুক্ত দেশগুলোতে দ্বৈত নাগরিকত্ব নিতে পারবেন না। তবে অন্য দেশে দ্বৈত নাগরিকত্ব নেওয়া যাবে।
এই বিধানসহ বাংলাদেশে নাগরিকত্ব পাওয়ার ক্ষেত্রে সাতটি বিভাগ নির্ধারণ করে বাংলাদেশ নাগরিকত্ব আইন, ২০১৬-এর খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। প্রস্তাবিত আইনে ভুয়া নাগরিক প্রমাণিত হলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিয়ে মামলা করা যাবে। এতে সর্বনিম্ন ৫ থেকে সর্বোচ্চ ১০ বছর কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।
আইন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, মিয়ানমারের যেসব নাগরিক বাংলাদেশিকে বিয়ে করেছেন তাঁদের বিয়ে যেন রেজিস্ট্রি করা না হয়, সে ব্যাপারে ইতিমধ্যে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ওই দেশের বিপুলসংখ্যক নাগরিক এ দেশে অবৈধভাবে আছেন। তাঁদের একটি বড় অংশ এখানে বিয়েও করেছেন। এ আইন হলে মিয়ানমারের এমন নাগরিকদের বিষয়ে সহজে সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে।
নতুন নাগরিকত্ব আইন প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মোস্তফা কামাল উদ্দিন বলেন, আগে বাংলাদেশিদের ক্ষেত্রে সার্কভুক্ত দেশসহ মিয়ানমারে দ্বৈত নাগরিকত্বের বিষয়ে কোনো বিধান ছিল না। এই সুযোগে কেউ যাতে সার্কভুক্ত কোনো দেশ ও মিয়ানমারের দ্বৈত নাগরিকত্ব দাবি করতে না পারেন, সে জন্যই আইনে বিধানটি সংযুক্ত করা হয়েছে।
আবার স্বাধীনতাযুদ্ধে বা অন্য কোনো ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন বা করছেন, বাংলাদেশে নাগরিকত্ব লাভের জন্য তাঁদের করা আবেদন গ্রহণযোগ্য হবে না। এমনকি কোনো ব্যক্তি বাংলাদেশবিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকলে বা বাংলাদেশের অস্তিত্ব অস্বীকার করলে তাঁর নাগরিকত্বের আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হবে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, পাকিস্তান সরাসরি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। কিন্তু পাকিস্তানের অনেক নাগরিক বাংলাদেশে বসবাস করছেন। এঁদের মধ্যে একটা বড় অংশের কাছে দুই দেশেরই পাসপোর্ট রয়েছে। নতুন আইন হলে এসব ব্যক্তিকে একটি দেশ বেছে নিতে হবে।
জানতে চাইলে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের দেশের স্বার্থে বাংলাদেশের নাগরিক কারা তা চিনে নেওয়া উচিত। কেননা, দুই দেশের নাগরিকের সুবিধা নিয়ে অনেকে রাষ্ট্রবিরোধী বিভিন্ন ক্ষতিকর কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হতে পারেন। এ আইন হলে তাঁদের বিষয়ে পরিষ্কার হওয়া যাবে।’
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মোজাম্মেল হক প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশ নাগরিকত্ব অধ্যাদেশ, ১৯৭২ এবং আইন কমিশনের ২০০৫ ও ২০১২ সালে সুপারিশের আলোকে নাগরিকত্বের খসড়া আইনটি চূড়ান্ত করা হয়েছে। এ আইনে বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ বা বাংলাদেশের কোনো দূতাবাস বা জাহাজ কিংবা বিমানে জন্মগ্রহণ, বাংলাদেশি নাগরিকদের সন্তান ও তাঁদের সন্তান, দ্বৈত নাগরিক, অর্জিত নাগরিকত্ব, বৈবাহিক সূত্র, নতুন সংযুক্ত ভূখণ্ডের অধিবাসী এবং বাংলাদেশে স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ চেয়ে আবেদন করা ব্যক্তিরা নাগরিকত্বের জন্য যোগ্য বিবেচিত হবেন। এ ছাড়া বিশেষ অবদানের জন্য সম্মানসূচক নাগরিকত্ব দেওয়ার বিধানও রাখা হয়েছে খসড়া আইনে।
বৈবাহিক সূত্রে নাগরিকত্ব লাভের বিষয়ে আইনে বলা হয়েছে, যেসব ব্যক্তি বাংলাদেশি কোনো নাগরিককে বিয়ে করে বসবাসের অনুমতি নিয়েছেন বা দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করছেন, তাঁরা নাগরিকত্বের আবেদনের জন্য যোগ্য বিবেচিত হবেন। এই শ্রেণিতে নাগরিকত্ব লাভের পাঁচ বছরের মধ্যে যেকোনো দেশে ২ বছরের বেশি সাজা পেলে বা টানা ১০ বছরের বেশি বাংলাদেশের বাইরে অবস্থান করলে তাঁর নাগরিকত্ব বাতিল করা হবে।
বয়সের বিষয়ে আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, ১৮ বছরের নিচে যাদের বয়স, তাদের নাবালক হিসেবে গণ্য করা হবে। এর বেশি বয়সীদের প্রাপ্তবয়স্ক বা সক্ষম হিসেবে বিবেচনা করা হবে। এ ছাড়া দেশের উন্নয়ন, বিজ্ঞান, দর্শন, শিল্প, সাহিত্য, শান্তি ও মানব উন্নয়নে অবদান রাখা ব্যক্তিদের বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদানের ক্ষমতা সরকারের হাতে থাকবে।
সূত্র জানায়, প্রবাসীদের দ্বৈত নাগরিকত্বের ক্ষেত্রে সন্তান জন্মের দুই বছরের মধ্যে সংশ্লিষ্ট দূতাবাস বা মিশনের কার্যালয়ে নাম নিবন্ধন করতে হবে। আর তা না হলে ওই সন্তান জন্মসূত্রে বাংলাদেশের নাগরিক বলে বিবেচিত হবে না। তবে বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশি নাগরিকদের সন্তান এ দেশে জন্ম নিলেও বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে গণ্য করা হবে না।
খসড়ায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশের নাগরিকত্বের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে যথাযথ নিয়ম অনুসরণ করে আবেদনের পর প্রদত্ত তথ্য-উপাত্ত যাচাই-বাছাই করা হবে। এই যাচাই-বাছাইয়ের সময় আবেদনকারী টানা ছয় মাস বিদেশে থাকতে পারবেন না। আবেদনে ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো ভুল বা অসম্পূর্ণ বা মিথ্যা তথ্য দিলে কিংবা কোনো তথ্য গোপন করলে ওই ব্যক্তিকে দুই বছরের কারাদণ্ড এবং পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা করা হবে। এ ধরনের ভুল দ্বিতীয়বার করলে শাস্তি দ্বিগুণ হবে।
বাংলাদেশ সরকার ২০০৯ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত মোট ৩৭ হাজার ৫৪৪ জন বিদেশিকে বাংলাদেশি নাগরিকত্ব দিয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ-ভারত ছিটমহল বিনিময়ের কারণে ৩৭ হাজার ৫৩৫ জনকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেওয়া হয়। এর বিপরীতে ছিটমহল বিনিময় করে ১৪ হাজার ৮৬৪ জন ও ব্যক্তিগত আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ৫২৬ জন বাংলাদেশি নাগরিকত্ব ত্যাগ করেছেন।
এ ছাড়া ২০১৪ সালে বৈবাহিক সূত্রে নাগরিকত্ব দেওয়া হয়েছে পাঁচজনকে। বিশেষ অবদানের জন্য বাংলাদেশ নাগরিকত্ব দিয়েছে দুজনকে। এঁরা হলেন নিউজিল্যান্ডের ফাদার আরতুরো ও ইতালিয়ান নাগরিক এড্রিক সাজিসন বেকার। সম্মানসূচক নাগরিকত্ব দেওয়া হয়েছে ব্রিটিশ নাগরিক ভেলেরি এ টেইলর ও ইতালিয়ান নাগরিক ফাদার মারিনো রিগানকে। এ সময় ৯ হাজার ১৬ জন প্রবাসী বাংলাদেশিকে দ্বৈত নাগরিকত্ব দেওয়া হয়েছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, কিছু বিদেশি নাগরিক বাংলাদেশি বিয়ে করে নাগরিকত্ব লাভের বিষয়ে ন্যায়বিচার চাইতে হাইকোর্টে আবেদন করেন। এ আইন হলে তাঁদের জটিলতার অবসান হবে।
প্রসঙ্গত, ভারত দ্বৈত নাগরিকত্ব অনুমোদন করে না। তবে ভারতের আইনে ‘ওভারসিস সিটিজেনশিপ’ দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। এ ধারায় নাগরিকত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি নির্বাচনে অংশ নেওয়া, সরকারি চাকরি করা, সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার সুযোগ পান না। শ্রীলঙ্কাও নাগরিকদের দ্বৈত নাগরিকত্ব অনুমোদন করে না। অন্য দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করতে ব্যক্তির নিজ দেশের নাগরিকত্ব পরিত্যাগ করতে হয়।