জামায়াতের আমীর মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখেছে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ। মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হয়েছিল। সে মামলার শুনানি শেষে গতকাল বুধবার রায় হলো। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে আপিল বিভাগের চার বিচারপতির বেঞ্চ জনাকীর্ণ আদালতে গতকাল জামায়াতের এ শীর্ষ নেতার বিষয়ে রায়ের সংক্ষিপ্ত অংশ প্রকাশ করে। বেঞ্চের অন্য সদস্যরা হলেন– বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। এর আগে গত ৮ ডিসেম্বর নিজামীর আপিল মামলায় একাদশতম দিনের মতো শুনানি শেষে রায় ঘোষণার এ দিন ধার্য করা হয়েছিল। এ আপিল মামলার শুনানি গত বছর ৯ সেপ্টেম্বর শুরু হয়ে ৮ ডিসেম্বর শেষ হয়। ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আসা এটি ষষ্ঠ মামলা, যার চূড়ান্ত রায় হল। এর আগে ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে আনা আরো ৫টি মামলা আপিলে নিষ্পত্তি হয়েছে। খবর বাসসের।
ট্রাইব্যুনালের অন্যতম প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ বাসস’কে জানান, নিজামীকে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড এবং হত্যা–গণহত্যা ও ধর্ষণসহ ‘সুপিরিয়র রেসপন্সিবিলিটি’র (ঊর্ধ্বতন নেতৃত্বের দায়) ৮টি মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ৪টিতে মৃত্যুদণ্ড ও ৪টিতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিলে ৩টিতে মৃত্যুদণ্ড ও ২টিতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ বহাল রেখে সংক্ষিপ্ত রায় প্রকাশ করেছে আপিল বিভাগ। তিনটি অভিযোগে দণ্ড থেকে তাকে খালাস দিয়েছে আপিল বিভাগ। এর মধ্যে একটিতে মৃত্যুদণ্ড ও দু’টিতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দিয়েছিল ট্রাইব্যুনাল।
তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধকালে যার পরিকল্পনা, নির্দেশনা ও নেতৃত্বে আলবদর বাহিনী বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা বাস্তবায়ন করেছিল, সেই মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসির রায় সর্বোচ্চ আদালতের চূড়ান্ত রায়েও বহাল রইল। নিয়ম অনুযায়ী, আপিলের এ রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশের পর তা ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হবে। সেটি হাতে পেলে মৃত্যু পরোয়ানা জারি করবে ট্রাইব্যুনাল। সেই পরোয়ানা ফাঁসির আসামিকে পড়ে শোনাবে কারা কর্তৃপক্ষ। পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশের ১৫ দিনের মধ্যে রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করতে পারবে আসামিপক্ষ।
রিভিউ আবেদনের নিষ্পত্তি হয়ে গেলে এবং তাতে মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকলে আসামিকে তা আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়ে সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার সুযোগ দেয়া হবে। রাষ্ট্রপতির ক্ষমার বিষয়টি ফয়সালা হয়ে গেলে সরকার কারা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করবে।
বাংলাদেশের মন্ত্রিপরিষদে দায়িত্ব পালনকারী তৃতীয় কোন মন্ত্রী ৭১’এ সংঘটিত মানবতা বিরোধী অপরাধে সর্বোচ্চ দণ্ড পেলেন। এর আগে সাবেক মন্ত্রী জামায়াতের আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও বিএনপি’র সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে।
রায় ঘোষণার সময় গতকাল নিজামীর পক্ষে উপস্থিত ছিলেন সিনিয়র এডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন, এডভোকেট এসএম শাহজাহান, এডভোকেট শিশির মনির ও নিজামীর ছেলে ব্যারিস্টার নাজিব মোমিন। অপরদিকে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, অতিরিক্ত এটর্নি জেনারেল মমতাজ উদ্দিন ফকির ও মুরাদ রেজা। এছাড়াও আদালত কক্ষে বিপুল সংখ্যক আইনজীবী, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটরগণ ও ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান খানসহ এর সদস্যরা, দেশি– বিদেশি গণমাধ্যমকর্মী, মামলার সাক্ষী, মুক্তিযোদ্ধারা উপস্থিত ছিলেন।
নিজামীর প্রধান আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন সাংবাদিকদের জানান, পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর তা দেখে ও মতিউর রহমান নিজামীর সঙ্গে কথা বলে মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে রিভিউ আবেদনের সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বাসস’কে বলেন, রায়ে প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে। নিজামীর সর্বোচ্চ সাজার যে রায় হলো, তাতে রাষ্ট্রপক্ষ সন্তুষ্ট। মুক্তিযুদ্ধকালে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড সীমাহীন অপরাধ বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসিই এ অপরাধের একমাত্র সাজা। ফাঁসি ছাড়া এর অন্য কোনো বিকল্প সাজা নেই। আপিলের এ রায় দেশে আইনের শাসনের জন্য আরো একটি মাইলফলক। ২০১৪ সালের ২৯ অক্টোবর মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাবনায় হত্যা, ধর্ষণ ও বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে নিজামীকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছিলেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন জামায়াত নেতা। এ মামলায় গত ৮ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষ তাঁদের যুক্তি উপস্থাপন শেষ করেছিল। গতকাল সকাল ৯টা ৩ মিনিটে রায় পড়া শুরু করেন আদালত। ৯টা ১০ মিনিটের মধ্যেই চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করেন আপিল বিভাগ।
নিজামীর বিরুদ্ধে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড এবং হত্যা–গণহত্যাসহ সুপিরিয়র রেসপন্সিবিলিটির (ঊর্ধ্বতন নেতৃত্বের দায়) মোট ১৬টি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়। এর মধ্যে আটটি, অর্থাৎ ১, ২, ৩, ৪, ৬, ৭, ৮ ও ১৬ নম্বর অভিযোগ প্রমাণিত হয় ট্রাইব্যুনালের রায়ে। প্রমাণিত চারটি, অর্থাৎ সাঁথিয়া উপজেলার বাউশগাড়িসহ দুটি গ্রামে প্রায় সাড়ে ৪০০ মানুষকে হত্যা ও প্রায় ৩০–৪০ জন নারীকে ধর্ষণ (২ নম্বর অভিযোগ), করমজা গ্রামে ১০ জনকে গণহত্যা, একজনকে ধর্ষণসহ বাড়িঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ (৪ নম্বর অভিযোগ), ধুলাউড়ি গ্রামে ৫২ জনকে গণহত্যা (৬ নম্বর অভিযোগ) এবং বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড ও সুপিরিয়র রেসপন্সিবিলিটির (১৬ নম্বর অভিযোগ) দায়ে নিজামীকে ফাঁসির আদেশ দিয়েছিলেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
এর মধ্যে আপিল বিভাগ গতকাল করমজা গ্রামে ১০ জনকে গণহত্যা, একজনকে ধর্ষণসহ বাড়িঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের (৪ নম্বর অভিযোগ) দায় থেকে খালাস দেন। বাকি তিনটি অপরাধে মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রাখেন। পাশাপাশি পাবনা জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক মাওলানা কছিমুদ্দিন হত্যা (১ নম্বর অভিযোগ), মোহাম্মদপুরের ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে পাকিস্তানি সেনা, রাজাকার ও আলবদর বাহিনীর ক্যাম্পে নিয়মিত যাতায়াত ও মানবতাবিরোধী অপরাধের ষড়যন্ত্রের (৩ নম্বর অভিযোগ) দায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল নিজামীকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু আপিল বিভাগ এ দুটি অভিযোগ থেকেও তাকে খালাস দিয়েছেন। তবে আপিল বিভাগ বৃশালিখা গ্রামের সোহরাব আলী হত্যা (৭ নম্বর অভিযোগ) এবং রুমী, বদি, জালালসহ সাত গেরিলা যোদ্ধা হত্যার প্ররোচনার (৮ নম্বর অভিযোগ) দায়ে নিজামীকে দেওয়া ট্রাইব্যুনালের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বহাল রেখেছেন।
১৯৭১ এ নিজামী ছিলেন জামায়াতের তৎকালীন ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি। ছাত্রসংঘই পরে আলবদর বাহিনীতে পরিণত হয়, আর গুপ্তঘাতক আলবদর বাহিনীই মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে মিলে জাতির মেধাবী সন্তান বুদ্ধিজীবীদের উপর নিধনযজ্ঞ চালায়। আলবদর বাহিনীর অপরাধ ও কৃতকর্মের দায়–দায়িত্ব নেতা হিসেবে নিজামীর ওপর বর্তায়। রায়ে বলা হয়, এটা বিশ্বাস করতেই কষ্ট হয় যে, স্বাধীনতার সক্রিয় বিরোধিতাকারী এমন এক ব্যক্তিকে এই রাষ্ট্রের মন্ত্রী করা হয়েছিল। তাকে মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ করা ছিল মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদ ও সম্ভ্রমহারা দুই লাখ নারীর গালে সরাসরি চপেটাঘাত। এ ধরনের লজ্জাজনক কাজ গোটা জাতির জন্য অবমাননাকর। নিজামীকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার ২০১৪ সালের ২৯ অক্টোবর রায় ঘোষণা করে ট্রাইব্যুনাল। এ রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৪ সালের ২৩ নভেম্বর আপিল দায়ের করেন তিনি। ৬ হাজার ২৫২ পৃষ্ঠার ডকুমেন্ট পেশ করে তাতে ১৬৮টি কারণ উল্লেখ করে দণ্ড থেকে খালাস চেয়ে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় ‘এডভোকেট অন রেকর্ড’ জয়নুল আবেদীন তুহিন এ আপিলটি দাখিল করেন। ১২১ পৃষ্ঠায় মূল আপিল আবেদনের সঙ্গে ৬ হাজার ২৫২ পৃষ্ঠার নথিপত্র দাখিল করা হয়েছে। মূল আপিলে ১৬৮ টি ‘গ্রাউন্ড’ পেশ করে দণ্ড থেকে খালাস চাওয়া হয়েছে। ট্রাইব্যুনালে এ মামলায় তদন্ত কর্মকর্তা (আইও) আব্দুর রাজ্জাক খানসহ প্রসিকিউশনের পক্ষে মোট ২৬ জন এ মামলায় সাক্ষ্য দেন। নিজামীর পক্ষে সাফাই সাক্ষ্য দেন তার ছেলে মো. নাজিবুর রহমানসহ মোট চারজন।
২০১০ সালের ২৯ জুন ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের একটি মামলায় মতিউর রহমান নিজামীকে গ্রেফতার করার পর একই বছরের ২ আগস্ট তাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়।
ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আসা এটি ষষ্ঠ মামলা, যার চূড়ান্ত রায় হল। এর আগে ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে আনা আরো ৫টি মামলা আপিলে নিস্পত্তি হয়েছে। চূড়ান্ত পাঁচটি রায়ের পর চারটিতে জামায়াতের দুই সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লা ও মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ এবং বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর ফাঁসির রায় কার্যকর হয়েছে। আপিলের আরেক রায়ে জামায়াতের নায়েবে আমীর দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর সাজা কমিয়ে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। এ রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি ৩১ ডিসেম্বর প্রকাশিত হয়েছে। রায় প্রকাশের ১৫ দিনের মধ্যে সংক্ষুদ্ধদের রিভিউ আবেদন দায়েরের সুযোগ রয়েছে।
সুপ্রিমকোর্ট সূত্র জানায়, মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে আনা আরো ৯টি আপিল মামলা সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। আপিলে শুনানির অপেক্ষায় থাকা মামলার আসামিরা হলেন– জামায়াত নেতা মীর কাশেম আলী, এটিএম আজহারুল ইসলাম ও আব্দুস সুবহান, আওয়ামী লীগ থেকে বহিস্কৃত মোবারক হোসেন, জাতীয় পার্টির নেতা সাবেক প্রতিমন্ত্রী সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সার ও সাবেক এমপি পলাতক ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল জব্বার, চাঁপাইনবাবগঞ্জের মাহিদুর রহমান, বাগেরহাটের শেখ সিরাজুল হক ওরফে সিরাজ মাস্টার ও খান আকরাম হোসেন।