বিথী হক:
সতীত্ব দিয়ে যতদিন একটা মেয়ের চরিত্র বিচার করা হবে ততদিন প্রেম ভাঙ্গা মেয়েদের আত্মহত্যার প্রবণতা একইরকম থাকবে। মানুষের কাছে একটা মেয়ের জীবনের থেকে সতীত্বের গুরুত্ব বেশি জরুরি হওয়ার কারণে পান থেকে চুন খসলেই নারীরা সতীত্বহীন, অদরকারি জীবন মানুষের সমাজে উপস্থাপন করতে চাইবে না এটাই স্বাভাবিক।
তারপর মরে গেলেও রেহাই নাই। সমাজ তাদের দিকে তর্জনী নির্দেশ করে বলে, কাপুরুষ, ভীরু, পরাজিত, হার মেনে নেয়া মেয়েমানুষ। বেঁচে থাকলে অকুতোভয়, সাহসী বা বিজয়ী বলা হতো কিনা সে প্রশ্ন অবান্তর। অনুগ্রহ করে বলবেন, আপনারা তাদের বাঁচিয়ে রাখতে চান নাকি মেরে ফেলতে চান?
যদি বাঁচিয়ে রাখতে চান, তাহলে যাদের অসতী বলছেন তাদের নাহয় অসতী হিসেবেই মেনে নেন। তাদেরকে বোঝার সুযোগ দেন, ভাবতে বাধ্য করেন সতীত্ব নামক অলীক বস্তু থাকলে বা না থাকলে তাতে কিছু আসে যায় না। তাদেরকে সমাজের আর দশটা মেয়ের মত সুন্দর-স্বাভিবিক জীবন ফিরিয়ে দেন। ধর্ষিতা বলে তাকে একঘরে করে না রেখে সবার সঙ্গে, সবার সামনে দিয়ে ‘নিলর্জ্জ’ হয়ে স্কুলে যেতে দেন, তার দিকে অচ্ছুৎ বলে অঙ্গুলি নির্দেশ না করে তাকে তার মত করে বাঁচতে দেন। পারবেন?
ধর্ষিতা বলে ধর্ষকের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে সারাজীবন ধর্ষন করবার সুব্যবস্থা না করে তাকে পড়াশোনা করতে দেন, মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে দেন, তারপর নিজের পছন্দে বিয়ে করতে দেন। দেবেন? সে সাহস আছে? তাকে বুঝতে দেন সতীত্ব বলে কোন জিনিস পৃথিবীতে নাই। যা আছে সেটা আত্মসম্মান, মেধা, জ্ঞান-গরিমা এবং সর্বোপরি আরো অনেক কিছুই থাকতে পারে যা একটা মানুষকে আরো সম্মানিত করে; যার সঙ্গে যোনির কোনরূপ যোগসূত্র নাই।
যে পুরুষ দ্বারা তারা ধর্ষণের শিকার হয় সে পুরুষকে কি কোনভাবে ভালবাসা সম্ভব? তার সঙ্গে ভালভাবে বাঁচা সম্ভব? বিয়ের আগে যেটাকে সমাজ ধর্ষণ বলে, সেটাই বিয়ের পরে স্বাভাবিক হয়ে যায় কোন মগের মুল্লুকের বদৌলতে একটু খুলে বলবেন? ম্যারিটাল রেপ বলে যে কোন অবস্তুগত জিনিস আছে সেসবে সমাজের কোন আগ্রহ নাই, জানে না এবং জানতেও চায় না।
এ তো গেল ধর্ষণ আর নির্যাতিতার বাস্তবতা। এটা না হয় অনেক অসম্মানজনক, সমাজের কাছে মুখ না দেখানোর মত বিষয়। কিন্তু বিয়ে করে ছাড়াছাড়ি হলে এত সমস্যা তো থাকার কথা নয়।
আপনাদের কথামত দোয়া কালাম পড়ে, শাড়ী-চুড়ি পরে বিয়ে করে, আপনাদের অনুমতি নিয়েই একটা মেয়ে একজনের সঙ্গে শোয়। ‘একটা মেয়ে’ বলছি এজন্যই, ছেলেরা বিয়ে করার সময় সতী-সাবিত্রী মেয়ে খুঁজেই বিয়ে করতে চায়। অনেক ছেলেবন্ধু থাকা, পূর্বপ্রেম থাকা মেয়েদের থেকে বিবাহোপযুক্ত ছেলেরা যারপরনাই সতর্ক থাকেন।
অবশ্য ছেলেরা বিয়ের আগে যা করেন তার গুরুত্ব তেমন একটা নাই বললেই চলে আর বিয়ের পরেও আরো বিয়ের অনুমতি তো আছেই। যাই হোক, এই বিয়ে ভেঙে গেলে সমাজ ডিভোর্সি মেয়েদের বেঁচে থাকা হারাম করে দেয়।
কেন ছাড়াছাড়ি হলো, কেন বেয়াড়া মেয়েমানুষ মানিয়ে নিয়ে স্বামীর ঘরে থাকলো না, আবার কবে বিয়ে করবে ইত্যাদি বলে বলে তার জীবনটা বিষিয়ে তোলে। যেন সব দোষ তার একার, সবকিছু মেনে নেয়ার অদৃশ্য সাংবিধানিক দায়িত্ব এড়ানোটা তার গর্দান যাবার মতো গুরুতর পাপের শাস্তি।
স্বামী যেহেতু ছেড়ে গেছে সেহেতু কাহিনী নিশ্চয়ই আরো ভয়াবহ। কার সঙ্গে কি করেছে, ক’জনের সঙ্গে শুয়েছে কে জানে বাপ! গায়ে হাত তোলার কথা শুনলে বলে স্বামীরা বউদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে গায়ে হাত তুলে শাসন করতেই পারে! স্বামীদেব প্রতিরাতে স্ত্রীর অমতে শারীরিক সম্পর্কে যাচ্ছে শুনলে সমাজ তো চোখ কপালে তুলে ফেলে। বলে কী মেয়ে! শারীরিক সম্পর্কে আবার নারীদের ইচ্ছে অনিচ্ছের কি আছে?
সংসারের কাজে সাহায্য করছে না বললে সমাজ অজ্ঞান হয়ে যায়। স্বামী কেন সাংসারিক কাজে সাহায্য করবে, এসব কী ধরনের কথা! এসব স্ত্রীলোককে দিনে দু’চারবেলা নিয়ম করে পেটালে ঠিক হয়ে যাবে।
এত কারণের একটা কারণেও নারী তার স্বামীকে ছাড়তে পারবে না, তাহলে কোন কারণ ঘটলে নারী তার স্বামীকে ছাড়তে পারবে বলে আপনি মনে করেন?
সতী নারী, অসতী নারী কোন নারীকেই তো সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ভাবতে পারছেন না আপনি। এসব নারীদের তাহলে কি করা উচিত? সতীত্ব আসলে কোথায় থাকে? সতীত্বের আবাস কি শুধু যোনিতেই, পুরুষাঙ্গে এর কোন অস্তিত্ব নাই?
ছেলেটা সতী কিনা সেটা নিয়ে আপনার কেন মাথাব্যথা নাই? আপনি বিয়ের সময় যেমন সতী নারী খোঁজেন, মেয়েটাও যদি সতী ছেলে খোঁজে তো অস্বাভাবিক কোনটা?
সতীত্বের মতো একটা ফালতু কনসেপ্টকে সমাজে টিকিয়ে রাখতে হলে রাখেন। তবে শুধু নারীদের জন্য নয়, পুরুষদের চারিত্রিক বিচারের জন্যও সতীত্বকে গুরুত্ব দিয়ে দেখেন। আর যদি এটা না করতে পারেন তবে সতীত্বের মত একটা অপ্রয়োজনীয়, বাতুলতাপূর্ণ মধ্যযুগীয় কনসেপ্টকে সমাজ থেকে ছুঁড়ে ফেলেন। ভাবতে শুরু করেন, সতীত্ব বলে কোন জিনিস কোথাও নাই, ছিলনা এবং থাকবে না।